সুন্দরবন
তবে কি যাচ্ছি মৃত সমাজের দিকে?
ছোট জীবন, ক্ষুদ্র জীবন নিজের বাইরে জগতকে দেখতে পারে না। আর মহাজীবন নিজেকে বিলিয়ে অন্যদের রক্ষা করে। সুন্দরবন এমনই এক মহাজীবন। যাঁরা সুন্দরবন বেড়াতে যান তাঁরা এই মহাজীবনের খোঁজ পাবেন না। আবার যাঁরা গুগুল দিয়ে সুন্দরবন বোঝেন তাঁরাও মহাজীবনের খোঁজ পাবেন না। বিচিত্র তার কর্ম ও জীবন। বিষাক্ত সাপ থেকে শুরু করে দরিদ্র মাওয়ালি কাউকেই সে ফেরায় না। এই যে পরস্পর বিরোধী জীবন ও অবস্থান এই বৈচিত্রই তার জীবনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কোন সমাজে এই একটি বড় চিহ্ন হচ্ছে ওই সমাজে সবপক্ষের মতপ্রকাশের সুযোগ থাকা। এই পরস্পর বিরোধী মিথস্ক্রিয়াই সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এই বৈচিত্র্য সমাজে না থাকলে সেই সমাজ একটি মৃত সমাজে পরিণত হয়। মৃত সমাজ বেশিদূর এগুতে পারে না। তার সেই সক্ষমতা থাকারও সুযোগ নেই।
আমাদের সমাজে বর্তমানে ‘বৈচিত্র্য’ বা চিন্তার পরস্পর বিরোধী মিথস্ক্রিয়া নেই বললেই চলে। যখনি কেউ তাঁর মতামত ব্যক্ত করছেন তখনই সরকারের পক্ষ থেকে তাকে উন্নয়ন বিরোধী ও স্বাধীনতা বিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করে তাকে মার্জিনাইলজ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপট থেকে যদি সমাজের অভ্যান্তরে আলো ফেলে দেখেন তাহলে আমরা একটি মৃত সমাজের দিকে যাচ্ছি কিনা এ প্রশ্নটা আসা স্বাভাবিকই। সমাজের মহাজীবন সুন্দরবনের মতই সংকটের মুখে।
এক মহাজীবন সুন্দরবন ধ্বংস করছি এর কাছে দুটি কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে। অন্যটি ধ্বংস করছি সমাজে মতপ্রকাশের ওপর লিখিত-অলিখিত বিধি নিষেধ আরোপ করে। আমাদের সম্প্রতি আয়ত্বে আনা ‘উন্নয়ন সন্ত্রাস’ নীতি এর বহু আগে জার্মানিতে হিটলার নিয়েছিলেন, পাকিস্তান আমলে স্বৈরাচার আইয়ুব, বাংলাদেশ পর্বে স্বৈরাচার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, মিয়ানমারে সামরিক জান্তা আর ভারতে এখন নিয়েছেন বিজিপির মোদি সরকার। এর অর্থ বিষয়টি একদমই নতুন নয়। ভারতে এখন কিছু হলেই, কেউ কোনো বক্তব্য সরকারের বিরুদ্ধে দিলেই তাকে রাষ্ট্রদ্রোহী বানানো হচ্ছে।
সংকটে সুন্দরবনের মহাজীবন
সুন্দরবনের পাশে বাগেরহাটের রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াটের একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিষয়ে ভারতের সাথে ২০১০ সালে চুক্তি হওয়ার পর থেকেই এটির বিরোধিতা করে আসছে দেশের সচেতন অংশের মানুষ। বিষয়টি একপর্যায়ে সাধারণ মানুষের ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। সরকার এসবের কিছুই তোয়াক্কা না করে সুন্দরবনের আরো কাছে বাগেরহাটের মংলার শ্যাওলাবুনিয়াতে ৫৬৫ মেগাওয়াট আরেকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমতি দেয়। এ কেন্দ্রটি নির্মাণ করবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ওরিয়ন।
