জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি
দুখী রাজকন্যা শেখ হাসিনা

এখন শরৎকাল। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার চারদিকে সবুজ বৃক্ষ ও খাল-বিলে থৈথৈ জলরাশি। দিগন্ত বিস্তৃত কাশফুল, শিউলিতলার নরম চাদর আর সাদা মেঘের ভেলায় চেপে রাজকন্যার আবির্ভাব হয়েছিল এ রকমই একটি দিনে, ১৯৪৭ সালে। ২৮ সেপ্টেম্বর টুঙ্গিপাড়ার রাজকন্যা শেখ হাসিনার জন্মদিন। কিন্তু আপনি দুখী রাজকন্যা কেন? আপনি কোনো সামন্ত রাজার কন্যা নন? তবে আমাদের উপকথা-রূপকথার দুখী রাজকন্যার মতো আপনি। আপনার কোনো অর্জনই সহজে হাতের মুঠোয় আসেনি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা হয়েও আপনাকে টিকে থাকার জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করতে হয়েছে। জাতির পিতাকে দীর্ঘদিন যেমন রাজপথ ও জেলের সেলে বন্দি থেকে জনগণের জন্য অধিকার আদায় করে নিতে হয়েছিল, তেমনি ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট-পরবর্তী আপনাকেও কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। আজকে যখন তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারী ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখার জন্য আন্তর্জাতিক সাউথ-সাউথ পুরস্কারসহ বহু খেতাবে ভূষিত হন অথবা বিশ্বসভায় আপনার শান্তি প্রস্তাব ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচিত হয় অথবা দেশের চা-শ্রমিকরা ভালোবেসে আপনাকে বালা উপহার দিয়ে যায়, তখন আমরা একদিকে যেমন গৌরবান্বিত হই, অন্যদিকে তেমনি আপনার রাজনৈতিক সংগ্রামের বাস্তবতার কথা স্মরণ করে নির্বিশেষ মানুষ ও মানবতার পক্ষে কাজ করার জন্য উৎসাহী হয়ে উঠি।
১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা আপনি বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন। এটি ছিল আপনার পুনর্জন্ম। আপনার পুনর্জন্মের পরে বাংলাদেশ পুনরায় বাংলাদেশ হয়ে উঠেছিল। ৩০ বছর আগের সেই দিনটি এখনকার মতো ছিল না। সেদিনকার বাতাস ছিল কান্নার বৃষ্টি ও প্রাকৃতিক ঝড়ের এক অপরাহ্ণ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ৩ নভেম্বরে জাতীয় চার নেতার নির্মম হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশকে পাকিস্তানে পরিণত করার প্রচেষ্টা হয়েছে। আপনার পদস্পর্শে সেই জল্লাদের দেশ পুনরায় সোনার বাংলা হয়ে ওঠার প্রত্যাশায় মুখরিত হয়েছিল। আজ তার প্রমাণ আমরা পাচ্ছি। আপনার প্রত্যাবর্তন ছিল অতি সাধারণ, কারণ সেভাবেই আপনি দেশের জনগণের সামনে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। আপনি এক বৃহৎ শূন্যতার মধ্যে এসে দাঁড়ালেন। এখানে ঘরের আপনজন কেউ নেই। তাই সারা দেশের মানুষ আপনার আপন হয়ে উঠল। আপনি এখানে আসার আগে প্রায় পাঁচ বছর মানুষকে স্বৈরশাসকরা বোঝাতে চেয়েছিল, তারাই জনগণের মুক্তিদাতা। কিন্তু সাধারণ মানুষ ক্ষণে ক্ষণে জেগে উঠছিল, বিচার দাবি করছিল জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের। এমনকি বিভিন্ন বাহিনীর অন্তর্কোন্দলও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল। আপনি নেত্রী, কিন্তু তারও বেশি আপনি কর্মী। কারণ দলকে ঐক্যবদ্ধ করা, বঙ্গবন্ধু ও তাঁর শাসনকাল সম্পর্কে অপপ্রচারের সমুচিত জবাব দেওয়া, পাকিস্তান ও অন্যান্য দেশের ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করা আপনার প্রাত্যহিক কর্মে পরিণত হলো। দেশে ফেরার প্রতিক্রিয়ায় আবেগসিক্ত কথন আছে আপনার নিজের লেখা গ্রন্থগুলোতে। তুলে ধরছি একটি উদ্ধৃতি : ‘আমার দুর্ভাগ্য, সব হারিয়ে আমি বাংলাদেশে ফিরেছিলাম। লক্ষ মানুষের স্নেহ-আশীর্বাদে আমি সিক্ত হই প্রতিনিয়ত। কিন্তু যাঁদের রেখে গিয়েছিলাম দেশ ছাড়ার সময়, আমার সেই অতি পরিচিত মুখগুলি আর দেখতে পাই না। হারানোর এক অসহ্য বেদনার ভার নিয়ে আমাকে দেশে ফিরতে হয়েছিল।’(ড. আবদুল মতিন চৌধুরী : আমার স্মৃতিতে ভাস্বর যে নাম, বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের জন্ম, পৃ.-৭৪)
