প্রতিক্রিয়া
জান্নাতদের কান্না থামবে কবে?

নয় বছরের শিশু জান্নাত। বাড়ি চাঁদপুর। গাজীপুরে এক পরিবারে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করত । এবারের কোরবানির ঈদে বাড়ি যেতে চাওয়ায় অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয় সে । শিশুটির অপরাধ হলো সে নতুন জামা-কাপড়সহ ঈদে বাড়ি যেতে চেয়েছে । হয়তো এ নিয়ে একটু বেশিই ‘ঘ্যানর ঘ্যানর’ করেছে জান্নাত। তাই এ রকম নির্যাতন! পত্রিকার স্থির চিত্র থেকে দেখা যায় শিশুটির সারা শরীরে চল্লিশ থেকে পয়তাল্লিশটি গরম খুন্তির দাগ স্পষ্ট। প্রত্যেকটি দগদগে ঘা। যা গড়ে দুই থেকে আড়াই ইঞ্চি করে লম্বা। এটি নিছক একটি পরিসংখ্যান নয় । খুন্তিই ব্যবহার করে সেটা আগুনে গরম করে চল্লিশবারেরও বেশি শিশুটির গায়ে ঠেসে ধরা হয়েছে। এর উপরে আবার বৈদ্যুতিক তারের আঘাত। এতেও শিশুটির পাপমোচন হয়নি! তাই তার মাথাকে বাসার টাইলসের সাথে ঘসে ঘসে ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছে। এ ঘটনার আগেও শিশুটিকে একাধিকবার বিভিন্ন অজুহাতে নির্যাতন করা হয়েছে। এমনকি গরম ইস্ত্রি দিয়েও তার মাথা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
এ ধরনের নির্যাতনের ঘটনা আমাদের সমাজে নতুন নয় । প্রতিনিয়ত বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন চলছে। মাঝেমধ্যে দুই একটি ঘটনা মিডিয়ার কল্যাণে আমাদের একটু আন্দোলিত করে দিয়ে যায়, কিন্তু সমাধান দিতে পারে না।
নির্যাতনের সাথে জড়িত দুজন সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী।স্বামী ওমর ফারুক চাকরি করেন ঢাকা বিমানবন্দরে। স্ত্রী মনি বেগম একজন স্কুল শিক্ষক। যেকোন মানদণ্ডেই তাঁরা দুজন সমাজের সচেতন শ্রেণির নাগরিক হিসেবেই বিবেচিত । এই ঘটনা আমাদের আবারো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, শুধু শিক্ষা আর সামাজিক অবস্থানই মানুষকে মানুষে রূপান্তরিত করতে পারে না । স্কুলের শিক্ষক মনি বেগমও তা প্রমাণ করলেন, দুর্বলের ওপর সবলের আচরণগত ধর্ম সার্বজনীন। এখানে সবল ব্যক্তি নারী না পুরুষ সেটা মুখ্য না, ক্ষমতাই মুখ্য।
এ ধরনের ঘটনা ক্রমাগত বেড়েই চলছে। কিছু ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু অপরাধ বন্ধ হচ্ছে না। আইনের নিজস্ব গতি রয়েছে, যার বাইরে আইন যেতে পারে না।কিন্তু সহিংসতা ও অপরাধ অনেক বৈচিত্র্যপূর্ণ। আইন অপরাধীর শাস্তি বিধান করতে পারে, অপরাধকে নিধন করতে পারে না। ক্রিকেটার শাহাদাত হোসেন ও তার স্ত্রী কর্তৃক নির্যাতিত গৃহকর্মী যখন আদালতকে শাহাদাতের পক্ষেই জবানবন্দি দেয়, তখন বুঝতে হবে সমস্যার শিকড় অনেক গভীরে। এগুলো সামগ্রিক সামাজিক বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু না। সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চার মাধ্যমে মানুষের মানবিক মূল্যবোধ তৈরি হয়। আর মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন জনগোষ্ঠী তৈরি করতে না পারলে এ ধরনের অপরাধ ও সহিসংতা ভিন্ন কোনো স্থানে ভিন্ন কোনো আঙ্গিকে আবার আমাদের সামনে হাজির হবে। আমরা দিন দিন পাশবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন হয়ে যাচ্ছি। এটাই আমাদের অন্যতম প্রধান সমস্যা। যেখানে ওমর ফারুক, মনি বেগমরা সমাজের একটা বড় অংশের মানুষের মধ্যেই বিরাজ করছে, সেখানে জান্নাতরা কাঁদতেই থাকবে।
লেখক : প্রভাষক, নৃ-বিজ্ঞান বিভাগ, গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।