দৃষ্টিপাত
ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে, সমাজ নির্বিকার
সম্প্রতি আমি বেশ আশঙ্কা-সহকারে লক্ষ করছি, কিছু কিছু বিষয়ে আমাদের নাগরিক অনুভূতি এবং মানবিক অনুভূতি বেশ ভয়ানকভাবে লোপ পেয়েছে। আজ থেকে এক দশক কিংবা দুই দশক আগে যে সব বিষয়কে সমাজের চোখে একটা ‘বিরাট’ বা ‘জঘন্য’ ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা হতো, সেটা এখন অনেকটা ‘গড়পড়তা ব্যাপার’ কিংবা ‘মামুলি বিষয়ে’পরিণত হয়েছে বা পরিণত করে ফেলা হয়েছে।
এটাকে সমাজের ‘বেহায়া উন্নতি’ নাকি ‘লজ্জাজনক অবনতি’ হিসেবে দেখা হবে সেটাও নির্ভর করছে বিগত দুই/আড়াই দশকে আমার সামাজিক মনস্তত্ত্ব কীভাবে তৈরি হয়েছে এবং মানুষের মনোজগতের নৈতিক অনুভূতির ধারণা কীভাবে রূপান্তরিত হয়েছে তার ওপর। সময় ও সমাজের বিকাশে সূত্র ধরে নানামুখী পরিবর্তনের হাত ধরে সমাজের পরিবর্তন ঘটবে এবং সমাজের পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি এবং নানান সামাজিক বিষয়ে মানুষের মানবিক মূল্যবোধেরও পরিবর্তন ঘটবে... সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু যেসব ঘটনা সমাজের অস্তিত্ব ও স্থায়িত্বকে প্রশ্নের মুখের ঠেলে দেয়, মানুষের মানবিক মর্যাদার জায়গাটায় আঘাত করে এবং মানুষের আত্মমর্যাদার জায়গাটা নষ্ট করে দেয়, সেসব ঘটনা নিয়ে যখন আমাদের সামাজিক এবং মানবিক উদাসীনতা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়তে থাকে, তখন বুঝতে হবে আমরা ব্যক্তিক পর্যায়ে হয়তো আগাচ্ছি কিন্তু সামাজিকভাবে ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে পড়ছি; আমরা অবকাঠামোগত ভাবে হয়তো আগাচ্ছি কিন্তু মানবিকতার জায়গায় ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে পড়ছি; হয়তো আমার অর্থনৈতিকভাবে আগাচ্ছি ঠিকই কিন্তু নৈতিকভাবে বেশ পিছিয়ে পড়ছি। এ বিষয়গুলো বারবার মাথায় হানা দিচ্ছে যখন দেখছি বাংলাদেশ জুড়ে, নানা প্রান্তে দীর্ঘদিনধরে একের পর এক জঘন্য ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে, কিন্তু সমাজের মধ্যে এ-নিয়ে তীব্র কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।
গোটা দেশ হয়ে উঠছে ধর্ষণের উপত্যকা অথচ সমাজের মানুষের মধ্যে এ নিয়ে কোনো বিকার নেই। সবাই বেমালুম নির্বিকার। চলন্ত বাসে ধর্ষণ, দলবেঁধে ধর্ষণ, মাদ্রাসার পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী ধর্ষণ, কাজের মেয়েকে ধর্ষণ করে ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া, মা-মেয়েকে এক সাথে ধর্ষণ, ঢাকায় চলন্ত বাসে আদিবাসী নারী ধর্ষিত, গার্মেন্টের কর্মী ধর্ষণ, প্রেমিক ও তার বন্ধু কর্তৃক প্রেমিকাকে ধর্ষণ, শশুরবাড়িতে বেড়াতে এসে নববধূ ধর্ষিত... এ রকম অসংখ্য ধর্ষণের ঘটনা আমরা সংবাদপত্রে এবং ইলেকট্রিনক মিডিয়ায় হরহামেশা দেখে থাকি। কিন্তু এসব ঘটনা আমাদের মধ্যে এখন আর কোনো ধরনের ক্ষোভ বা তীব্র আবদেন তৈরি করে না।
আমাদের মানবিক অনুভূতিতে কোনোভাবেই কোনো ধরনের সংবেদনশীলতা তৈরি করে না। এটা মোটামুটি বলা যায় যে, সমাজের বিদ্যমান প্রেট্রিয়ার্কি এসব ধর্ষণের ঘটনাকে মামুলি ব্যাপার বানিয়ে ফেলেছে। সমাজে নারীর অবস্থান কোথায় এটা উপলব্ধির জন্য এসব ধর্ষণের ঘটনা এবং আমাদের মানবিক ও সামাজিক সেনিসিটিভিটির বিষয়কে একসাথে সংযুক্ত করে বিবেচনা করতে হবে।