২০১১ সালের ২২ জুন বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব মিহির কান্তি মজুমদারকে চিঠি দিয়েছে রামসার। রামসারের পাশাপাশি বন অধিদপ্তরের পক্ষে প্রধান বন সংরক্ষক ইশতিয়াক উদ্দীন আহমদ ২০১১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রামপালে সুন্দরবনের কাছে পরিবেশ ধ্বংসকারী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র না করার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর। সচিবের কাছে লিখিত এক চিঠিতে বলা হয়, ‘কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে রয়েল বেঙ্গল টাইগার তথা সমগ্র জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন হবে।
২০১১ সালের ২৩ মে রামপালের কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য অবস্থানগত ছাড়পত্রের অনুমোদন দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। ওই অনুমোদনপত্রে বলা হয়, পরিবেশ অধিদপ্তরের পূর্ণ সম্মতি ইআইএ- এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট অনুমোদন না পাওয়া পর্যন্ত কোনো যন্ত্রাংশ আমদানির জন্য ব্যাংক ঋণপত্র (এলসি) খোলা যাবে না। পাশাপাশি জলভূমিও ভরাট করা যাবে না। যদি এসব শর্ত ভঙ্গ করা হয়, তবে অবস্থানগত ছাড়পত্র বাতিলের পাশাপাশি বিদ্যুৎ বিভাগের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে বাস্তবে অবস্থানগত ছাড়পত্র নিয়েই মাটি ভরাট করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। তবে তাদের অনুমতি বাতিল করা বা আইনে অধিনে আনেনি পরিবেশ অধিদপ্তর।
২০১১ সালের ৫ মে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. আবদুস সাত্তারের নেতৃত্বে পরিবেশবিদদের একটি দল প্রস্তাবিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জায়গা পরিদর্শন করে। তাঁরা নিবিড় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের ২৩ ধরনের ক্ষতির হিসাব তুলে ধরে। এসব ক্ষতির মধ্যে রয়েছে- সুন্দরবনের স্বাভাবিক চরিত্র বিনষ্ট হবে, তৈরি হবে অসংখ্য কয়লাডিপো, শুরু হবে গাছ কাটা, বনে আগুন লাগানো, বাঘ, হরিণ ও কুমির ধরা।
পরিবেশ অধিদপ্তর এসব আমলে নিতে পারত। এ জন্য তারা রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের চূড়ান্ত অনুমতি বা ইআইএ ছয়বার প্রত্যাখ্যান করেছে। তবে সরকারের প্রবল চাপে ২০১৩ আগস্টে একপ্রকার গোপনেই রামপালবিদ্যুৎকেন্দ্রের ইআইএ দেয় পরিবেশ বিভাগ। দেখুন ১৩ আগস্ট ২০১৩ সালের কালের কণ্ঠ।
এভাবে ছয়বার প্রত্যাখ্যানের পর ৬০ এর অধিক শর্ত দিয়ে ইআইএ দেওয়ার কারণ কী? সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সাংবাদিক হওয়া জানা গেছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। রামপাল কেন্দ্রের ইআইএ যখন ছয়বার ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে তখন পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ছিলেন মনোয়ার ইসলাম। এই মনোয়ার ইসলামকে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব করে আনা হয়। সচিব করার পরই তিনি পরিবেশ বিভাগের ওপর চাপ প্রয়োগ করে ইআইএ দিতে বাধ্য করেন।
