বিশ্লেষণ
সংকটকাল, যোগাযোগ ও আমাদের প্রশাসন
যোগাযোগের বিদ্যায়তনিক পরিমণ্ডলে একটি কথাই আছে, The worst distance between two people is misunderstanding, অর্থাৎ দুজন ব্যক্তির মধ্যে সবচেয়ে খারাপ দূরত্ব হচ্ছে ভুল বোঝাবুঝি। যখন দুজন ব্যক্তির মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়, তা দুজনের মধ্যে বিদ্যমান দূরত্বের সবচেয়ে নেতিবাচক দূরত্ব। দুজন ব্যক্তির মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির একটা বড় কারণ তথ্যের অভাব, একে অপরকে বুঝতে না পারা। আর এটি যখন প্রতিষ্ঠান বনাম জনগণ হয় তার প্রভাব তো আরো বেশি হওয়ারই কথা। কারণ প্রতিষ্ঠান তো একটিই, অন্যদিকে লাখো কোটি জনগণ।
কিন্তু কথাগুলো কেনই বা বলা? বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ রাষ্ট্রের নানা অংশ ঔপনিবেশিক কাঠামোতে নিজেদের গড়ে তুলেছে। ফলে যখন কোনো সংকট মুহূর্ত এসে হাজির হয়, তখন তথ্য নিয়ে তৈরি হয় ধোঁয়াশা। চেষ্টা করা হয় গোপনীয়তা রক্ষার। কয়েক দিন আগেই পত্রিকার খবর অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব থেকে টাকা লোপাট হয়ে কয়েক হাত ঘুরে তা চলে যায় ফিলিপাইনের জুয়ার আসরে। ফিলিপাইনের ডেইলি ইনকোয়ারার থেকে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো টাকা লোপাটের খবর প্রথম জানতে পারে। কিন্তু ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের কেউ তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানাননি। সেই সময়ে দায়িত্বরত বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় পদধারীকে সরে যেতে হয়েছে। কোনো কোনো গণমাধ্যমেও এমন খবর বের হয়েছে যে, আরো আগে যদি বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারকে জানিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিত, তাহলে লোপাট হওয়া একটি বড় অংশ ফেরত আনা যেত। কিন্তু যা হওয়ার তাই হয়েছে। কারণ জুয়ার আসর থেকে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়কারী দোকান (মানি এক্সচেঞ্জ) হয়ে সেই টাকা এখন হংকংয়ে আছে। আর ব্যাংকিং চ্যানেল থেকে যে টাকা বের হয়ে যায়, তা ফেরত আনা কষ্ট ও শ্রমসাধ্য।
কিন্তু বিষয়টি নিয়ে কুলুপ এঁটে ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক, খোদ অর্থমন্ত্রীও ছিলেন অন্ধকারে। সংকট সময়ে যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত ছিল দ্রুত সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহকে জানানো, সেখানে তথ্য গোপন করায় ঘটনাটি চলে যায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আবারও সেই সংকটকালীন যোগাযোগের বিষয়টি এখানে চলে আসে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গণসংযোগ দেখভালকারী শাখাকে ঠিক সময়ে কাজে লাগালে হয়তো সরকার-বাংলাদেশ ব্যাংক-জনগণের মধ্যকার ভুল বোঝাবুঝি এড়ানো যেত।
সংকট সময়ে কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়ে ব্যবসায়বিষয়ক ম্যাগাজিন হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউয়ের একটি সংখ্যা পড়ছিলাম। ম্যাগাজিনটির একটি বড় অংশ জুড়ে ছিল যুক্তরাষ্ট্রে ২০০১ সালে টুইন টাওয়ারে হামলার পরবর্তী সময়ে সংকটকালীন যোগাযোগ। পড়তে গিয়ে খানিকটা অবাকই হলাম। টুইন টাওয়ারে আক্রমণের ঠিক পরপরই নিউইয়র্কের মেয়র রুডি জুলিয়ানি মিনিট খানেকের মধ্যে ঘটনাস্থলে চলে আসেন। উদ্ধারকারী বাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তিনি উদ্ধারকাজে নেতৃত্ব দেন। স্বচ্ছতার জন্য তিনি একদিকে উদ্ধারকাজে তদারকি করেছেন, সঙ্গে অংশ নিয়েছেন ডজনেরও বেশি সংবাদ সম্মেলন ও শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে।
কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সংকটকালে কেমন আচরণ করে পক্ষগুলো? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দিয়ে শুরু করা যাক। তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা নিখোঁজ হওয়ার পর কোনো থানাই সাধারণ ডায়েরি নিতে চায়নি। ফলে জোহার নিখোঁজ হয়ে যাওয়া নিয়ে মানুষের মধ্যে সন্দেহ আরো বাড়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ লোপাট আর জোহা নিখোঁজ হয়ে যাওয়াকে মিশিয়ে চটকদার কাহিনী বিচরণ করতে থাকে ভার্চুয়াল জগতে। এখানে আর কিছু নয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সময়োচিত প্রতিক্রিয়া দেখালে মানুষের মধ্যে সন্দেহ তৈরি হতো না।
