‘মওকা’ ভিডিও এবং জাতীয়তাবাদী উসকানি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বব্যাপী ধ্বংসাত্মক আর নৃশংস অবস্থা দেখে মানুষ শান্তির জন্য ভিন্ন কথা ভাবতে শুরু করে। বিশ্বের সব জাতিকে শান্তির সোপানতলে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য খেলাধুলাকে মাধ্যম হিসেবে বেছে নেয় বিশ্ব নেতারা। শুরু হয় খেলাধুলার প্রসার।
বিশ্বব্যাপী খেলাধুলার প্রসারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এবং বিশ্ব শান্তির জন্য সব জাতি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার তাগিদ থেকেই শুরু হয় বড় বড় টুর্নামেন্টের আয়োজন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেও এই রকম টুর্নামেন্ট আয়োজন হতো। তবে তা আকারে তেমন বড় ছিল না এবং তার বিশ্বব্যাপ্তিও এত বৃহৎ ছিল না।
আধুনিক যুগের মানুষের মুখে শান্তির বাণী, অন্তরে বিদ্বেষের বিষ। তাই তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরও বেশ কয়েকটি যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে বিশ্ববাসীকে। মাঝে মাঝেই দেখা দেয় উগ্র জাত্যাভিমান। জাতিগত হিংসা বিদ্বেষ কমেনি, বরং আধুনিক মানুষ যেন আধুনিকতার সঙ্গে সঙ্গে হয়ে ওঠেছে আরো বেশি হিংসুক আর নৃশংস। আর জাতীয়তাবাদকে উসকে দেওয়ার জন্য মানুষ নতুন ফন্দি আঁটছে, ভিন্ন ভিন্ন পথে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
চলছে ক্রিকেট বিশ্বকাপ। রাজনৈতিক ঝাণ্ডার বাইরে ক্রিকেটও না। তবে ক্রিকেট বিশ্ব ভ্রাতৃত্বে ভূমিকা রাখছে। তাই ক্রিকেটের রাজনৈতিক দিকটা ইতিবাচকভাবেই নেওয়া হয়। বিশ্বকাপকে ঘিরে পৃথিবীর অন্যান্য মহাদেশের চেয়ে উপমহাদেশেই উম্মাদনা বেশি। যেহেতু ক্রিকেট বিশ্বে উপমহাদেশের শ্রীলঙ্কা, ভারত ও পাকিস্তান খুব শক্তিশালী দেশ, তাই উম্মাদনা একটু বেশিই থাকবে। আর বাংলাদেশও ক্রিকেটের পরাশক্তিতে পরিণত হচ্ছে ধীরে ধীরে। এই বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনালে গিয়ে সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে টাইগাররা।
পাক-ভারত সম্পর্কে ক্রিকেট কতটা উত্তেজনা তৈরি করে, তা নতুন করে বলার কিছু নেই। এবার সেখানে যোগ হয়েছে বাংলাদেশও। মাঠের খেলাকে তাই ড্রয়িংরুমে, কেউ কেউ রাজনৈতিক টেবিলে নিয়ে উপর্যুপরি পোস্টমর্টেম করে নিত্যনতুন তকমা দিচ্ছেন। উসকে দিচ্ছেন জাতীয়তাবাদকে। এই যেমন ১৯ মার্চ বিশ্বকাপ কোয়ার্টারে ভারতের মুখোমুখি হচ্ছে বাংলাদেশ। আর এই নিয়ে নতুন করে তৈরি হচ্ছে উত্তেজনা। তবে সে উত্তেজনা যদি ক্রিকেটে সীমাবদ্ধ থাকত, তবে বলার কিছু ছিল না। ভাবনারও কিছু ছিল না। কিন্তু তা হয়নি। সে উত্তেজনা খেলার মাঠ থেকে চলে এসেছে রাজনৈতিক মাঠে। শুধু তাই নয়, তা এখন এক ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে বলেই আমি মনে করি। এই ভীতি হয়তো আপাতদৃষ্টিতে কোনো সংঘাত তৈরি করবে না। কিন্তু এই দুটি দেশে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর ভেতরে তৈরি করবে উগ্র জাত্যাভিমান, যা যেকোনো সময় জাতিগত বিভেদ তৈরি করতে পারে। দেখা দিতে পারে মানবিক বিপর্যয়।
এই যেমন সম্প্রতি ‘মওকা’ নামের একটি ভিডিও তৈরি করে তা ইউটিউবে ছাড়া হয়েছে। এই ভিডিওচিত্রটি কারা বানিয়েছে সেটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে তবে এটা ঠিক ওই ভিডিওতে বাংলাদেশকে ভারতের কাছ শুধু ছোটই করা হয়নি, জাতি হিসেবেও ভারতের অধীনস্থ হিসেবে আমাদেরকে অপমাণ করা হয়েছে।