২
এ দেশে আপনার পুনর্জন্মের দিন থেকেই রাজনীতির মঞ্চে দ্রুত দৃশ্যপট পরিবর্তন হতে থাকে। বঙ্গবন্ধু ও জয় বাংলা স্লোগান নিষিদ্ধ ছিল। সেদিন সেই স্লোগান প্রকম্পিত হয়ে উঠল আকাশে-বাতাসে; রাজপথ জনগণের দখলে চলে গেল। অনেকেই আপনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের বিরুদ্ধে ছিলেন। কিন্তু প্রত্যাবর্তনের আগে সে বছরই আপনি আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং অনেকের অভিসন্ধি ভেস্তে যায়। সেদিনের ঢাকায় লক্ষ মানুষের বাঁধভাঙা স্রোত আপনাকে কেন্দ্র করে সমবেত হয়েছিল। তাদের কণ্ঠে ছিল বিচিত্র স্লোগান—‘শেখ হাসিনা তোমায় কথা দিলাম, মুজিব হত্যার বদলা নেব, জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনার আগমন শুভেচ্ছা স্বাগতম।’ অনেক অশ্রুসিক্ত বৃদ্ধের কণ্ঠে ছিল, ‘মাগো তোমায় কথা দিলাম, মুজিব হত্যার বদলা নেব।’ সেদিনের প্রত্যয় আপনি ও আপনার সরকারই সত্য করে তুলেছেন। কয়েকজন খুনির ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। বাকিদের শিগগিরই হবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।
৩
দুখী রাজকন্যার মতো হৃত রাজ্য, হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য আপনার জন্ম ও পুনর্জন্মের খুব বেশি প্রয়োজন ছিল দেশ ও জনতার। আগেই বলেছি, আপনার পুনর্জন্মের আগে নৈরাজ্যের জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছিল মানুষ।
পাকিস্তানি শাসক, দালাল-রাজাকার ও আন্তর্জাতিকভাবে কয়েকটি দেশের বাধা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এবং আপামর জনগণের অংশগ্রহণে নয় মাসের মুক্তিসংগ্রামে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা ও রক্ষা করার প্রচেষ্টা সফল হতে দেয়নি খুনিরা। ফলে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট-পরবর্তী সামরিক শাসকদের অভ্যুত্থান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করে। দেশ অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হয়। দেশের প্রতিকূল একসময়ে আপনাকে আমরা রাজনীতির মঞ্চে পেলাম। আপনি দায়িত্ব নিলেন এবং লাখো জনতার সমাবেশে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, ‘আজকের জনসভায় লাখো লাখো চেনামুখ আমি দেখছি। শুধু নেই আমার প্রিয় পিতা বঙ্গবন্ধু, মা আর ভাইয়েরা এবং আরো অনেক প্রিয়জন। ভাই রাসেল আর কোনো দিন ফিরে আসবে না, আপা বলে ডাকবে না। সব হারিয়ে আজ আপনারাই আমার আপনজন।...বাংলার মানুষের পাশে থেকে মুক্তিসংগ্রামে অংশ নেওয়ার জন্য আমি এসেছি। আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।’ গত তিন দশকে দেশি-বিদেশি চক্রান্ত ও বিচিত্র প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে আপনি জনগণের পাশেই আছেন বলে আমরা মনে করি। ১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০০৭ সালের সামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল পর্যন্ত একাধিকবার বন্দি অবস্থায় নিঃসঙ্গ মুহূর্ত কাটাতে হয়েছে আপনাকে। আপনি লিখেছেন, ‘দেশ ও জনগণের জন্য কিছু মানুষকে আত্মত্যাগ করতেই হয়, এ শিক্ষাদীক্ষা তো আমার রক্তে প্রবাহিত। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এর পর প্রবাসে থাকা অবস্থায় আমার জীবনের অনিশ্চয়তা ভরা সময়গুলোয় আমি তো দেশের কথা ভুলে থাকতে পারিনি? ঘাতকদের ভাষণ, সহযোগীদের কুকীর্তি সবই তো জানা যেত।’ (নূর হোসেন, ওরা টোকাই কেন, পৃ.-৫৩)
৪
