জাগো বাহে
মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কতটুকু জানি?
রক্তপ্লাবিত একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই স্বচ্ছ ধারণা নেই। রাষ্ট্র যদি জনগণের কাছে যুদ্ধের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে ধারণা দিতে সমর্থ হতো, তাহলে দেশে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে কথা বলার কাউকে পাওয়া যেত বলে মনে হয় না। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কতজনের কত যে অস্পষ্ট ধারণা রয়েছে, তা যদি আমরা আমাদের চারপাশে পরিচিত-অপরিচিতজনদের জিজ্ঞাসা করি, তাহলেই প্রকৃত অবস্থা জানা সম্ভব।
কয়েক দিন আগে লালমনিরহাট জেলার বড়বাড়ী এলাকার প্রায় ষাটোর্ধ্ব রিয়াজুলের কাছে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, যুদ্ধ সম্পর্কে কিছু জানেন কি না। তিনি জানালেন, যুদ্ধ দেখেছেন। যুদ্ধে তাঁর দাদা মারাও গেছেন। শহীদ মুখতার ইলাহীর মৃত্যু দেখেছেন। যখন জিজ্ঞাসা করলাম, যুদ্ধ কেন হয়েছে? তখন তিনি বললেন, সেটা আমি জানি না। রংপুর শহরের উপকণ্ঠে চিনিয়াপাড়া গ্রাম। সেখানকার ষাটোর্ধ্ব শহিদুলের সঙ্গে কথা হলো মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। তিনি জানালেন, একদিন তাঁরা বিয়ের নিমন্ত্রণ খেতে মিঠাপুকুর গেছেন এমন সময়ে যুদ্ধ শুরু হয়। তিন দিন কোনোরকম চিড়া-মুড়ি খেয়ে তাঁরা আখের ক্ষেতে পালিয়ে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর জ্যাঠা মারা গেছেন। জিজ্ঞাসা করলাম, যুদ্ধের কারণ কী ছিল। তিনি বললেন, ‘বাংলা ভাষা বাদ দিয়া উর্দুতে কথা কবার কয়, এ জন্যে যুদ্ধ হইচে।’ যুদ্ধের ফল সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণা নেই।
ষাটোর্ধ্ব দুজনেরই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই বললেই চলে। মনে হতে পারে, অশিক্ষিত জন্যই হয়তো তাঁরা এসব জানেন না। সৈয়দপুর শহরে দেখতে বেশ স্মার্ট কলেজপড়ুয়া দুজন ছাত্রের সঙ্গে কথা হলো মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। হৃদয় নামের তাঁদের একজন বললেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আমার কোনো নলেজ নেই।’ অন্যজনেরও মন্তব্য অনুরূপ। টিভিতে তাঁরা কোনো অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কিছু শুনেছে কি না জানতে চাইলে তাঁদের ভাষ্য হচ্ছে, তাঁরা টিভিতে এসব দেখেন না।
আমরা একাত্তরের চেতনা কোনো প্রজন্মের মধ্যেই যথাযথভাবে ছড়িয়ে দিতে পারিনি। আর পারিনি বলেই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধ কোটায় ভর্তি পরীক্ষার সাক্ষাৎকারে কোনো কোনো শিক্ষার্থী কুখ্যাত রাজাকার কাদের মোল্লা সম্পর্কে বলেছিল, তাঁকে ফাঁসি দেওয়া ঠিক হয়নি। মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানের মধ্যেও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে রয়েছে বিভ্রান্তি।
রংপুরে জাতীয় তথ্যপ্রযুক্তি বিতর্ক উৎসবে গিয়েছিলাম মডারেটর হিসেবে। সেখানে কলেজপড়ুয়া একজন বিতার্কিক প্রযুক্তির সুবিধা বর্ণনা করতে গিয়ে সাঈদীকে চাঁদে দেখা যাওয়ার খবর মোবাইলে পাওয়ার কথা বলে। বিতর্কে সে এ কথাও বলছে, সে সাঈদীকে চাঁদে দেখেছে। কলেজপড়ুয়া একজন শিক্ষার্থী যখন এরূপ কুসংস্কারকে ধারণ করে, তখন আমাদের ভাবতে হবে শিক্ষার্থীদের চেতনা বিনির্মাণে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কতটুকু ভূমিকা রাখছে।
একবার পঞ্চম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী ফাতেমা মজুমদার তুলি আমার কাছে দুই রকম বাংলা বই নিয়ে এসেছিল। বর্তমানে সে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী। মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা বর্ণনায় একটিতে আলবদর-রাজাকার-আলশামসদের কথা বলা আছে, অন্যটিতে নেই। কোন বইটি ঠিক, সে এই কথা আমার কাছে জানতে চেয়েছিল। এ দুটি বইয়ের প্রথমটি আওয়ামী লীগের সময়ের সংস্করণ, অন্যটি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ের সংস্করণ। মুক্তিযুদ্ধের বিভ্রান্তি এভাবেই ছড়িয়ে পড়েছে গোটা জাতির মধ্যে। আমরা যদি ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ইতিহাস শিক্ষার্থীদের ভালোভাবে শেখাতে পারি, বোঝাতে পারি, তাহলে তারা কোনো দিন যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নেবে না।
