স্বাধীন ভাবনা
আমাদের যে স্বপ্নগুলো পূরণ হয়নি
মুক্তিযুদ্ধের পর আমাদের প্রত্যাশা ছিল আকাশচুম্বী। আমরা আশা করেছিলাম যে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে সমস্ত পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। এ রাষ্ট্রের কাঠামো হবে গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক, যেখানে সামাজিক বিভাজন থাকবে না। যেখানে বিজ্ঞান-মনস্কতা প্রাধান্য পাবে, কুসংস্কার কোনো জায়গা পাবে না, ধর্মের নামে শোষণ চিরদিনের জন্য নির্মূল হবে এবং সামাজিক নিরাপত্তা থাকবে। অনেক স্বপ্ন ছিল, আমাদের সে স্বপ্নগুলো পূরণ হয়নি, কারণ আমরা স্বাধীনতার পর থেকে দেখি যে বিভাজনের রাজনীতি এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার যে শত্রুরা চুপচাপ বসেছিল, ঘাপটি মেরে, তারা নানান সুযোগ নিয়ে প্রকাশ্যে বেরিয়ে এসেছে।
বঙ্গবন্ধুকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হলো। এরপর যারা ১৯৯১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশকে শাসন করল, তাদের কারণে মুক্তিযুদ্ধের অনেক অর্জন বিনষ্ট হলো, এমনকি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটাও বিকৃত হলো। একটা সময় আমরা দেখেছি যে বঙ্গবন্ধুর নামটা পর্যন্ত নেওয়া হতো না। মুক্তিযুদ্ধ ছিল সমস্ত জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে একটা বড় যুদ্ধ, জনযুদ্ধ; যার নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু, কিন্তু তিনি তখন কারাগারে ছিলেন। তারপরও মানুষ যুদ্ধ করেছে একটা আদর্শের জন্য, চেতনার জন্য এবং চেতনার বাস্তবায়নের জন্য, কেউ কেউ বলে এটি একটি সামরিক কৌশল। এটি মোটেও কোনো সামরিক কৌশল ছিল না, এটি ছিল জনযুদ্ধ। এই মিথ্যাচার এবং ইতিহাস বিকৃতি বহুদিন চলল। তারপর এখন আমরা একটা অবস্থানে এসেছি, যেখানে আমরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটা পুনরুদ্ধার করেছি, কিন্তু মানুষের অধিকার পুনরুদ্ধার করতে পারিনি। এখন দারিদ্র্যের কোনো স্থান নেই। এখনো ক্ষমতায় যারা অধিষ্ঠিত, তাদের কথাই বেদবাক্য। তাদের কথার বিপরীত কোনো কথা আমরা বলতে পারি না। যেমন সুন্দরবনের একেবারে সামনেই যে বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে এখন কথা বলা মানে রাষ্ট্রদ্রোহের সমান হয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশে যে গণতন্ত্র চলছে, তা এখন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চলছে। আমি মনে করি না যে আমাদের দেশে সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে। আমরা এমন একটা অবস্থানে পৌঁছেছি যে একটা দল গণতন্ত্রের নামে গণতন্ত্রের ধারেকাছে পৌঁছাতে পারছে না। এর ফলে জনগণের কাছে দায়িত্বটা এসে পড়ছে তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের। দুটো রাজনৈতিক দল সে ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারবে না। সে জন্য প্রত্যাশা হচ্ছে তরুণদের নিয়ে। অথচ তরুণরাও অনেক বিভ্রান্ত। তারা সঠিকভাবে তাদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করতে পারছে না। অনেকেই বিপন্ন, বিপদগ্রস্ত, অনেকেই মাদকাসক্তির ছোবলে, অনেকে অনেক সহিংস মতবাদ গ্রহণ করেছে এবং ধর্মতন্ত্র অনেককে দখল করে নিয়েছে। ফলে সহিংসতা, স্বার্থপরতা আমাদের জাতীয় জীবনে প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে।
