অধর্ম ও কুকর্ম ছাড়তে হবে
রমজান আত্মশুদ্ধির মাস, রমজান সংযমের মাস। এই কথাগুলো প্রতিদিন এত জায়গায় এতবার নিয়ম করে বলা হচ্ছে, অনেকে শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। যেন এটি আর নতুন করে বলার কিছু নেই। কিন্তু বলার সাথে কাজের কোনো মিল দেখা যাচ্ছে না কোথাও। এক শ্রেণি আছেন, মানুষের উপকারের জন্য, ভালোর জন্য বারবার তাগাদা দিয়ে যাচ্ছেন। আরেক শ্রেণি আছেন যেন পণ করেছেন এসব তারা শুনবেনই না।
সিয়াম বা রোজা শব্দের অর্থ ‘বিরত থাকা’। রোজা সব ধরনের পাপাচার ও অপকর্ম থেকে বিরত থাকার শিক্ষা দেয়। রমজান ইবাদতের মাস। এই মাসেই রহমতের দরজা খুলে যায়। ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘রমজান মাসে যে একটি ভালো কাজ করবে সে যেন একটি ফরজ আদায়ের কাজ করল।’ এই মাস সব দিক থেকে ফজিলত ও বরকতের মাস বলে বর্ণনা করেছেন ইসলামী চিন্তাবিদরা। এদের অনেকের জীবনী পাঠ করলে দেখা যায়, কী কঠোর নিয়ম আর সংযমের মধ্য থেকে এরা রোজা রাখতেন এবং আল্লাহর ইবাদত বন্দেগিতে সময় কাটাতেন। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট যে একেবারে ভিন্ন হয়ে বসে আছে। ইফতার পার্টি তো আগেই ছিল, বেশ কয়েক বছর ধরে চালু হয়েছে সেহেরি পার্টি। এসব পার্টিতে দেখা যাচ্ছে, রোজা রাখার নিয়তের চেয়ে আড়ম্বর অনেক বেশি। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে এটা যেন একটা উৎসবে পরিণত হয়েছে। কোথায় কোন খাওয়ার ভালো পাওয়া যায় সেটা জেনে নিয়ে মধ্যরাতে হৈ-হুল্লোড় করে সেখানে গিয়ে খাওয়াটা খুব একটা শোভন বলে আমার মনে হয় না।
ইফতার পার্টির যে বিষয়টি সবচেয়ে খারাপ লাগে সেটা হলো অপচয়। বড়বড় হোটেল ও রেস্টুরেন্টগুলোতে দেখা যায়, প্রচুর পরিমাণ খাবারের আয়োজন করা হয় অতিথিদের জন্য। পরে এগুলোর অধিকাংশ অপচয় হয়। সারাদিন না খেয়ে থেকে একসাথে অনেকগুলো খাবার যেমন খাওয়া যায় না, তেমনি সেটি স্বাস্থ্যসম্মতও নয়। তেমন কয়েক জায়গায় আমি প্রস্তাব রেখেছিলাম খাবারগুলো যাতে গরীব-ক্ষুধার্তদের দিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তাদের ‘প্রেস্টিজ’ বলে কথা। ঢাকার বড় বড় ইফতার দোকানগুলোতে দেখা যায়, রমজানের ইফতার বিক্রির জন্য সকাল থেকে তোড়জোড় শুরু হয়ে যায় আর কেনার জন্য দীর্ঘ লাইন। সে কারণে মনে হয় রোজা রাখাটাই মুখ্য নয়, খাবারটাই যেন মুখ্য।
রাজধানীর চকবাজারের ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ নামে খাবারটি প্রতিবছর আলোচনায় আসে। কিন্তু অস্বাস্থ্যকর, নোংরা পরিবেশে যেভাবে খাবারটি তৈরি হয়, তা খেলে যে কারো স্বাস্থ্যের অবস্থা যে ভয়াবহ হবে তাতে সন্দেহ নেই। এ নিয়ে সম্প্রতি মিডিয়াগুলো বেশ সরব হয়েছে। কয়েকটি গণমাধ্যম সংবাদও প্রচার করেছে যে, যতটা আগ্রহ নিয়ে আমরা সেটি কিনতে বা খেতে যাচ্ছি, মানের দিক থেকে সেটি মোটেই আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত না। এ ছাড়া রমজান এলেই আমাদের দেশে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে। যারা বিদেশের গল্প বলেন বা এখন অন্তর্জালের বদৌলতে যেটা জানা যায়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে উৎসবের দিনগুলোতে নিত্যপণ্যের দাম কমে। বিভিন্ন ছাড় দেওয়া হয়, আর আমাদের দেশে উল্টো।