সরকারের বক্তব্য রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু এই কেন্দ্র নিয়ে এরইমধ্যে শঙ্কায় আছে মংলাবন্দর কর্তৃপক্ষ। মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য যুগ্ম সচিব মো. এমদাদুল হক গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর ওয়াটার মডেলিং ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালককে চিঠি দিয়ে জানতে চেয়েছেন কেন্দ্রটি চালু হলে মংলা বন্দরের নাব্যতা সংকট দেখা যাবে কি না। এ চিঠির উত্তর এখনো দেয়নি ওয়াটার মডেলিং কর্তৃপক্ষ। চিঠিতে বলা হয়েছে, মংলা বন্দর থেকে ১৩ কিলোমিটার উজানে পশুর নদের তীরে বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ উদ্যোগে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় পানি পশুর নদ থেকে উত্তোলন করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ কেন্দ্রে প্রতিদিন নিবিবচ্ছিন্নভাবে প্রতি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৯ হাজার ১৫০ ঘনমিটার পানি উত্তোলন করা হবে। আর প্রতি ঘণ্টায় পশুর নদে উত্তোলন করা পানির পাঁচ হাজার ১৫০ ঘনফুট নির্গত করা হবে। সম্প্রতি পশুর নদের পানিপ্রবাহ ধীরে ধীরে হ্রাস পাওয়ায় চ্যানেলের বিভিন্ন স্থানে নাব্যতা সংকট দেখা দিয়েছে।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে পরিবেশবাদী ও সচেতন মানুষ যতটা না বিতর্ক করেছে তথ্য উপাত্য দিয়ে তাঁর চেয়ে বেশি বিরোধিতা করেছে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। কিন্তু সরকার কোনো কিছুই আমলে আনেনি।
সুপার ক্রিটিকেল প্রশ্নবিদ্ধ
সরকার বারবার বলছে, এই কেন্দ্র হবে সুপারক্রিটিকেল প্রযুক্তির। ফলে পরিবেশের কোনো ক্ষতি হবে না। উদাহরণ হিসেবে সরকার বার বার ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে সুপারক্রিটিকেল কেন্দ্রের কথা বলে আসছে। ভারতে এরকম দু’টি সুপারক্রিটিক্যাল কেন্দ্র সরেজমিন গিয়ে দেখা ও কেন্দ্র পরিচালনায় যুক্ত প্রকৌশলীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে ভিন্ন সত্য। খোদ ভারতেই এই প্রযুক্তি পরিবেশকে রক্ষা করা নিয়ে প্রচুর বিতর্ক রয়েছে।
সুপার ক্রিটিকেল প্রযুক্তি দিয়ে রামপালে স্থাপন করা হবে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র। সুপার ক্রিটিকেলের আরো আগের প্রযুক্তি সাবক্রিটিকেল দিয়ে বাংলাদেশের দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়ায় বর্তমানে ২৫০ মেগাওয়াটের একটি কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। বাস্তবতা হলো, সাবক্রিটিকেল থেকে সুপার ক্রিটিকেল এবং সর্বশেষ প্রযুক্তির আলট্রা সুপার ক্রিটিকেলের মতো যত আধুনিক প্রযুক্তিই আনা হোক না কেন এসব কেন্দ্র নিশ্ছিদ্রভাবে পরিবেশ রক্ষা করতে পারে না।
আদানি গ্রুপ পরিচালিত তিরোধা কেন্দ্রের বিশেষজ্ঞরা জানান, সাবক্রিটিকেল থেকে সুপার ক্রিটিকেল প্রযুক্তি এগিয়ে আছে মাত্র ২ শতাংশ। আর আলট্রা সুপার ক্রিটিকেল তা থেকে এগিয়ে আছে মাত্র ৩ শতাংশ। ভারতে বেসরকারিভাবে পরিচালিত এই কেন্দ্রের বিশেষজ্ঞরা আরো জানান, সাবক্রিটিকেল কেন্দ্রে দক্ষতা ৩৭ শতাংশ ও সুপার ক্রিটিক্যালে ৩৯ শতাংশ। আর আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যালের ক্ষেত্রে তা ৪২ শতাংশ।