অবশ্য নগরকেন্দ্রিক বিশেষ করে ঢাকা এবং চট্টগ্রামে নারীর অবস্থান উন্নয়ন প্রজেকশন-বিষয়ক কিছু মৌসুমি নড়াচড়া চোখে পড়ে। কেননা নারী নির্যাতন, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা, যৌনহয়রানি, নারীর অধঃস্থনতা প্রভৃতি বিষয়াদি পারিবারিক, সামাজিক এবং জাতীয় পরিসরে ইদানীং বেশ জোরালোভাবে আলোচিত হচ্ছে। তবে, ক্রমবর্ধমান ধর্ষণের ঘটনা নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর সক্ষমতা বৃদ্ধি, নারীর সমানাধিকার, নারীর পেশাগত উন্নয়ন, নারী শিক্ষার প্রসার প্রভৃতি সামাজিক ও রাজনৈতিক ডিসকোর্সকে আবারও নতুন করে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। কেননা সাময়িক বিরতি দিয়ে দিয়ে কিছু কিছু ঘটনা আমাদের সামনে এমনভাবে হাজির হয় যা আমাদের নারী উন্নয়নকেন্দ্রিক তৃপ্তির ঢেঁকুরের ভেতরে বাস্তবতার কাঁটা ঢুকিয়ে দিয়ে নতুন করে জানান দেয় আমাদের সমাজে নারীর অবস্থান কোথায়।
বাংলা ১৪২২ সালের ‘পহেলা বৈশাখ’ উদযাপনের সময় সংঘটিত নারী নির্যাতনের ঘটনা আমাদের তেমনি একটি বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এ ধরনের ঘটনা যখন ঘটে আমরা সবাই মিলে হঠাৎ করে বেশ উত্তপ্ত এবং উত্তেজিত হয়ে উঠি। গোটা সমাজ তখন ‘মৌসুমী উত্তেজনায়’ ভোগে! মিডিয়া বেশ গরম-গরম খবর জোগান দেয়; আর ভোক্তা হিসেবে আমরা সেসব ফলোআপ বেসুমার গিলে থাকি। টেলিভিশনের টকশোগুলো তখন বেশ জমজমাট হয়ে হয়ে উঠে। আমরা শহুরে শিক্ষিত নাগরিক মধ্যবিত্ত মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশের রিচ্যুয়াল পালন করি। প্রেসক্লাস, শাহবাগ কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ যুৎসই নিউজ-আইটেম হয়ে উঠে।
আমাদের এ নাগরিক উত্তেজনা সৃষ্টির পেছনেও রয়েছে শ্রেণি চরিত্র। কেননা ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে, বৈশাখী মেলার এলিট পরিসরে এবং রমনা বটমূল-কেন্দ্রিক বৈশাখী মেলার নাগরিক মধ্যবিত্তের উৎসবের আমেজে। কিন্তু যখন গার্মেন্টের শ্রমিক ধর্ষিত হয়, বা কোনো আদিবাসী নারী ধর্ষিত হয় কিংবা গ্রামের কোনো হতদরিদ্র নারী যখন ধর্ষিত হয়, তখন আমাদের নাগরিক মধ্যবিত্তের কাছে সেটা তেমন কোনো আবেদন তৈরি করে না ধর্ষিত নারীর শ্রেণি চরিত্রের কারণে কিংবা নগর বনাম গ্রামের শ্রেণি-বিভাজনের কারণে। ফলে, ধর্ষণের ঘটনা এখন সামাজিক ন্যায্যতা পাওয়ার পথে! কারণ, আমরা নাগরিক মধ্যবিত্তরা প্রাত্যহিক জীবনে সবাই রুটি-রোজগারে ব্যস্ত হয়ে থাকি।
দুই পয়সা কীভাবে বাড়তি (সৎ বা অসৎ পথে!) আয় করা যায় সে চিন্তায় দিন যায়, গ্রামের দুজন নারী ধর্ষিত হয়, এতে কী এমন আসে যায়! এ কারণেই বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সংবাদপত্রের হিসাব অনুযায়ী বিগত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ৯৩ হাজার ৬৮৬টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। কেবল ২০১৪ সালে সংঘটিত হয়েছে ৪৬৬৫টি নারী নির্যাতনে ঘটনা। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৪ সালে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৬৬৬টি। আর ২০১৫ সালে নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়ে প্রায় ১০৬৯ জন যা ২০১৪ সালের তুলনায় ৩৫% বেশি।
ধর্ষণের ঘটনা যে হারে ক্রমবর্ধমান তাতে ২০১৬ সালের হিসাবে যদি দেখা যায় ২০১৫ সালের তুলায় ৫০% বেশি, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। ইতিমধ্যে সে আলামত দেখা যাচ্ছে। তাই, নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে রাজধানীর কোনো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে মিনারেল-ওয়াটারে গলা ভিজিয়ে আমরা যতই সেমিনার সিম্পোজিয়াম করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলি না কেন, বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় নারীর অবস্থানের এখন পর্যন্ত তেমন একটা ইতিবাচক-গুণগত পরিবর্তন হয়নি। প্রতিদিনের অসংখ্য ধর্ষণের ঘটনা আমাদের সেই ইঙ্গিতই দেয়। তা ছাড়া, এসব পরিসংখ্যান সংবাদপত্রে ছাপানো ঘটনার হিসাব অনুযায়ী কিন্তু মিডিয়ার ফোকাসের বাইরে এ রকম কত ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে তার কোনো হিসাব-নিকাশ নেই। সে হিসাবকে বিবেচনায় নিলে সমাজে নারীর অবস্থান কোথায় সেটা সহজেই অনুমেয়।