১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশ ও জনগণের কাছে প্রত্যাবর্তনের (জন্মান্তরের) মতো আপনার দ্বিতীয় প্রত্যাবর্তনও (তৃতীয় জন্ম) ছিল আমাদের জন্য মঙ্গলকর। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির পর আপনার দেশে ফেরার ওপর বিধিনিষেধ জারি করে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। আপনাকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার সেই চক্রান্ত ব্যর্থ হয়। আপনি দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। কিন্তু ১৬ জুলাই আপনাকে মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করে ৩৩১ দিন কারাগারে বন্দি করে রাখে। সে সময় গণমানুষ আপনাকে গভীরভাবে উপলব্ধি করেছে। আপনার কারাফটকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের উদ্বেগ, গ্রেপ্তারের সংবাদ শুনে দেশের বিভিন্ন স্থানে চারজনের মৃত্যুবরণ, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের উৎকণ্ঠা আপনাকেও স্পর্শ করেছিল নিশ্চয়। কারণ সে সময় আদালতের উঠানে আপনি ছিলেন সাহসী ও দৃঢ়চেতা; দেশ ও মানুষের জন্য উৎকণ্ঠিত; বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে সত্যকথা উচ্চারণে বড় বেশি সপ্রতিভ। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল, এ সময়ে দেশে সন্ত্রাস, দুর্নীতি, ধর্ষণ ও লুটপাটের মাধ্যমে এ দেশকে দোজখে পরিণত হয়েছিল। আপনাকে গ্রেনেড, বুলেট, বোমায় শেষ করতে চেয়েছিল। কিন্তু আপনি ছিলেন নির্ভীক। ২০০১ সালের নির্বাচনোত্তর জোট সরকারের অত্যাচার-নির্যাতন-ধর্ষণ আপনাকে কতটা ব্যথিত করেছিল, তা এখনো বিভিন্ন সভা-সমাবেশের বক্তৃতায় শুনে থাকি আমরা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করে নতুন প্রজন্মকে যথার্থ ইতিহাসের পথ দেখিয়েছেন আপনি নিজেই।
৫
আমাদের প্রজন্ম আপনাকে স্মরণ করছি কেন? বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সময় আমরা যাঁরা রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠি, তাঁরা আপনাকে গণ-আন্দোলনের নেত্রী হিসেবে দেখেছি, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখেছি, মানুষের দুঃখ-বেদনায় কাতর হতেও দেখেছি। মুক্তিযুদ্ধকালীন কিংবা তার আগের বছরে যাঁদের জন্ম, এঁদেরই মতো আমিও একজন যখন কেবল এভাবে দেখে এবং গ্রন্থ পাঠ করে ও রাজনৈতিক খবর শুনে আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু এবং আপনার সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠি, তখন আমাদের প্রজন্মের অন্যেরাও যে আপনাকে সদর্থক মূল্যায়ন করবে, এটাই স্বাভাবিক। এ জন্য আপনাকে নিরাশ হতে নিষেধ করি। কারণ, বর্তমান প্রজন্ম থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বঙ্গবন্ধু ও আপনার আদর্শ অনুসরণ করে যাবে; সৃষ্টি হবে বিশ্বসভার যোগ্য বাংলাদেশ।
আপনার সাফল্য দিন দিন আরো বৃদ্ধি পাবে। আপনি সেই ব্যক্তি, যিনি নিমতলীর আগুনের মধ্য থেকে উঠে আসা অসহায় মানুষের নিরাপদ আশ্রয় হয়ে উঠেছেন। কতিপয় কুখ্যাত বিডিআর কর্তৃক সেনা অফিসার হত্যাযজ্ঞ-পরবর্তী পরিস্থিতি সামলেছেন। মা রমিজার কন্যা হয়ে ছুটে গেছেন অজপাড়াগাঁয়ে। আপনার অবদান এই ছোট পরিসরে বলে শেষ করা যাবে না। আপনি এ দেশে সুন্দর ভবিষ্যৎ নিয়ে জন্মেছিলেন। কিন্তু দুখী রাজকন্যার মতো প্রত্যাবর্তন করেছিলেন বলেই (সে রকম ফিরে আসা আমাদের প্রত্যাশিত ছিল না) আজ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শিক্ষানীতি, নারীনীতি, ফতোয়া প্রদানে বিধিবিধান দিয়েছেন। সর্বোপরি ১৯৭৫-পরবর্তী যাঁরা সংবিধানকে কলুষিত করেছিল, তাঁদের চপেটাঘাত দিয়েছেন ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে গিয়ে; ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করেও। আপনার আগামী দিনগুলো শুভ হোক; জন্মদিনে এই প্রত্যাশা আমাদের।
(লেখক : ড. মিল্টন বিশ্বাস, অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।)