বিশ্ব নারী দিবস
নিজেদের স্বাস্থ্যগত অধিকারে হতে হবে সচেতন
বিশ্ব নারী দিবস আজ। নজরুল বলেছেন, ‘সাম্যের গান গাই/আমার চক্ষে পুরুষ রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই/বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ তবে আসলেই কি সাম্য হচ্ছে?
নারীরা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করলেও এখনো সামাজিক বিভিন্ন কুসংস্কারের মধ্যে কেবল নারীদেরই পড়তে দেখা যায় বা পড়তে হয়। আবার নারীদের নিজেদের মধ্যেও রয়ে গেছে অসচেতনতা। চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রয়োজনে নিজেকে প্রকাশ করতে না পারার সংকোচ।
কিছু রোগ আছে, যেগুলো নারী ও পুরুষ উভয়েরই সমানভাবে হয়। আবার কিছু রোগ রয়েছে, যা নারীদেরই বেশি হয়। তবে সামাজিক বিবর্তনের কারণে পৃথিবীব্যাপী পুরুষদের রোগগুলোও এখন নারীদের ক্ষেত্রে সমভাবে হতে দেখা যায়। এখন নারী-পুরুষের জীবনধারণের ধরন প্রায় একই রকম হয়ে উঠেছে। তাই যেসব রোগ নারীদের আগে তেমন হতো না, এখন সেই রোগগুলোও হতে দেখা যায়।
পশ্চিমা বিশ্বে মদ্যপান বা ধূমপানের বিষয়টি নারীদের মধ্যে আগে থেকে চলে এলেও আমাদের দেশে কিন্তু কিছুদিন ধরেই এর ব্যাপকতা বাড়ছে। এতে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা হচ্ছে। এগুলো যেমন পুরুষদের স্বাস্থ্যের ওপর বাজে প্রভাব ফেলছে, তেমনি ফেলছে নারী স্বাস্থ্যের ওপরও।
আমাদের দেশে নারীরা এখনো নিজেদের স্বাস্থ্যের বিষয়ে তেমন সচেতন নন। তাঁরা সংসার সামলান, স্বামী-সন্তানের সেবা করেন। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিজেদের শরীরের প্রতি খেয়াল রাখেন না।
আজকাল মেয়েরা বাইরে কাজ করছেন। করপোরেট চাকরিজীবী নারীরা তো রয়েছেনই, পাশাপাশি পোশাক কারখানা ও ইটের ভাটাতেও কাজ করছেন কর্মজীবী নারীরা। তাঁরাই আবার বাড়ি ফিরে ঘর সামলান, সংসারের দেখভাল করেন। ‘দশবাহু’র নারী যেন হতে হয় তাঁদের। এগুলো সামলাতে গিয়ে হয়তো নিজের স্বাস্থ্য হয়ে পড়ে অবহেলিত। অসুখ-বিসুখ হলে তো অবেহলা করেনই, পাশাপাশি খাওয়াটাও ঠিকমতো খান না অনেকে। এতে পুষ্টির চাহিদা অপূর্ণ রয়েই যায়। এতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের অসুখে পড়েন তাঁরা।
অনেক সময় দেখা যায়, গ্রামীণ নারীরা লজ্জায় নিজের সমস্যার কথা পরিবারের মানুষকে বলতে চান না। বিয়ের পর অনেক মেয়েই ভাবেন, শরীর অসুস্থ এই কথা জানালে শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তাঁকে ‘রোগাটে’ ভাবতে পারে। এই ভয়েও অনেক সময় তাঁরা অসুস্থতার বিষয়টি চেপে যান বা লুকিয়ে রাখেন। বিশেষ করে মেয়েলি রোগগুলো তাঁরা এতটাই লুকিয়ে রাখেন যে পরবর্তী সময়ে এ থেকে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হয়।
আমাদের দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার কারণে নারী নির্যাতনের ঘটনা অনেক বেশি ঘটে। এতে তাঁদের ওপর মানসিক চাপ বাড়ে। বিষণ্ণতা, উদ্বেগ এসব সমস্যা দেখা দেয়। গবেষণায় দেখা যায়, বিষণ্ণতায় নারীদের ভোগার হার বেশি। এসব মানসিক সমস্যা থেকে তৈরি হয় বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা।
