অভিমত
সন্ত্রাসের বিপরীতে অভয় বাজুক হৃদয় মাঝে
গুলশান হামলার কয়েক সপ্তাহ পেরিয়ে গেল। কিন্তু এখনো রেশ কাটেনি এর। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে হায়েনাদের উল্লাসের দৃশ্য। সন্ধ্যা নামলেই যেন ভুতুড়ে পরিবেশ বিরাজ করে গুলশানজুড়ে। যার ছোঁয়া এসে লেগেছে পুরো নগরে, মতান্তরে দেশজুড়ে। এটা মোটেই শুভ লক্ষণ নয়। যে এলাকায় এই ঘটনা হয়েছে, পত্রিকা ও টিভির রিপোর্ট বলছে, সেখানে এখনো কার্যক্রম শুরু করেনি অনেক ইংরেজি মাধ্যম স্কুল। অন্যদিকে ঈদের ছুটি শেষে ক্লাস শুরু হওয়া স্কুলের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরাও আছেন শঙ্কায়। এর মধ্যে পুরো নগরে বেড়েছে পুলিশের টহল। এখানে সেখানে চেকিং। একটা ভীতিকর পরিবেশ যেন গড়ে উঠেছে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, জঙ্গিরা যা চেয়েছিল তাই যেন হচ্ছে।
কথায় বলে, বনের বাঘে খাওয়ার আগে মনের বাঘে খায়। আমাদেরও মনে হয় এখন এই দশা। সেই রাখাল বালকের মতো ‘এই বাঘ এলো, এই বাঘ এলো’ বলে গুজব। কিন্তু যেদিন সত্যিকারের বাঘ আসবে সেদিন তো আর বলে-কয়ে আসবে না। তাই যদি হতো তবে তো ঠেকানো যেত গুলশানের হামলা। যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রথমে দাবি করেছিলেন, হামলার বিষয়ে তারা আগে থেকেই জানতেন। পরে এ কথা নিয়ে যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সোচ্চার তিনি ব্যাখ্যা দিলেন, কোনো কোনো জায়গায় হামলা হতে পারে বলে তাদের কাছে তথ্য ছিল। সে যাই হোক! এখন শহরজুড়ে চলছে নানা ধরনের গুজব। গুজবের জন্য কান পাতা দায়। এই গুজবের মুখোমুখি বেশি পড়তে হয় সংবাদকর্মীদের। কারণ সাধারণ মানুষ তো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে কিছু জানতে পারে না, সে কারণে তাদের ধারণা ‘সাংবাদিকরা অনেক কিছু জানে!’ কিন্তু প্রকৃত তথ্য কারো কাছে খুব একটা আছে বলে মনে হয় না।
জঙ্গি নিয়ে ভবিষ্যতে কী হবে, করণীয় কী বা নিখোঁজদের তালিকা তৈরি, ফেরানোর আকুতি সবকিছুর পাশাপাশি এখন যে কাজটি সবচেয়ে বেশি করা দরকার বলে মনে হয়, মানুষের মনে সাহস ফিরিয়ে আনা। ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার অবশ্য গুজব বিষয়ে একটা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, ‘জঙ্গি হামলার গুজব ছড়ানো ফৌজদারি অপরাধ। যারা এ ধরনের গুজব ছড়াচ্ছে, তাদেরকে ফৌজদারি আইনের আওতায় আনা হবে।’ এই বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে পারলে অবশ্য একটা ভালো কাজ হবে। কারণ এই, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে বিভিন্ন মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে গুজব ছড়াচ্ছে ঢালপালা আকারে। এগুলোর এখনোই বন্ধ হওয়া দরকার।
