জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলায় প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ
কোনো এলাকা বা ভৌগোলিক অঞ্চলের ৩০ থেকে ৩৫ বছরের গড় আবহাওয়াই জলবায়ু। পৃথিবীর আদি থেকেই জলবায়ু পরিবর্তনশীল, অন্তত ভূতাত্ত্বিক সময়পঞ্জিকা আমাদের তা-ই বলে। ফলে এক মিলিয়ন বছর থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে কয়েকটি বরফ ও উষ্ণ যুগ এসেছে। বর্তমান বিশ্বে দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তন একটি নৈমিত্তিক ঘটনা। এই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বৈশিক উষ্ণতা নামে অধিক পরিচিত। জলবায়ুর পরিবর্তন সমীক্ষা করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত যে পৃথিবীর জলবায়ু পদ্ধতির পরিবর্তনে গ্রিনহাউস গ্যাসগুলোর অবদান রয়েছে। কার্বন ডাই-অক্সাইডের ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ, পৃথিবীর তাপমাত্রার চড়াই-উতরাইয়ে অতীতে যেমন মুখ্য নিয়ামক ছিল কার্বন ডাই-অক্সাইড, ভবিষ্যতেও তেমন থাকবে। বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে সতর্ক করে আসছেন, জলবায়ু পরিবর্তন মানুষের কার্যকলাপের ফল, যা বিশ্বে অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটাতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত জাতিসংঘের আন্তসরকার প্যানেল (আইপিসিসি) তাদের সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলেছে, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এখনই কমানো না গেলে খুব শিগ্গির বিশ্ববাসীকে গুরুতর পরিণতি ভোগ করতে হবে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, অবিলম্বে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিলে বিশ্বে খরা, বন্যা ও তাপপ্রবাহের মতো বিপর্যয় বাড়তেই থাকবে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখন ব্যাপকভাবে অনুভূত হচ্ছে।
মানুষ এবং প্রকৃতিকে ২০ বছর আগের তুলনায় আরও চরম আবহাওয়া মোকাবিলা করতে হচ্ছে। জাতিসংঘ বলছে, এ ধরনের প্রবণতা রোধ করতে একটি সুস্থ বাস্তুতন্ত্র এবং সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য নিশ্চিত করতে হবে। এটি সম্ভব হলে জনগণের কল্যাণ ও জীবনযাত্রার পথ টেকসই হবে। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, এ বছরটিই সম্ভবত এ শতাব্দীর সবচেয়ে শীতলতম একটি বছর হবে। কারণ, আমাদের গ্রহ ক্রমাগত উত্তপ্ত হচ্ছে। আইপিসিসি বলছে, বিশ্বের সরকারগুলো জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তিতে প্রতিশ্রুত বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি এক দশমিক পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ করবে না। বিপরীতে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ বাড়ছে। এমনকি, কয়েক দশকের গড় নির্গমন সর্বকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। যদিও জলবায়ুর পরিবর্তন একটা বৈশ্বিক সমস্যা, তবু উন্নয়নশীল বা অনুন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর ওপর এর প্রভাব হবে ভয়ঙ্কর ও অসামঞ্জস্যহীন। কেননা, এসব দেশে পরিবর্তিত পরিবেশ ও পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর উপাদান, জ্ঞানবিজ্ঞান ও কলাকৌশলের তীব্র ঘাটতি রয়েছে।