একটি সংসার সামলানোর জন্য নারীর ভূমিকা কিন্তু অপরিসীম। মূলত একজন নারীই সংসারের অধিকাংশ দায়িত্ব পালন করেন, সংসারটি টিকিয়ে রাখেন। আবার এখনকার নারীরা যেহেতু চাকরিও করেন, সেখানেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁদের মানসিক চাপের মধ্যে পড়তে হয়। সব দিক সামলাতে গিয়ে মন ও শরীরের ওপর বেশ ধকল যায়। তবে অবহেলায় রয়ে যায় সেই স্বাস্থ্য। বাঁধিয়ে বসেন জটিল কোনো রোগ।
কাজ তো করতেই হবে, তবে শরীরের যত্ন নেওয়াটাও কিন্তু জরুরি। কেবল একজন নারীই নয়, পুরুষেরও সব দিক সামলাতে গেলে শরীরের প্রতি যত্ন নিতে হয়। নয়তো অসুস্থ হয়ে গিয়ে কাজে আরো পিছিয়ে পড়তে হবে।
এ তো গেল নারীদের ব্যক্তিগত বা পারিবারিক বিষয়। এবার আসা যাক, সারা দেশের নারী স্বাস্থ্যসেবার অবস্থা কেমন—এ বিষয়টি নিয়ে। আমাদের দেশের অধিকাংশ হাসপাতালে দেখা যায়, পুরুষ ওয়ার্ডের চেয়ে নারী ওয়ার্ড তুলনামূলকভাবে কম। পুরুষদের ওয়ার্ড যদি চারটা থাকে, সে ক্ষেত্রে হয়তো নারীদের ওয়ার্ড থাকে দুই থেকে তিনটি।
এ ছাড়া দেখা যায়, নারী-পুরুষকে একসঙ্গে টিকেটের লাইনে দাঁড়াতে হয়। অনেক সময় খুব অসুস্থ রোগী হলে তাঁদের জন্য কষ্টকর হয়ে যায় বিষয়টি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আলাদা কাউন্টার থাকলেও সেটি পর্যাপ্ত নয়। এই বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে যথাযথ কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, নারীরা পুরুষ চিকিৎসকের কাছে আসতে লজ্জা পান বা রোগের কথা বিস্তারিত বলতে লজ্জা পান। এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। কেননা, রোগের চিকিৎসায় নারী-পুরুষ বিষয়টি থাকা ঠিক নয়।
গ্রামীণ নারীরা অনেক সময় চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হন। তাঁরা হয়তো লজ্জায় পুরুষ চিকিৎসকের কাছে সমস্যার কথা বলতে চান না। চিকিৎসা না নেওয়ার কারণে সমস্যা বাড়ে। নারী চিকিৎসকের আশায় বসে থেকে আর চিকিৎসাই নেওয়া হয়ে ওঠে না। কেবল নারী চিকিৎসক সেবা দেবেন—এ বিষয়টি থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন।
এ ছাড়া দেখা যায়, সরকারের তরফ থেকে গর্ভকালীন ছুটি ছয় মাস করা হলেও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তিন বা চার মাস ছুটি দেয়। ছয় মাস ছুটি একজন নতুন মায়ের জন্য বেশ জরুরি।
নারীদের নিজেদের স্বাস্থ্য ও অধিকারের বিষয়গুলোতে আরো বেশি সচেতন হওয়ার প্রয়োজন। অধিকার তো আসলে কেউ দিয়ে দেয় না। অধিকার আদায় করে নিতে হয়। নিজের স্বাস্থ্যের বিষয়ে সচেতন হতে হবে সবার আগে। কারণ, স্বাস্থ্য ভালো থাকলে সে সবকিছুই করতে পারবে।
নিয়মিত খাবার খাওয়া, মেয়েলি রোগগুলো সম্বন্ধে সচেতন হওয়া এবং চিকিৎসকের পরামর্শমতো থাকা তাই দরকার। মনে রাখতে হবে, কেউ যখন অসুস্থ হয়, তখন সে একাই অসুস্থ হয় না, পরিবারও এতে ভোগে। তাই পরিবারকে ভালো রাখতে হলে নিজেকে ভালো রাখাটাও জরুরি।
লেখক : ডিন, মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়