ফ্রান্সের নিসে হামলা হলো এক সপ্তাহও পার হয়নি। কিন্তু সেখানকার সংবাদ যা পাই, তাতে মনে হয়নি তারা আমাদের মতো ভীত নয়। বরং তারা উল্টো জেগে উঠেছে। সেই জেগে ওঠার কথা ছিল আমাদের। কারণ বাঙালি বীরের জাতি বলে খ্যাতি রয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সেদিন দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে সবাইকে সজাগ থাকার এক ফাঁকে বললেন, ‘বাঙালি যেমন বীরের জাতি তেমনি বেইমানের জাতিও।’ তার কথায় যুক্তি আছে বটে। অন্তত ’৭৫-এর ঘটনা বা আরো কিছু কিছু রাজনৈতিক বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রেখেই তিনি সে কথা বলেছেন। তাই থাকতে হবে সজাগ। গ্রামের রাতজাগা পাহারাদারদের মতো আমাদেরও এক-একজন পাহারাদার হয়ে উঠতে হবে। গণমাধ্যম থেকে পাওয়া খবরে জানা যাচ্ছে, ফ্রান্সের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। অ্যাসোসিয়েট প্রেসের খবরে বলা হচ্ছে, নিসের বিখ্যাত রিভেরা উপকূলে লোকজন আবার জগিং শুরু করেছে, বাইসাইকেল নিয়ে মানুষ রাস্তায় নেমেছে, যারা সূর্যস্নান করে তারা ফিরেছে। খুলছে খাবারের দোকানগুলো। সিএনএন বলছে, রাতের দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে জেগে উঠতে শুরু করেছে নিস শহরটি।
ওরা যদি পারে তাহলে আমরা কেন পারব না? অথচ এখনো এই শহরে দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র। বিশেষ করে গুলশান এলাকায় সন্ধ্যা হলেই নেমে আসছে নীরবতা। রাজউক অবৈধ রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন স্থাপনা ভেঙে ফেলার ঘোষণা দেওয়ায় আতঙ্ক বেড়েছে বেশি। বিশেষ করে অনেক শিক্ষার্থী যারা পার্ট টাইম কাজ করে এসব রেস্টুরেন্টে। এ প্রসঙ্গে প্রাসঙ্গিক সাংবাদিক সানাউল্লাহ লাবলুর ফেসবুক স্ট্যাটাসের কিছু অংশ তুলে ধরছি। ‘সন্ধ্যা হতেই রাস্তাঘাট ফাঁকা হতে থাকে। রাত ৮টার পর যেন আতঙ্ক নেমে আসে গুলশান-বনানীতে। রেস্তোরাঁ, দোকানপাট সব বন্ধ। ভয় আর গুজব যেন নতুন করে হত্যা করতে নেমেছে ঢাকা শহরের এই ‘অভিজাত’ জনপদকে। ফোনে নানা বার্তা আসে স্বজনদের। মেইল আসে। ফেসবুকে কত জল্পনা। এরপর কোথায় কখন সন্ত্রাসীরা হানা দেবে! রাস্তায় রাস্তায় পুলিশের ব্যারিকেড, টহল, জায়গায় জায়গায় সশস্ত্র পাহারা যেন প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দিচ্ছে এ এক ভিন্ন শহর, এক অচেনা ঢাকা। পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে করে তুলছে ‘দায়িত্বশীল’ কিছু লোকের দায়িত্বহীন কথা, আচরণ আর বক্তব্য। লাগামহীন মুখে আর কাজে তারা ‘দায়িত্ব’ নিয়েছেন মানুষকে কী করে আরো ভয়ে রাখা যায়! রাজউক, সিটি করপোরেশনসহ সরকারি নানা সংস্থা নেমে পড়েছে আবাসিক এলাকায় হোটেল রেস্তোরাঁ ব্যবসা বন্ধ করতে। বাহারি নামের নানা কমিটিও হচ্ছে একের পর এক। যেন জঙ্গি নয়, সব সমস্যার মূল এসব ‘অবৈধ’ ব্যবসা। বন্ধ করো এসব। তাহলে লোকজন আর ঘর থেকে বেরুবে না। বিদেশিরাও বাংলাদেশে আসবে না। আর তাতেই নিরাপত্তা হবে জোরদার, নিশ্চিত!’
তবে সবচেয়ে বড় কথা, সরকার দৃঢ় রয়েছে। জিরো টলারেন্স দেখাচ্ছে সন্ত্রাসের প্রতি। একই সঙ্গে বিদেশি রাষ্ট্রগুলোও বাড়িয়ে দিয়েছে সহযোগিতার হাত। প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলেছেন, ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে আপনি কখনো নিজেকে একা ভাববেন না, ভারতের পূর্ণ সমর্থন আপনার সঙ্গে আছে। এই যে লড়াই, তাতে ভারত আপনাকে সব ধরনের সহায়তা দিতে সব সময় প্রস্তুত।’ সবার সহযোগিতা আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে তাই আমাদের জেগে উঠতে হবে। অভয় বাজাতে হবে হৃদয়ের মাঝে।
লেখক : সাংবাদিক