মাল্টিন্যাশনাল সংস্থার সহায়তায় স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান এখন অনেকটাই বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। গণমাধ্যমের আধিক্যে মুক্তিযুদ্ধের মিডিয়াভিত্তিক প্রচারণা বেড়েছে। কিন্তু আমরা গণমানুষের কাছে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি আগ্রহের জায়গায় পরিণত করতে পারিনি। সে কারণে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অনুষ্ঠানে গণমানুষের আকর্ষণটা অনেক কম। এখনকার দিনে ফেসবুকের সুবাদে বিশেষ দিনগুলোতে নতুন প্রজন্ম হয়তো একটি স্ট্যাটাস দেয় কিংবা জাতীয় পতাকার ছবি প্রোফাইল পিকচার করে। তাদের চেতনা এর চেয়ে অধিক কিছু নয়। অথচ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মধ্যে আমাদের সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক মুক্তির বীজ রোপিত আছে। আমাদের পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে সামান্য অংশ আছে, আমাদের শিক্ষকরা তার কতটুকু শেখান তা-ও প্রশ্নসাপেক্ষ। পাঠ্যপুস্তকও এখন নম্বরপ্রাপ্তিনির্ভর। জিপিএ ৫ জাতি গঠনই সেখানে লক্ষ্য।
আমরা প্রতিবছর জাতীয় দিবসগুলো শহরে শহরে উদযাপন করি। ঘুরেফিরে নির্দিষ্ট কিছু লোকই আলোচক এবং শ্রোতা। আমরা গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে চেতনার বাণী নিয়ে যাই না। ফলে দিনের পর দিন তাঁরা অন্ধই থেকে যান। সে জন্য আমাদের উচিত প্রতিবছর জাতীয় দিবসগুলোতে গ্রামে গ্রামে গিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে কাজ করা। শুধু বিশেষ দিবসগুলো নয়, সব সময়েই সাধারণদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরা প্রয়োজন।
সন্তানদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলার ক্ষেত্রে অভিভাবকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা প্রয়োজন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমাদের অনেক অভিভাবকই মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখেন না। যে এলাকায় যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেগুলোর আলোচনা করা, দলবেঁধে বধ্যভূমি দেখতে যাওয়া, টর্চার সেলগুলোতে যাওয়া, যুদ্ধাহতদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়াসহ মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গগুলো প্রচার করা জরুরি।
জনগণের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে আগ্রহী করে তুলতে হবে। রংপুরের বদরগঞ্জের লোকজন অনেকেই জানেন না, তাদের উপজেলার ঝাড়ুয়ার বিলে এক বিকেলে কীভাবে পাকিস্তানিরা প্রায় দেড় হাজার লোককে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করেছে। উলিপুরের লোকজন জানেন না, হাতিয়ায় একদিনে ৬৯৭ জন লোককে কীভাবে মেরে ফেলেছে পাকিস্তানিরা। রংপুরের লোকজন অনেকেই জানেন না, শহীদ স্মৃতি হলে কত নারীকে নির্যাতন করা হয়েছে, পার্শ্ববর্তী কুয়ায় কতজনের লাশ ফেলা হয়েছে। কারমাইকেল কলেজের অনেক শিক্ষার্থীই জানেন না, তাঁদের কলেজের কয়েকজন শিক্ষককে দমদমা সেতুর পাশে হত্যা করেছে।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত অস্ত্রনির্ভর শাসকের হাতে ছিল দেশ। এ সময়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক চর্চা অনেকটাই বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। এ রকম বিভিন্ন প্রতিকূলতা থাকলেও এখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিই ক্ষমতায় রয়েছে। তার পরও গণমানুষের চেতনা সৃষ্টিতে তারা খুব বেশি ভূমিকা রাখতে পারছে না। মুক্তিযুদ্ধকে স্বার্থসিদ্ধির জন্য বুলিসর্বস্ব না করে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।