খাদ্যের পরে এবার বস্ত্র নিয়ে আলোচনা। ঈদের দিনে নতুন জামা-কাপড় পরবে এটাই স্বাভাবিক। কার না ভালো লাগে নতুন জামাতে, রঙিন কোর্তায় নিজেকে রাঙাতে। সেখানেও দেখা যাচ্ছে আড়ম্বরের শেষ নেই। যাদের অঢেল বিত্ত তাদের কাছে তো স্বদেশ থেকে প্রিয় বিদেশ। ঈদের শপিং করতেই অনেকে ছুটে যাচ্ছেন সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক বা নিদেনপক্ষে ভারত। যারা ঠিক বিদেশ যেতে পারছেন না তাদের জন্য দেশেই কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করছে কার্নিভালের। বিদেশি পোশাকের সমারোহ সেখানে। আর দেশের বাজারও সরগরম। টিভিতে দেখানো ঈদ শপিং এ দামের বহর দেখলে মাথায় হাত উঠে কারো কারো। সেদিন দেখলাম একটা টিভিতে দেখাচ্ছে, এক মার্কেটের শপিং চিত্র, যেখানে ১৫ হাজার টাকা দামের নিচে কোনো জামা-কাপড় নেই। আবার প্রচুর লোক সেই মার্কেটে কেনাকাটা করছে।
এক শ্রেণির মানুষের এত এত টাকা! এই দেখে একজন স্কুল শিক্ষিকার মন্তব্য ছিল এমন, ‘এগুলো টিভিতে দেখলে তো সাধারণ মানুষের মন খারাপ হয়। তা ছাড়া বাচ্চারা আবদার করতে পারে। সে ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত বাবা-মায়ের পক্ষে তো কিনে দেওয়া সম্ভব না।’ রমজান শিক্ষা দেয়, গরিব অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে। হুম! দাঁড়াচ্ছে তো। এখন দোকানে দোকানে যাকাতের কাপড় নামে এক রকম কাপড় বিক্রি হয় যেগুলো দামে সস্তা, অনেক সময় একবারের বেশি পরা যায় না। এসব কাপড়ই অনেক বড়লোক কিনে নেন গরিবদের দেওয়ার জন্য। কী প্রেম! পোশাক কেনাকাটার এই বাজারেও রয়েছে দামের বাড়ানোর উৎসব। অনেককে এমনও বলতে শোনা যায়, ‘মার্কেটে বিক্রি বলতে তো এই একমাস। এগারো মাসতো এই আয় দিয়েই চলতে হবে।’
মানুষ যেহেতু মার্কেটমুখী তাই বেড়েছে যানজট। সবাই দৌড়াচ্ছে, কিন্তু পায়ে নয় গাড়িতে। ফলে দীর্ঘ যানজটে নাকাল হতে হচ্ছে নগরবাসীকে। ঢাকা শহরে এখন এমন হয়ে গেছে একটা নির্দিষ্ট সময়ে বের হওয়াই মুশকিল। ঈদ যত ঘনিয়ে আসছে এই সমস্যা বাড়ছে। কিছুদিন আগে গুলিস্তানের ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদ করা হলো। এই নিয়ে সংঘর্ষ। ফুটপাতে হকার যানজট বা জনজট সৃষ্টির কারণ হলেও এই সময়ে উচ্ছেদ হওয়ায় নিন্দুকেরা নানা কথা বলছেন। সবচেয়ে বড় কথা উচ্ছেদ হওয়ার পর তারা আবারো বসছেন কেমন করে? নিন্দুকেরা বলছেন, এখানেও নাকি বাণিজ্য রয়েছে। এলাকার নেতাদের বাণিজ্য, পুলিশের বাণিজ্য।
কয়েকটি গণমাধ্যমের রিপোর্টে দেখলাম, ঈদ আসছে তাই পুরনো লক্কর-ঝক্কর মার্কা গাড়িগুলোকে নতুন করে সাজানো হচ্ছে। কোথাও কোথাও পাল্টানো হচ্ছে খোল-নলচে। এতে করে শঙ্কা বাড়ছে দুর্ঘটনার। প্রতিবছর এমনিতে ঈদে বাড়ি ফেরার বিড়ম্বনা আর দুর্ঘটনার খবরতো থাকেই। পুরনো গাড়ি মেরামত সেই শঙ্কা আরো বাড়িয়ে দেয়।
সবশেষ যে কথাটি বলতে চাই, ঈদ বা রমজানকে কেন্দ্র করে এক শ্রেণির অসাধু লোকজন তৎপর হয়ে উঠে, পকেটমার, মলমপার্টি, ছিনতাইকারী এবং টাকা জালিয়াত চক্র নানাভাবে প্রতারিত করে। সম্প্রতি এমন কয়েকটি চক্রকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী পাকড়াও করেছে। কিন্তু এভাবে আর কত দিন? যে রমজান পাপাচার আর অপকর্ম থেকে বিরত থাকার শিক্ষা দেয়, সেই শিক্ষাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আমরা উল্টো সব ধরনের অপকর্মে লিপ্ত হয়ে উঠেছি। অধর্ম, কুকর্ম ছাড়ার জন্য সাধুরা যে বচন দিয়ে গেছেন তা যেন কিতাবেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে।
লেখক : সাংবাদিক