বিশ্ব নারী দিবস
নারীর মুক্তি নারীর হাতেই
আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের বয়স ৪৫। এই ৪৫ বছরে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে আজ অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ ও আত্মনির্ভরশীল। খাদ্য উৎপাদনে, শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে, প্রযুক্তির ব্যবহারে, খেলাধুলায় বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় অনেক দেশের জন্যই রোল মডেল। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে অনেক ক্ষেত্রেই নিজেরাই যে স্বাধীনভাবে বিচার করতে পারে তা করেও দেখিয়েছে বাংলাদেশ। আর বাংলাদেশের এত সব তাকলাগানো কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বর্তমানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পুরুষের মতোই নারীর এগিয়ে চলার মধ্য দিয়ে এবং এগিয়ে চলাটাই যুক্তিসঙ্গত কারণ। আমাদের সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে যে রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার ভাগ করবে।
বর্তমানে আমাদের দেশে নারী প্রধানমন্ত্রী, সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী নারী, রয়েছেন নারী স্পিকার। আমাদের আছেন সুযোগ্য বেশ কয়েকজন নারী প্রতিমন্ত্রী এবং এমপি। আমাদের উচ্চ ও নিম্ন আদালতে আসীন আছেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী বিচারক। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে আছেন নারী সচিব। দিনদিন বাড়ছে নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যা। আমাদের দেশের নারীরা পুলিশ, সেনাবাহিনী বা জাতিসংঘের শান্তিবাহিনীর মতো চ্যালেঞ্জিং কাজে উচ্চ পদে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করবে তা কেউ কি কখনো ভাবতে পেরেছে? কিন্তু আজ তা ধ্রুবতারার মতো সত্য।
গতানুগতিকভাবে শিক্ষকতায়, ডাক্তারি পেশায় ও মিডিয়া লাইনে নারীর আধিপত্য ও দাপট তো আছেই। আমাদের উপজেলা পরিষদ/ইউনিয়ন কাউন্সিল নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণ ও বিজয় রীতিমতো চোখে পরার মতো।
তাহলে প্রশ্ন আসতেই পারে বাংলাদেশের মতো মধ্যম আয়ের দেশে নারীর এতটা অগ্রসর হওয়ার কারণ কি? অন্যতম কারণ বলতে গেলে প্রথমেই আসবে নারীর প্রতি আমাদের রাষ্ট্রের সমর্থনের কথা। রাষ্ট্র চেয়েছে বলেই আমাদের শহুরে শিক্ষিত নারীরা (একটা অংশ) একটি ভালো অবস্থানে আসতে পেরেছেন। আমাদের সরকার নারীর আর্থসামাজিক অবস্থানকে মজবুত করার জন্য এরই মধ্যে নারী উন্নয়নমালা নীতি গ্রহণ করেছে, চাকরিজীবী নারীদের ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি দিয়েছে, সন্তানের পরিচয়ের ক্ষেত্রে বাবার পাশে মায়ের নামটিও সংযুক্ত করেছে।
বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন উঠলেও আমাদের সংসদ বা সরকারি চাকরিতে নারীর জন্য সংরক্ষিত আসন/কোটা সংখ্যা বৃদ্ধি এক অর্থে নারীকে এসব গুরুত্বপূর্ণ পদে আসতে আগ্রহীই করেছে।