তানভীর হাসান জোহা নিয়ে যতটা দ্বিধা তৈরি হয়েছিল সাধারণের মধ্যে, তার চেয়ে অনেক বেশি দ্বিধা এখন তৈরি হয়েছে কুমিল্লার কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনু হত্যা নিয়ে। একটি সংবেদনশীল জায়গায় ঘটা হত্যাকাণ্ডটি শুরু থেকেই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভাইরাল হতে শুরু করে লাশ পাওয়ার পরদিন ২১ মার্চ থেকে। মানুষের ভার্চুয়াল মিথষ্ক্রিয়া আর রাজপথের বিক্ষোভের কারণে মানুষ ধরে নিতে শুরু করে কোনো পক্ষ কিছু লুকানোর চেষ্টা করছে। মানুষের মধ্যে তৈরি হয় দ্বিধা-অনিশ্চয়তা। সংকট সময়ে যত দ্রুত সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়, তত মঙ্গল।
কিন্তু সংকট সময়ের যোগাযোগে দক্ষতা নিয়ে পুলিশের দিকে তাকালে ততটা আশাবাদী হওয়া যায় না। কারণ পুলিশের প্রতিক্রিয়া সময়োচিত ছিল না। এরই মাঝে মেয়ের হত্যা নিয়ে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হয়েছে তনুর মা-বাবাকে। যেচে কিছু না বললেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশ ও র্যাব প্রধান সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে তনুকে নিয়ে কথা বলেছেন, জানিয়েছেন অপরাধী যেই হোক না তাকে বিচারের মুখোমুখি করার কথা। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ হয়ে ডিবির হাত ঘুরে মামলার হস্তান্তর করা হয়েছে সিআইডির কাছে। কিন্তু পুলিশের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিটি এসেছে ঘটনা ঘটার ১০ দিন পর ২৯ মার্চে। সংকট সময়ে যোগাযোগ যেখানে দ্রুত করার কথা সেখানে দশদিন পর আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞপ্তি দেওয়া পুলিশেরই দ্বিধা-যোগাযোগ ব্যর্থতাকে আরো স্পষ্ট করে তোলে।
তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। পুলিশের পাঠ্যক্রমে যোগাযোগ বিষয়টি আছে কি না তা জানতে ৩৩তম বিসিএস পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপারদের পুলিশ একাডেমির পাঠ্যক্রম নেড়েচেড়ে দেখলাম। দেখলাম আইনের পর্যাপ্ত কোর্স থাকলেও মানবিক যোগাযোগ নিয়ে কোনো কোর্সই নেই। যেখানে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইতে মানবিক যোগাযোগকে তাদের প্রশিক্ষণে গুরুত্ব দিচ্ছে, যেখানে বাংলাদেশ পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপারদের পাঠ্যক্রমে আনুষ্ঠানিকভাবে মানবিক যোগাযোগ বিষয়টি না থাকায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুলিশের অবস্থান মানুষের মধ্যে দ্বিধা তৈরি করে। ভাবায় পুলিশ আসলেই জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন কি না।
ব্রিটিশ আমলের ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন, ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি ও ১৯৪৩ সালের পুলিশ রেগুলেশনস অব বেঙ্গল দিয়ে। সিপাহী বিদ্রোহের পরিপ্রেক্ষিতে রচিত পুলিশ আইনের মাধ্যমে পুলিশকে সার্ভিস বা সেবা হিসেবে না রেখে তৈরি করা হয়েছে পুলিশ ফোর্স বা বাহিনী হিসেবে। ১৫৫ বছর আগের সেই আইন আঁকড়ে ধরে রাখা পুলিশের কাছে মানবিক যোগাযোগ কিংবা সংকট মুহূর্তে আরো বেশি উদার হওয়া আরো অসম্ভব একটি বিষয়। পুলিশের পরিবর্তনের জন্য যত প্রকল্প নেওয়া হোক না কেন অথবা যত সাফল্যই আসুক না কেন, সংকট সময়ে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগে ব্যর্থতা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে পুলিশকে আরো দূরে সরিয়ে নিচ্ছে। এই ভুল বোঝাবুঝির কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই যুগে ফেসবুকে ইভেন্টের মাধ্যমে বড় আন্দোলন হলে, ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের সুযোগ নেবে তৃতীয় কোনো পক্ষ।
লেখক : শিক্ষক, অপরাধবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।