মজার বিষয় হচ্ছে, উন্নত দেশগুলোর জনগণের উন্নত জীবনযাপনের বলি হচ্ছে বা হবে উন্নয়নশীল দেশগুলো। জ্বলন্ত একটা উদাহরণ হচ্ছে বাংলাদেশ। যেমন—বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, পৃথিবীর মোট গ্রিনহাউস গ্যাসের মাত্র শূন্য দশমিক ৪০ শতাংশ নিঃসরিত হয় বাংলাদেশে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরাই হব জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত শীর্ষ ১০টি দেশের একটি। মূলত ভৌগোলিক অবস্থান, অতিরিক্ত জনসংখ্যা, দারিদ্র্য ও সামাজিক সুরক্ষার অপ্রতুলতা বাংলাদেশের ঝুঁকিকে দিনদিন প্রসারিত করছে। ফলে, আবহাওয়ার বিভিন্ন চলক, যেমন : বৃষ্টিপাত ও গড় তাপমাত্রার পরিবর্তনের কারণে পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানের অভিঘাত বৃদ্ধিতে অর্থনীতির খাতওয়ারি প্রভাব ধীরে ধীরে তীব্রতর হচ্ছে, যা সামনের দিনে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার বাইরে চলে যেতে পারে।
বাংলাদেশ ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এবং ভৌগলিক অবস্থার কারণে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো, ভূমিকম্প, মাটির লবণাক্ততা প্রভৃতি সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অন্যতম। এ জলবায়ু পরিবর্তন দেশের কৃষি, অবকাঠামো ও জীবনযাত্রার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। ইতোমধ্যেই আমরা সিলেট ও সুনামগঞ্জ অঞ্চলে অকাল বন্যা হতে দেখেছি, যাতে হাওড়াঞ্চলের ফসল, বিশেষ করে ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অস্বাভাবিক তাপমাত্রার কারণে এ বছর কলেরার প্রার্দুভাব দেখা দিয়েছে। ডেঙ্গিসহ বিভিন্ন সংক্রামক রোগ বেড়েছে।
বাংলাদেশ সমতল ও নিচু ভূমি এলাকা নিয়ে গঠিত। জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের নাগরিক এবং সরকারের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠছে। দেশের ৮০ শতাংশেরও বেশি জমি বন্যাপ্রবণ। বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কৃষিকাজে নিয়োজিত, তাই জলবায়ু পরিবর্তন কৃষকদের খারাপভাবে প্রভাবিত করবে।
বিশ্বব্যাংক সতর্ক করেছে, বাংলাদেশ ২১০০ সালের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হবে। প্রতিবেদনে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা তিন ফুট বাড়বে বলে অনুমান করা হয়েছে। এতে দেশে ব্যাপক বন্যা হবে এবং ফসলহানি ঘটবে। এ কারণে দারিদ্র্য ও মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে কৃষিক্ষেত্রে। কৃষি নির্ভর অর্থনীতির দেশগুলোতে পড়ছে বিরূপ প্রভাব।
গত শতাব্দীতে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বেড়েছে ২৩ শতাংশ, নাইট্রাস অক্সাইডের পরিমাণ বেড়েছে ১৯ শতাংশ এবং মিথেনের পরিমাণ বেড়েছে শতভাগ। বেঁচে থাকার জন্য মানুষকে নানা রকম প্রতিকূলতার সঙ্গে সংগ্রাম করতে হয়। বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় প্রতিকূলতা বা হুমকি হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। এই পরিবর্তনে জনসংখ্যার যে অংশটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন, তারা হচ্ছে দরিদ্র জনগোষ্ঠী। সমুদ্র তীরবর্তী ভৌগোলিক অবস্থান, মাত্রাতিরক্ত জনসংখ্যা, অপ্রতুল প্রাকৃতিক সম্পদ এবং এর ওপর অধিক নির্ভরশীলতা ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশের বিপন্নতা খুবই ভয়াবহ।
জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য ক্ষতির হাত থেকে বাংলাদেশকে রক্ষার জন্য সর্বস্তরের জনগোষ্ঠীকে সচেতন করা একান্ত প্রয়োজন। বাংলাদেশের জলবায়ুর পরিবর্তন ইতোমধ্যেই শুরু করেছে। ২০০০ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা রিপোর্টে কক্সবাজার উপকূলে বছরে সাত দশমিক আট মিমি. হারে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি লক্ষ করা গেছে। গত চার দশকে ভোলা দ্বীপের প্রায় তিন হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা সমুদ্রের পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে।
বিভিন্ন গবেষণা রিপোর্ট পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ২১০০ সাল নাগাদ সাগর পৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার উঁচু হতে পারে, যার ফলে বাংলাদেশের মোট আয়তনের ১৮ দশমিক তিন অংশ নিমজ্জিত হতে পারে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সূত্র মতে রাজশাহীর উচ্চ বরেন্দ্র এলাকায় ১৯৯১ সনে পানির স্তর ছিল ৪৮ ফুট, ২০০০ সনে তা নেমে ৬২ ফুট এবং ২০০৭ সনে তা নেমে যায় ৯৩ দশমিক ৩৪ ফুটে। স্বাভাবিক বন্যায় দেশের মোট আয়তনের প্রায় ২০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়। বর্তমানে বন্যার সংখ্যা ও তীব্রতা দুটোই বৃদ্ধি পেয়েছে।
২০০৭ সনের ১৫ নভেম্বর প্রলয়ঙ্করী সাইক্লোন সিডর আক্রমণ করার মাত্র দুই বছরের মধ্যে শক্তিশালী সাইক্লোন নার্গিস ও আইলা এবং ২০১৩ সনে মে মাসে মহাসেন (আংশিক) আঘাত হেনে কৃষিকে বিপর্যস্ত করে তোলে। বিশ্বে যুগে যুগে মহামারি এসেছে, কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানের যুগে এমনটি বেমানান।
মাদার নেচারে কাউকে বা কিছুকে পরোয়া করে না, তেমনই কাউকে নিরাশও করে না, যার যা প্রাপ্য শোধ করে দেয়। প্রকৃতির প্রতিশোধ ও প্রতিদানকে আমাদের সম্মান করতে ও মনে রাখতে হবে। প্রাণঘাতী এ ভাইরাস দিয়ে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল, তছনছ করেছে তাদের উন্নত চিকিৎসাব্যবস্থা, ভেঙে যাচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা, সরকার দেশে দেশে দিশেহারা অবস্থায় হিমশিম খাচ্ছে। প্রকৃতি মাতা কোভিড-১৯ দিয়ে অস্বাভাবিক পরিবেশ বানিয়ে মানুষকে স্বাভাবিক জিনিস অবলোকনের সুযোগ করে দিয়েছে।
পৃথিবীতে সৃষ্টির পর সৃষ্টিকর্তা উদ্ভিদ সৃষ্টি করেছেন। উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে কার্বন ডাই–অক্সাইড গ্রহণ করে, অক্সিজেন ত্যাগ করে। পরিবেশ থেকে মানুষ শ্বাস গ্রহণের মাধ্যমে বায়ু থেকে সেই অক্সিজেন গ্রহণ করে বেঁচে এ পর্যায়ে পৌঁছেছে। উদ্ভিদ সব মানুষ ও জীবজন্তুর জন্য খাদ্য সরবরাহ করে। উদ্ভিদ বেঁচে থাকার জন্য দূষণমুক্ত পরিবেশ প্রয়োজন। লড়াই করার জন্য ইমিউনিটি অর্জন করতে হবে। আর এই ইমিউনিটি শক্তি অর্জনের মূল উৎস প্রকৃতি। প্রয়োজনীয় সবকিছুই আমরা পর্যাপ্ত পরিমাণে পাই প্রকৃতি থেকে, যে প্রকৃতি তার দানের অপার ভান্ডার অবারিত করে দিয়ে যাচ্ছে, আমাদের সেই প্রকৃতিকে রক্ষা করতে হবে, যত্ন করতে হবে। কোনোভাবে ধ্বংস করা যাবে না। প্রকৃতি বিরূপ হলে আমরা বাঁচব না। প্রকৃতিকে রক্ষা করলে রক্ষা পাবে মানুষ। প্রকৃতি ধ্বংস করলে বিভিন্ন ভাবে মানুষ করোনার মতো লাখো কোটি জীবাণু দ্বারা বিপর্যস্ত হবে। এমনকি, মানবজাতি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। বিশ্বময় করোনার তাণ্ডবে মানুষ যখন অসহায় হয়ে ঘরে বন্দি, প্রকৃতি তখন ফেলছে স্বস্তির নিশ্বাস। প্রকৃতি হয়তো প্রতিশোধ নিতে নয়, বরং প্রতিরক্ষার জন্য বা প্রাণিকূলকে বৃহত্তর ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে এ ক্ষুদ্রতর ক্ষতি, একটি শিক্ষা। পৃথিবী শুধু আমাদের বা মানুষের একার নয়, সব জীবজন্তু, উদ্ভিদ, লতাপাতার।
লেখক : নিউজ প্রেজেন্টার, এনটিভি