শহুরে নারীদের পাশাপাশি গ্রামীণ নারীর অবস্থানের দিকে যদি তাকাই, তাহলে সেখানেও দেখব নারীদের প্রতি বর্তমান সরকার বহু পদক্ষেপ নিয়েছে। গ্রামীণ নারীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান মজবুত করার জন্য বিভিন্ন রকম ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের জীবনযাপনের মানোন্নয়ন, কর্মে সম্পৃক্ত করার জন্য গ্রামে একটি বাড়ি, একটি খামার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। তৃণমূল পর্যায়ে নারী উদ্যোক্তাদের হস্তশিল্প বিকাশের জন্য সরকার থেকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। গ্রামীণ নারীদের যখন সহায়তা দেওয়া হয়, দেখা যায় তারা তাদের প্রদেয় সহায়তা কখনো নয়ছয় করেন না। সহায়তাকে পুরোপুরি ব্যবহার করে পরিবারকে তাঁরা দিচ্ছেন আর্থিক সচ্ছলতা।
নারীর হাতে যখন অর্থ, তখন তাঁর দরিদ্র পরিবার জানে তাঁদের দুঃখের দিনগুলোর পরিসমাপ্তি হয়তো সামনেই। নারী কি গায়গতরে খেটে শুধু উপার্জনই করে যাবেন? তাঁর শরীর চলার মতো শক্তিটা আসবে কোথা থেকে? তাই গ্রামীণ নারীদের আর্থিক সহায়তা দিয়ে তাঁদের পায়ের তলার মাটিকেই শুধু সরকার মজবুত করছে না, তাঁদের স্বাস্থ্যের দিকেও সরকারের রয়েছে দৃষ্টি। যার ফলে আজ গ্রামীণ নারীর সুবিধার্থে গড়ে উঠেছে কমিউনিটি ক্লিনিক। আজ মাতৃমৃত্যু হ্রাসে আমাদের দেশ হয়েছে অনেকখানিই সফল।
নারী যে তাঁর পায়ের তলায় সৃদৃঢ় ভিত্তি তৈরি করতে পারছেন, তা পেছনের রয়েছে নারীর শিক্ষা। এখন আমাদের দেশে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত ছাত্রীরা বিনামূল্যে অধ্যয়ন করছে। প্রবেশিকা পরীক্ষা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলাফলের দিকে যদি তাকাই, তবে ভালো ফলধারী হিসেবে দেখা যাবে নারীই এগিয়ে আছে। শুধু শহরে নয়, গ্রামেও যে মেয়েটি প্রাথমিক/মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যাচ্ছে তার মধ্যেও কি ব্যক্তিসচেতনতা গড়ে উঠছে না? আর তার ব্যক্তিসচেতনতা সঞ্চারিত হচ্ছে তার মা-খালাদের মধ্যে।
আর আমাদের গোল্ডেন গার্লরা যে আমাদের শক্তি। গোল্ডেন গার্ল তথা আমাদের গার্মেন্টস-কন্যারা তো আমাদের অর্থনীতির প্রাথমিক জ্বালানি। তাঁরা না থাকলে, তাঁদের অবিরাম পরিশ্রম না থাকলে দেশের সুবিধাভোগীরা কি পারত এত আয়েশি জীবন উপভোগ করতে?
আমাদের দেশে নারীর সুরক্ষার জন্য সাম্প্রতিক সময়ে হয়েছে নানা আইন। প্রিভেনশন অ্যান্ড রেসট্রেইন অব হিউম্যান ট্রাফিকিং অ্যাক্ট, পর্নোগ্রাফি কন্ট্রোল আইন, পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ আইন ইত্যাদি। নির্যাতিতা নারীর আইনগত সুবিধা/অভিযোগ নেওয়ার জন্য দেশের প্রতিটি জেলায় খোলা হয়েছে স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার। ধর্ষিতা নারীকে হেল্প করার জন্য কয়েকটি সরকারি হাসপাতালে ডিএনএ ল্যাব খোলা হয়েছে।