মাত্র ২ শতাংশ কয়লা কম লাগায় পরিবেশের ক্ষতির মাত্রা খুব বেশি কমবে না। তাহলে এমন প্রযুক্তি কেন ব্যবহার করা হচ্ছে জানতে চাইলে তিরোধা বিদ্যুৎকেন্দ্রের হেড অব স্টেশন সিপি শাও বলেন, ‘নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ না খাইয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হলে যন্ত্রপাতি নষ্ট হলে খুচরা যন্ত্রপাতি পাওয়া যাবে না। এ কারণে চলতি প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়।’ বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রযুক্তি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সাব-ক্রিটিকেল থেকে ২ শতাংশ কম কয়লা দিয়ে একই পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় সুপারক্রিটিকেল প্রযুক্তির মাধ্যমে- যা এই তিরোধা কেন্দ্রে ব্যবহার হচ্ছে। ২ শতাংশ কয়লা কম লাগার কারণে কার্বন নিঃসরণ কম হয়। পরিবেশেরও কম ক্ষতি হয়। আর পরিবেশের কিছু ক্ষতি তো মেনে নিতেই হবে।’
২০১৪ সালের ১১ ডিসেম্বর সুন্দরবনের শ্যালা নদীর ভেতর দিয়ে তেল পরিবহনের সময় একটি তেলবাহী কার্গো ডুবে যায়। তিন লাখ লিটার ফার্নেস অয়েলের এ ট্যাঙ্কার ডুবে যাওয়ায় মহাসর্বনাশ ঘটে গেছে সুন্দরবনের। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) এনভায়রনমেন্ট সায়েন্স ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরীর নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি গবেষকদল তেল নিঃসরণের দিন থেকেই সুন্দরবনের এক হাজার ২০০ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে তেলের প্রভাব নিয়ে গবেষণা শুরু করে। ওই বছরের ডিসেম্বরের ২৬ তারিখে এ গবেষণাটি আমাকে দেওয়া হয়। ওই গবেষণা বলছে, শ্যালা নদীতে কার্গো ডুবে যাওয়ার কারণে যে তেল ছড়িয়ে পড়েছে তাতে সুন্দরবনের মহাসর্বনাশ ঘটে গেছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, তিন লাখ লিটার ফার্নেস তেল ছড়িয়ে পড়ে মহাসর্বনাশ ঘটিয়েছে সুন্দরবনের। ভারী এই তেলের কারণে নদী ও বনের প্রাণী-প্রতিবেশ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। তেলের কারণে পানির ভেতর মাছের ডিম, রেণু পোনা, জলজ প্রাণ ধ্বংস হয়ে গেছে। এর প্রভাব গিয়ে পড়বে খাদ্যচক্রে, ফলে এসবের ওপর নির্ভরশীল কুমির, ডলফিন, শূকর, হরিণসহ সুন্দরবনের গোটা জীববৈচিত্র্যে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। এমনকি কুমির ও ডলফিন এ অঞ্চল থেকে সরে যেতে পারে। ফার্নেস তেলের ক্ষতির প্রভাব সুন্দরবনের ৫০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে।
গবেষণার জন্য ২০১৪ সালের ১১ থেকে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত এক হাজার ২০০ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ১৫টি স্থান থেকে প্রতি ৪৮ ঘণ্টা পর এই গবেষণার তথ্য-উপাত্ত নেওয়া হয়েছে। সুন্দরবনের ওপর বন বিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, পূর্ব সুন্দরবন এলাকায় প্রতি লিটার পানিতে ৩০০ থেকে ৪০০টি উদ্ভিদকণা এবং ২০ থেকে ৩০টি প্রাণীকণা থাকে। খুবির এনভায়রনমেন্ট সায়েন্স ডিসিপ্লিনের গবেষণায় দেখা গেছে, পানির ভেতরে ফার্নেস তেলের কারণে এসব উদ্ভিদকণা ও প্রাণীকণার মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। ফাইটো প্ল্যাংটন হলো জলজ পরিবেশে পানির প্রথম স্তরের শক্তি উৎপাদক। স্বাভাবিক পরিবেশে পানিতে ৪৫টি প্রজাতির ফাইটো প্ল্যাংটন সুন্দরবনের নদীতে পাওয়া গেছে। কিন্তু তেল নিঃসরণের পর আক্রান্ত অঞ্চলে তা কমে মাত্র ১৬টি প্রজাতিতে এসেছে। বাকি ২৯টি প্রজাতি তেল আক্রান্ত অঞ্চলে পাওয়া যায়নি। এর ফলে পানির ভেতর প্রাথমিক খাদ্যস্তর ভেঙে পড়েছে।
এ প্রসঙ্গটি এখানে উল্লেখ করার কারণ হলো, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে তেলবাহী কার্গো ডুবে যাওয়ার অবস্থা যদি এ রকম ভয়ঙ্কর হয় তাহলে প্রতিদিন সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে দুটি কয়লাবাহী জাহাজ চলাচল করবে আর এসব জাহাজ যখন ডোবা শুরু করবে তখন এর প্রতিক্রিয়া কী হবে? এ ছাড়া কয়লার জাহাজ থেকে কয়লা উড়বে বাতাসে, কয়লাবোঝাই জাহাজের কয়লা মিশ্রিত পানি গিয়ে মিশবে নদীর পানিতে। এর প্রভাবগুলো হবে ভয়াবহ। যদিও সরকার বলছে, কয়লা আসবে সম্পন্ন ঢেকে। কিন্তু এটি অবাস্তব। যতগুলো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র দেখার সুযোগ হয়েছে সেখানে এ রকম কোনো ব্যবস্থা চোখে পড়েনি। উল্টো আদানি গ্রুপের তিরোধা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে এলাকার নারীদের ভ্রণ নষ্ট হওয়ার অভিযোগ আদানি গ্রুপ আমার কছে স্বীকার করেছে। শুধু তাই নয় এ কেন্দ্রের কারণে ওই অঞ্চলের পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। এক সময় যেখানে কমলার বাগান বলা হতো সেখানে এখন প্রতিদিনই কৃষক আত্মহত্যা করছে।
জনযাত্রা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা
সুন্দরবন গত ১০ মার্চ থেকে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির ‘জনযাত্রা’ শুরু করেছে। এটি শেষ হবে আজ ১৩ মার্চ বাগেরহাটের কাটাখালীর রূপসাতে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হওয়ার মধ্য দিয়ে। পথে পথে সাধারণ মানুষের মাঝে জাতীয় কমিটি এরইমধ্যে সমাবেশ করেছে। সুন্দরবন বাঁচাতে জাতীয় কমিটি যঁদের নেতৃত্বে রয়েছেন বামপন্থীরা তাঁরা এক অসাধারণ আন্দোলনের সূচনা করেছেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ইউরোপের দেশে দেশে যে সবুজ আন্দোলন হচ্ছে তা মূলত বামদের হাত ধরে। সেখানকার বেশ কিছু দেশে বামপন্থীরা পরিবেশের আন্দোলনের মাধ্যমে কোয়ালিশন সরকারও গড়েছে। আজকের দুনিয়ায় পরিবেশ রক্ষা করার এই মহান আন্দোলনের মধ্যে গোটা মানব সমাজ তথা পৃথিবীকে রক্ষার করার একটি প্রয়াস রয়েছে। বাংলাদেশের বামপন্থীরা তাদের সাবেকী বহু ধারণা থেকে বাইরের দুনিয়ায় চোখ রাখছেন এটি আশার কথা। বামপন্থীরা পরিবেশ বিনাশরোধে আন্দোলন করছেন কিন্তু মতপ্রকাশের কী হবে?
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটি টোটালেটেরিয়ান সরকার ব্যবস্থা এখানে শাসন করছে। ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হচ্ছে সাধারণ মানুষের কথা বলার স্পেস। এর নিদারুণ নজির হচ্ছে ডেইলি স্টারের সম্পাদকের বিরুদ্ধে সারা দেশে মামলা। এসব মামলার আবার কিছু করা হয়েছে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে। এখন সরকারের বিরোধিতা আর রাষ্ট্রের বিরোধিতা কি এক বিষয়? তবে কি সরকারের কোনো সমালোচনাই সিদ্ধ নয়? একই পরিস্থিতির শিকার দৈনিক প্রথম আলো। প্রতিকাটিতে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দেওয়ার ক্ষেত্রে এক অলিখিত বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এভাবে মত প্রকাশের জায়গাগুলো কমে গেলে, সংকোচন হলে একটি সচল সমাজ গঠনের বিপক্ষে যাবে তা। তাহলে আমরা কী একটি মৃত সমাজের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি?
লেখক : কবি ও সাংবাদিক