ইউপি নির্বাচন
নির্বাচনী সংঘাত, দায় রাজনীতির
সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, কোনো ঘটনা ঘটলেই তার জন্য একপক্ষীয়ভাবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওপর দায় চাপানো হয়। কিন্তু ঘটনার কারণ না খুঁজে, প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন না করে একতরফাভাবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর দায় চাপানোর ফলাফল অত্যন্ত ভয়াবহ। পরিণামে প্রতিষ্ঠানটিকেই ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। প্রতিটি ঘটনার পেছনে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য সামাজিক কারণ জড়িত থাকতে পারে। কিন্তু সেগুলো নিয়ে কদাচিৎ আলোচনা হয়।
বেশ কিছু দিন ধরে নির্বাচনী সংঘাত নিয়ে মিডিয়া, সরকারি দল, বিরোধী দল (বিএনপি), সুশীল সমাজ ও রাজনীতি বিশ্লেষক একতরফাভাবে নির্বাচন কমিশনকে দায়ী করে যাচ্ছে। তাদের বক্তব্যের সার কথা হলো নির্বাচন কমিশন সংঘাত এড়াতে ব্যর্থ হয়েছে। সুতরাং এই দায় সম্পূর্ণ নির্বাচন কমিশনের। কিন্তু সত্যিই কি নির্বাচনী সংঘাতের জন্য নির্বাচন কমিশন দায়ী? নাকি সামগ্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এর জন্য দায়ী? শুধু নির্বাচনী সংঘাতই নয় সামগ্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিয়েও এককভাবে নির্বাচন কমিশনকে দায়ী করা হয়ে থাকে। কিন্তু নির্বাচন ব্যবস্থার ধ্বংসের পেছনে নির্বাচন কমিশনের চেয়ে যে এ দেশের ‘কুলষিত রাজনীতি’ বেশি দায়ী তা নিয়ে খুব কমই আলোচনা হয়।
বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন ও নির্বাচনী সংঘাত যেন মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। নির্বাচন হবে আর মানুষ মরবে না তা কি করে হয়! একজনকে ক্ষমতায় যেতে হলে তো অন্য কাউকে জীবন দিতেই হবে!
এটাই যেন নিয়ম হয়ে গেছে। এ যেন প্রাচীনকালের পৌরানিক কাহিনীর মানুষ বলি দেওয়ার মতো। রাজ্য টিকানোর জন্য, রাজত্ব টিকানোর জন্য তখন ধরে ধরে সাধারণ মানুষকে বলি দেওয়া হতো। এখনো তাই হচ্ছে। একটু ভিন্ন পন্থায়। ভিন্ন কায়দায়। গত কিছু দিন আগে হয়ে যাওয়া প্রথম ও দ্বিতীয় দফার ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের কথাই ধরা যাক। এই দুই দফায় নির্বাচনী সহিংসতায় ৩৩ জনের অধিক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। চাঁর হাজারেরও বেশি মানুষ বিভিন্নভাবে আক্রমণের শিকার হয়েছে। নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি বলেও বিভিন্ন নির্বাচনী পর্যবেক্ষক মতামত দিয়েছেন। আর এর দায় শতভাগ তুলে দেওয়া হচ্ছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনের ওপর। নির্বাচন কমিশন যে দায় নেই সেটা বলছি না। নির্বাচন কমিশনেরও দায় আছে।
শুধু নির্বাচনের ক্ষেত্রেই নয় সব প্রক্রিয়ায় ‘রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন’ এ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। আর এই ‘রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নে’র শুরু স্বাধীনতার পর থেকেই। যা দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশে নিম্ন মানের রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি করেছে। দলীয় সরকার কিংবা সামরিক সরকার যারাই ক্ষমতায় ছিল তারা সবাই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের ক্ষমতার স্বার্থেই ব্যবহার করেছে। প্রকৃতপক্ষে যে বা যারা ক্ষমতায় থাকে তাদের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে নির্বাচন কমিশন কতটা স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করবে।
দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কিংবা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন দলের ভিত্তিতে হওয়া কোনোটাই নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত না। এই সিদ্ধান্তগুলো চূড়ান্ত করে থাকে রাজনৈতিক ব্যক্তিরাই। নির্বাচন কমিশন কেবল সেই হুকুমগুলো তামিল করে। কাজেই সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়া কিংবা নির্বাচনী সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার দায়টা নির্বাচন কমিশনের চেয়ে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সাথে যারা জড়িত তাদের ঘাড়েই বেশি বর্তায়। শরীরের যে কোষ ক্যান্সার আক্রান্ত হয় সেই কোষের চিকিৎসা না করে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে যদি দৌড়-ঝাপ করা হয় তাহলে ক্যান্সার বাড়বে বৈ কোনো অংশে কমবে না। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কিংবা ইউপি নির্বাচন দলের ভিত্তিতে হওয়ার নিয়মকানুন যে সংসদে পাস হয়েছে সেই সংসদেরই উচিত নির্বাচন কমিশনকে উপযুক্ত স্বাধীনতা দেওয়া। নামমাত্র স্বাধীনতা দিয়ে গলায় দড়ি বেঁধে রেখে কোনো দিন প্রকৃত ফলাফল আসা করা যায় না।
দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে করতে রাজনীতিবিদ কিংবা রাজনৈতিক দলগুলো চেষ্টা চালিয়ে আসছে। কিন্তু বিভিন্ন পর্যায় থেকে বিশেষত রাজনীতি বিশ্লেষক, সুশীল সমাজ ও গবেষকদের পক্ষ থেকে নানাভাবে যুক্তি দিয়ে বুঝানো হয়েছে যে স্থানীয় নির্বাচন দলের ভিত্তিতে করলে কী নেতিবাচক ফল হবে। সম্প্রতি অনুষ্ঠেয় ইউপি নির্বাচন শুরুর আগেই আশংকা করা হচ্ছিল যে এই নির্বাচন জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক দলাদলি ঘরে ঘরে পৌঁছে দেবে। সংঘাত বাড়িয়ে দেবে কয়েকগুণ। যার প্রমাণ এখন সবার হাতে হাতে। পত্রিকা মারফত জানা যায় ২০১১ সালের ইউপি নির্বাচনে মোট নিহতের সংখ্যা ছিল চারজন। অথচ ছয় দফায় অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া নির্বাচনের প্রথম দুই দফায় নিহত হয়েছে ৩৩ জনেরও অধিক! দলীয় পরিচয়ে ইউপি নির্বাচন হওয়ার ফলাফল যে কত ভয়ানক তা এই দুই দফার নির্বাচনে ইতিমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে। দলের ভিত্তিতে স্থানীয় নির্বাচন হওয়ার আরো অনেক নেতিবাচক ফল আছে। ১. সৎ অথচ রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পর্কিত নয় এমন প্রার্থীর সংখ্যা কমে যাওয়া। ২. নির্দলীয় সমাজসেবীদের নির্বাচনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলা। ৩. স্থানীয় রাজনীতিতে কালো টাকা ও পেশি শক্তির ব্যবহার বেড়ে যাওয়া। ৪. সমাজে কম গ্রহণযোগ্য কালো টাকা ও পেশি শক্তির অধিকারী ব্যক্তিদের নির্বাচিত হওয়া। গ্রেসাম’স ল অনুযায়ী একটি কথা আছে ‘ব্যাড মানি ড্রাইভস গুড মানি আউট অব সারকুলেশন’। স্থানীয় পর্যায়ে দলীয় নির্বাচনের ফলে এই ফর্মুলায় ভালো মানুষরা ধীরে ধীরে নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। একই সাথে জনগণের ‘চয়েস’ করার সুযোগটাও কমে যাচ্ছে। ফলে যোগ্য লোক যেমন প্রার্থী হচ্ছে না তেমনি নির্বাচিতও হচ্ছে না। এর সবকিছুই চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দেখা গেছে। এসব ঘটনা নির্বাচনী সংঘাত আরো ঘনীভূত করে তোলে।
এখন প্রশ্ন হলো এসবের জন্য কি এককভাবে নির্বাচন কমিশন দায়ী? সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় না করে ঔষধ দিলে যেমন রোগী মরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে তেমনি নির্বাচনী ব্যবস্থার ভঙ্গুর অবস্থার প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন না করলে ভঙ্গুর নির্বাচনী ব্যবস্থাকে কোমায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে। সেই কোমা থেকে হয়তো নির্বাচনী ব্যবস্থা আর কোনোদিন কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারবে না। ফলে নির্বাচনী সহিংসতা কমানোর জন্য ক্ষমতাসীনসহ রাজনীতিবিদদের এমন সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে যেন তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত সবাই গণতান্ত্রিক আচরণ করে। নির্বাচনকালে নির্বাচন কমিশনের চাহিদা অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত সহায়তা দিতে হবে। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা থেকে শুরু করে নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত ক্ষমতাসীনদের সর্বোচ্চ নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হবে। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় জড়িত সব কর্তৃপক্ষকে সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। নির্বাচনী প্রক্রিয়া (তফসিল ঘোষণা থেকে ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত) চলাকালীন নির্বাচনী ব্যবস্থার সাথে জড়িতদের ওপর কোনো রকম ‘গায়েবি ওহি’ বা ‘গায়েবি নির্দেশনা’ দেওয়া থেকে ক্ষমতাসীনদের বিরত থাকতে হবে। স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থাকে স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের অবৈধ হস্তক্ষেপমুক্ত রেখে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। এগুলো সবই রাজনৈতিক সদিচ্ছার অংশ। যত দিন এগুলো নিশ্চিত করা না যাবে তত দিন যতই ‘উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে’ চাপানো হোক না কেন আখেরে ফলাফল হবে অশ্বডিম্ব। সুতরাং শুধু নির্বাচন কমিশনকে দায় দিয়ে, নির্বাচন কমিশনের ওপর সব বোঝা চাপিয়ে প্রকৃত দায়মুক্তি হবে না। জায়গা মতো ওষুধ দিলেই রোগমুক্তি সম্ভব। দায়টা নিতে হবে রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষকে। যারা ক্ষমতার চূড়ায় থেকে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে তাঁদের। কারণ তাঁরা যত দিন না চাইবেন তত দিন নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে না। আর সংঘাতমুক্ত অবাধ, স্বচ্ছ ও নিরপক্ষে নির্বাচন তত দিন বাক্সবন্দি হয়ে থাকবে।
লেখক : গবেষক ও শিক্ষক, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