অর্থাৎ বর্তমানে বাংলাদেশের নারীরা শিক্ষায়, স্বাস্থ্যে, আইনগতভাবে, আর্থিকভাবে, মানসিক সাপোর্টে প্রতিনিয়ত রাষ্ট্রকে সঙ্গে পাচ্ছেন। সেই সঙ্গে নারীর অগ্রগতির পথে পাশে রয়েছে তাঁর পরিবার। কিন্তু যখন রাষ্ট্র ও পরিবার থেকে নারীর প্রতি সর্বাত্মক সাপোর্ট থাকার পরও পত্রিকার পাতায় প্রায়শই পাই নারীর (উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত) প্রতি ভয়াবহ পারিবারিক নির্যাতনের চিত্র। তখন তাকে কী বলব? আজও কেন তবে শুনি সন্তান না হওয়ার বা পুত্রসন্তান জন্ম না হওয়ার জন্য কেবল নারী দায়ী? কর্মক্ষেত্রে/শিক্ষাক্ষেত্রে নারী আকসারই উচ্চশিক্ষিত পুরুষের নানা বিকৃতির স্বীকার, যদিও এর জন্য দায়ী হয় নারীর পোশাক বা তাঁর স্মার্টনেস।
প্রত্যন্ত গ্রামে গরিব-অসহায় মেয়েরা যেমন বাল্যবিবাহের শিকার, তেমনি শহরের অনেক নারী পড়াশোনা করে (অনেক সময় ভালো ফলও করে) কেবলই ধনবান স্বামীর খোঁজে। সংসার আর সন্তানের খেয়ালের জন্যে কর্মক্ষেত্রের লোভনীয় প্রস্তাব ছেড়ে দেওয়া তো নারীর জন্য ডালভাত। কষ্টের পড়াশোনা চুলায় যাক, সন্তানকে তো মানুষ করতে হবে। সন্তানের মানুষ না হওয়ার দোষ তো তার কাঁধেই বর্তাবে শেষমেশ।
কেন আমাদের নারীশ্রমিকরা পুরুষশ্রমিকের চেয়ে কম মজুরি পায়? আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি গার্মেন্টসকন্যাদের দিনরাত খাটুনির ফল কি তবে তাদের নানা রকম অপমৃত্যু? আমাদের দেশে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত কয়টি পরিবারের পুরুষ নারীকে বাড়ির পাশেই থাকা হেলথ সেন্টারে নিয়েছে? এত আইনের পরেও কয়জন নারী তাঁর ন্যায্য অধিকার/নির্যাতন থেকে মুক্তির জন্য আইনের আশ্রয় নেন? নারীর শারীরিক ভালোমন্দই যখন পরিবারে তেমন মূল্যায়িত হয়নি, তাহলে নারীর মনের অবস্থা জানার খোঁজ আদৌ কেউ রাখে কি? কয়জন নারীর আছে পরিবার/কর্মক্ষেত্রে নিজে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা? নারী যখন কর্মক্ষেত্রে তরতরিয়ে উঠতে থাকে, তখন তার গুণ নয় রূপের কথাই সবার মুখে খই ফোটায়। শিক্ষিতা মধ্যবিত্ত নারী সে যে বড় অসহায়। সমাজ-সংসারের ভয়ে উচ্চশিক্ষিত নারীও স্বামী কর্তৃক চক্ষু উৎপাটন করার আগ পর্যন্ত মুখ বুজে করে চলে সংসার।
তবে কি নারীর প্রতি সহিংসতার এসব খণ্ডচিত্র আমাদের বর্তমানে নারীর বহুক্ষেত্রে ঘটা বিপ্লবের মুখে পানি ঢেলে দেবে? আর কতটা বছর নারীর এতসব প্রতিবন্ধকতা দূর করা নিয়ে আমরা আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে সামনে রেখে সেমিনার করে যাব (বিদেশেও আমাদের মতো একই বিষয় নিয়ে চলে সেমিনার)? জানি না, আর কয়টি নারী দিবস এলে আমাদের গ্রাম থেকে শহরের সব নারী হাজারও রকম কষ্ট থেকে মুক্তি পাবে?
আমাদের নারীদের তবে কি আত্মমর্যাদা থাকতে নেই? থাকতে নেই কোনো অ্যাম্বিশন? আর কতকাল আমরা সবার সঙ্গে মানিয়ে চলব? ২০১৬ সালে মা-কন্যা-নারী নয়, মানুষ হিসেবে আমরা সব রকম নিষ্পেশন থেকে মুক্তি চাই। কার কাছে হাত পাতব আমরা এ মুক্তির জন্যে? জানি কেউ মুক্তির ডালা সাজিয়ে আমাদের জন্য বসে নেই।
আমাদের আত্মমর্যাদাবোধ আর ঘরেবাইরে আমাদের প্রতি ধুলার সমান পরিমাণ নির্যাতনেও যদি আমরা নিজেরাই রুখে দাঁড়াই তবেই মিলবে নারীর মুক্তি। নারীর মুক্তি যে নারীর হাতেই!
লেখক : সহকারী পরিচালক, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন