মে দিবস
সংকট আছে, কাটাতে হবে
মে দিবস উদযাপনের উপলব্ধিতে নানা পরিবর্তন আছে। রুশ বিপ্লবের (১৯১৭) আগের উপলব্ধি ও পরের উপলব্ধি এক নয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলোপের (১৯৯১) আগের উপলব্ধি ও পরের উপলব্ধিও এক নয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলোপের পর রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থার আদর্শ কী হওয়া উচিত, তা এখনো স্পষ্ট নয়। এ নিয়ে চিন্তার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতিও নেই। ধর্মেরও পুরাতন বিশ্বাসের পুনরুজ্জীবন ঘটেছে। রেনেসাঁর স্পিরিট অবলোকন করে ছয়শ বছর ধরে যেসব চিন্তা ও উপলব্ধি অবলম্বন করে মানবসভ্যতা বিকশিত হয়েছে, সেগুলো এখন আর সমাদৃত নয়। মানবজাতি এখন সভ্যতার গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে চলছে। এখন শ্রেণিসংগ্রাম ও শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্বের ধারণা নিয়ে এগোনোর উপায় নেই।
অত্যুন্নত নতুন প্রযুক্তি আর শ্রমশক্তির কল্যাণে উৎপাদন ও সম্পদ দ্রুতগতিতে বাড়ছে। কিন্তু নৈতিক চেতনা নিম্নগামী। প্রবলের প্রতাপ বাড়ছে, দুর্বলের মানবীয় মর্যাদা অস্বীকৃত হচ্ছে। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বাড়ছে। শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর বৈষম্য বাড়ছে। গণতন্ত্রকে গণবিরোধী রূপ দেওয়া হয়েছে। প্রায় সব রাষ্ট্রেই জুলুম-জবরদস্তির সংস্কৃতি কায়েম হয়েছে।
এই বাস্তবতায় শ্রমিকদের অধিকার, মর্যাদা ও আর্থিক প্রাপ্য অর্জনের জন্য আলাদাভাবে আন্দোলন করার প্রয়োজন ও সুযোগ আছে। তবে তা আগের তুলনায় অনেক সীমিত। এখনকার বাস্তবতায় শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্তের সম্মিলিত আন্দোলন দরকার। দরকার জাতিভিত্তিক আন্দোলন কর্মসূচির মধ্যে শ্রমিকদের, কৃষকদের ও মধ্যবিত্তদের আন্দোলনের কর্মসূচিকে অন্তর্ভুক্ত করে আন্দোলনকে কেবল অর্থনৈতিক আন্দোলনে সীমাবদ্ধ না রেখে বৃহত্তর রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ দেওয়া।
আগের মতো ট্রেড ইউনিয়ন দিয়েও শ্রমিকদের তেমন একটা কল্যাণ হচ্ছে না। ট্রেড ইউনিয়নের নেতারা মালিকের ও সরকারের দালাল হিসেবে কাজ করেন বলে আজকাল শোনা যায়। বাংলাদেশে দীর্ঘ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অনেক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে পোশাকশিল্পের শ্রমিকরা তাঁদের বেতন কিছুটা বাড়াতে পেরেছেন।
শ্রমিকদের অধিকার মর্যাদা ও পারিশ্রমিক বাড়িয়ে দিলে উৎপাদন বাড়বে—এ ব্যাপারটা মালিকরা বুঝতে চান না। তাঁরা সবচেয়ে কম দিয়ে সবচেয়ে বেশি আয় করতে চান।
শ্রমশক্তি, চিন্তাশক্তি আর প্রযুক্তির ওপরই সভ্যতার ভিত্তি। কিন্তু সভ্যতার মধ্যে মানবীয় সব ব্যাপারও আছে। প্রতিটি সভ্যতারই নৈতিক ভিত্তি আছে। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এই নৈতিক ভিত্তি ধ্বংস করে দিয়েছে। তাতে দেখা দিয়েছে সভ্যতার সংকট। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা দ্বারা সভ্যতার সংকট কাটানোর আয়োজন চলছিল; কিন্তু প্রতিযোগিতার পৃথিবীতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা টিকতে পারেনি। তার ফলে সভ্যতার সংকট ঘোরতর রূপ নিয়ে দেখা দিয়েছে। শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্তের জাতীয় ঐক্য ও জাতিভিত্তিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সংকট কাটাতে হবে। শ্রমিকরাই এতে সবচেয়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে পারে। শ্রমের মূল্য-মর্যাদা দিতে হবে।
বিশ্বব্যবস্থারও পরিবর্তন হটাতে হবে। বিশ্বায়ন তো সাম্রাজ্যবাদেরই উচ্চতর স্তর। জাতীয়তাবাদ ও এর সম্পূরক আন্তর্জাতিকবাদের ভিত্তিতে গড়ে তুলতে হবে আন্তর্জাতিক ফেডারেল বিশ্বসরকার।
সংকট আছে। সংকট কাটানো যাবে। কাটাতে হবে। শ্রমিকদের শ্রমের ওপরই মানবজাতির অস্তিত্ব ও সমৃদ্ধি। শ্রমিকদের এই ভূমিকার যথোচিত স্বীকৃতি দিতে হবে।
লেখক : সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।