প্রাপ্তির ব্যাপারে আমি মনে করি, আমরা কিছুটা পেয়েছি। আমাদের স্বাধীনতা আমাদের যে শক্তি দিয়েছিল, আত্মবিশ্বাস দিয়েছিল, যে ক্ষমতা দিয়েছিল, তার প্রকাশ আমরা রাজনৈতিক মহলে দেখিনি, শিক্ষিত মহলে দেখিনি; কিন্তু আমরা দেখেছি কৃষকের ক্ষেতে। তাঁরা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ওপরে তুলে ধরেছেন। আমরা দেখেছি তৈরি পোশাকশিল্পে মেয়েরা তাঁদের ঘামে-শ্রমে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে তাঁদের মাথার ওপর তুলে ধরেছেন। আমরা দেখেছি প্রবাসী শ্রমিকদের কষ্টের বিনিময়ে এ দেশের অর্থনীতির মজবুত হওয়া। কাজেই এই কৃষক-শ্রমিক এবং প্রবাসী শ্রমিক যেটি করছে, তাঁরা তাঁদের আদর্শ ধরে রেখেছেন। বাংলাদেশকে ভালোবেসে তাঁরা তাঁদের কাজগুলো করে যাচ্ছেন; কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদরা সেটি করতে পারছেন না, আমাদের শিক্ষাবিদরা সেটি করতে পারছেন না এবং আমাদের সুশীল সমাজ সেটি করতে পারছেন না, প্রত্যেকেই একটি মতলবের পেছনে ঘুরছেন। মতলবহীন হচ্ছে আমাদের কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতিরা এবং মতলববাজ হচ্ছে আমাদের রাজনীতিবিদ, আমাদের সুশীল সমাজ সবাই।
সে জন্য আমরা ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছি। কিন্তু আমার বিশ্বাস, তরুণরা একটা অবস্থান গ্রহণ করলে আমরা অনেকটা অর্জনের পথে যেতে পারব। সে জন্য তরুণদের ভেতরেও সদিচ্ছা থাকতে হবে এবং ভেতরেও শুভচিন্তা জাগ্রত হতে হবে। তারা মাদক এবং উগ্র চিন্তার কবল থেকে নিষ্কৃতি পাবে। তা হলে তারা তাদের মেধা-কল্পনা ও চিন্তা দেশের কল্যাণে বিনিয়োগ করতে পারবে। কাজেই ২৫ বছরের যদি একটা হিসাব নেওয়া হয়, তাহলে একদিকে দেখা যাবে আমাদের প্রচুর অর্জন হয়েছে; কিন্তু আমরা প্রচুর বিসর্জনও দিয়েছি।
আমাদের প্রত্যাশা যেটুকু, তার কিছুটা আমরা পূরণ করতে পেরেছি, তার অনেকটাই আমরা পূরণ করতে পারিনি। তবে আমি খুব আশাবাদী মানুষ। আমি মনে করি, আগামী ১০ বছরে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অনেকটাই নির্ধারিত হয়ে যাবে এবং আমরা কোথায় যাচ্ছি, সে বিষয়ে আমাদের পরিষ্কার একটি ধারণা হবে।
শিক্ষার আমাদের বিস্তার ঘটেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রচুরসংখ্যক ছেলেমেয়ে এখন পড়াশোনায় অংশগ্রহণ করছে। অনেকে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যেমন স্বাধীনতার পর মাত্র ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল, এখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় ১৩০টির বেশি। স্কুল যা ছিল, তার চার গুণ আমরা প্রতিষ্ঠা করেছি। কাজেই শিক্ষার বিস্তার ঘটেছে, কিন্তু মানের সে পর্যায়ে বিস্তার ঘটেনি। শিক্ষার বিস্তার ঘটেছে সেটা সত্য, তবে শিক্ষার মান নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। এখন আমাদের উচিত হবে, শিক্ষা বিস্তারের একটা পর্যায়ে এসে মানের দিকে দৃষ্টি দেওয়া। আমি মনে করি, যেহেতু আমাদের ক্ষেতের কর্ষণটা হয়ে গেছে, ক্ষেতে উন্নত বীজ রোপণের সময়টা যদি আমরা নিজেদের শাসনে রাখি, যদি আমরা নিজেদের ভবিষ্যৎকে নিজেদের হাতের মুঠোয় রাখার চেষ্টা করি, তাহলে সেটাও সম্ভব হবে। কাজেই শিক্ষার বিস্তার ঘটেছে, কিন্তু মানে পৌঁছাতে পারিনি, সে বিষয়ে চিন্তা নেই। কারণ, আমি মনে করি, আগামী ১০ বছরে আমরা মানে পৌঁছাতে পারব।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।