এটা অপ্রিয় হলেও সত্য যে, আমাদের সমাজের পুরুষদের একটা বড় অংশ এখনো নারীকে যৌন-লালসা মেটানোর যন্ত্র হিসেবে বিবেচনা করে। তাই, আমরা যতই আধুনিকতা, শিক্ষা এবং সভ্যতার মেকি চাঁদরে নিজেদের ঢেঁকে রাখার চেষ্টা করি না কেন, সমাজের আসল চেহারা এ অবিরাম ধর্ষণের ঘটনার ভেতর দিয়ে এভাবেই আমাদের সামনে হাজির হয়। আজ থেকে প্রায় দেড় দশক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরেই প্রায় একই কায়দায় বাঁধনের বস্ত্র হরণ করা হয়েছিল। তার কোনো বিচার আমরা দেখিনি। বরঞ্চ বাঁধনের অর্ধনগ্ন ছবি দেখে দেখে আমাদের অনেকেই ভেতরে ভেতরে গোপনে গোপনে ইরোটিক সুখ অনুভব করেছি!
কাজেই ক্রমবর্ধমান ধর্ষণের ঘটনাই প্রমাণ করে আমরা এখনো মানুষ হয়ে উঠতে পারি নাই। আমরা এখনো এতটুকু উপলব্ধি করতে শিখি নাই যে, যে নারী লাঞ্ছিত হয়েছে, সে আমাদেরই কারো বোন, কারো মেয়ে কিংবা কারো বন্ধু। যে সমাজের মানুষ মা, বোন, মেয়ে কিংবা বন্ধুর সম্ভ্রম রক্ষা করতে জানে না, ধর্ষণ করে বিকৃত সুখ পায়, সে সমাজ কোনোভাবেই সভ্য সমাজ হতে পারে না। এ রকম ক্রমবর্ধমান ধর্ষণের ঘটনাই প্রমাণ করে যে, আমাদের সভ্যতা-শিক্ষাদীক্ষা-সুশীল আস্তিনের তলে তলে আসলে বাস করে এক অসভ্য-কুৎসিত সমাজের অস্তিত্ব।
আমরা নারীর এগিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে নানাভাবে প্রজেক্ট করার চেষ্টা করি। যেমন, নারী শিক্ষার হার বেড়েছে, জিপিএ ৫-এর ভাগাভাগিতে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরা সমানতালে ভাগ বসাচ্ছে; চাকরিজীবী হিসেবে নারীর সংখ্যা বেড়েছে; পেশাজীবী হিসেবে নারী এগিয়ে আসছে; নারী এভারেস্ট জয় করেছে; এতে রাজধানীকেন্দ্রিক নারীর দৃশ্যমানতা বেড়েছে। মিডিয়ার কল্যাণে (কিংবা অকল্যাণে!) নারীর উপযোগিতা (নাকি ব্যবহার!) বেড়েছে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। কিন্তু নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেছে এ কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না। বলা যাবে না বলেই, চলন্ত বাসে ধর্ষিত হয় নারী। মা-মেয়ে একসাথে ধর্ষিত হওয়ার ঘটনা ঘটে। কিংবা সমাজে দলবেঁধে ধর্ষণের ঘটনা ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাচ্ছে।
তবে এখানে সমাজ এবং সমাজের মানুষকে কাঠগড়ায় দাঁড় করনোর পাশাপাশি রাষ্ট্রকেও সমান কাতারে দাঁড় করাতে হবে। কেননা, রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে মানুষের জান-মাল-ইজ্জতের হেফাজত করা ও যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব মূলত রাষ্ট্রের। সমাজে নারীর ইজ্জত, সম্মান এবং মর্যাদার জায়গা সুরক্ষিত করতে হলে, সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি যেমন পাল্টাতে হবে, মানুষের মানবিক সেনসিটিভিটির জায়গাটা যেমন অধিকতর সংবেদনশীল করতে হবে, তেমনি রাষ্ট্রকেও নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে এবং নারীর সমানাধিকার রক্ষায় যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, একজন নারী ধর্ষিত হয় মানে একজন নারী শারীরীকভাবেই ধর্ষিত হয় না, গোটা সমাজ ধর্ষিত হয়। কারণ এ সমাজ একজন নারীকে ধর্ষকের হাত থেকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ ব্যর্থতার দায় আমাদের সবার এবং আমাদের নির্বিকার সামাজিক সেনসিটিভিটিই এর জন্য দায়ী।
লেখক : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।