আর এই ভিডিও নিয়েই তৈরি হয়েছে নতুন উত্তেজনা। এক মওকার জবাবে তৈরি হচ্ছে ডজন ডজন মওকা। এই উত্তেজনা ক্রিকেটের মাঠ থেকে ঢুকে পড়েছে বাংলাদেশিদের জাতীয়তাবাদের অহংকারের অন্দরমহলে। যে-ই নির্মাণ করুক না কেন, এই ভিডিও যে বাংলাদেশিদের জন্য চরম অবমাননাকর, তা যে কেউ বুঝতে পারবে। আর এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও টুইটারে বাংলাদেশিরা প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছে। তারাও ভিন্ন ভিন্ন ইস্যু নিয়ে আসছেন আলোচনায়, যা মোটেও কাম্য নয়। এখন কথা হলো, এই ভিডিওটি কারা নির্মাণ করেছে? যে-ই করে থাকুক তার উদ্দেশ্য যে জাতীয়তাবাদকে উসকে দেওয়া, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এর নিন্দা করারও ভাষা নেই।
এবার একটি প্রাসঙ্গিক বিষয়ে কথা বলি। দৈনিক আনন্দবাজারের খেলাধুলা বিষয়ক প্রতিবেদক গৌতম ভট্টাচার্য। তিনি ১৪ মার্চ বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড ম্যাচের পর করা এক প্রতিবেদনে সৌম্যকে নিয়ে লিখতে গিয়ে বলেন, ‘টিমে একমাত্র হিন্দু ক্রিকেটার সৌম্য সরকার এবং রিয়াধের (রিয়াদ) পার্টনারশিপ এই ধারণার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সবচেয়ে বড় মাস্তুল যে না, বাংলাদেশ ইচ্ছাকৃত ম্যাচ ছাড়েনি। আপ্রাণ লড়েও পারেনি।’
সৌম্য হিন্দু না মুসলিম এই পরিচয়টা গৌতম ভট্টাচার্যের কাছে কেন বড় মনে হলো তা জানি না। তবে তিনি যে আঙ্গিক থেকেই এইভাবে লিখে থাকুন না কেন, তা আমার কাছে জাতিগত বিভেদকে উসকে দেওয়ার মতো লেখাই আমি বলব। হয়তো সৌম্যও ভাবেননি, তিনিই একমাত্রই হিন্দু খেলোয়াড় বাংলাদেশ দলে। কিন্তু গৌতম ভট্টাচার্য এই পরিচয়টা মনে করিয়ে দিয়েছেন। এটা কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না। গৌতম ভট্টাচার্য কোন তাগিদ থেকে লিখেছেন তা তিনিই ভালো বলতে পারবেন। তবে আমি সৌম্যকে একজন বাংলাদেশি খেলোয়াড় হিসেবেই জানি এবং ভবিষ্যতেও এই পরিচয়টাই আমার কাছে প্রথম এবং শেষ পরিচয় থাকবে তার। তার আর কোনো পরিচয় হতে পারে না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমরা দেখেছি জার্মান জাতীয়তাবাদ কী পরিমাণ ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে পৃথিবীব্যাপী। পৃথিবীর সব মানুষদের জন্য সেই উগ্র জাতীয়তাবাদ অভিশাপ স্বরূপ এসেছিল, যার আগুনে পুড়ে এখনো হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে জন্ম নিচ্ছে বিকলাঙ্গ শিশু। আমরা আর অমন জাতীয়তাবাদের উত্থান দেখতে চাই না।
ছেলেবেলায় পাকিস্তান-ভারত ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে খুব উত্তেজিত হয়ে যেতাম। আর তখন একজন মানুষের চেয়ে একজন মুসলমান হিসেবে নিজের পরিচয়টা খুব গৌরবের, আভিজাত্যের মনে করতাম। সেই সময় পাকিস্তানকে সমর্থন করতাম। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে তখন জম্মু ও কাশ্মীর নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছিল। ওই সময়ে কল্পনা করতাম, পাকিস্তান-ভারত একটি ক্রিকেট ম্যাচ হবে, যার রেজাল্টের ওপর নির্ভর করবে কাশ্মীর কার হবে। তবে কেমন হবে? ভারতীয় সিনেমা আমির খানের ‘লগন’ যে এই ভাবনাকে জাগিয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ওই ভাবনা যে কী পরিমাণ জাতিগত হিংসায় ভরপুর, তখন বুঝিনি। এখন বুঝি ওই রকম একটি ম্যাচ হওয়া মানে জাতিগত বিভেদ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া। ছেলেবেলায় ভাবতাম ওই রকম ভাবনা। কিন্তু এখন বুঝি, কী ভুল ভাবনাই না ভাবতাম তখন। মওকা নির্মাণকারীদের মানসিকতাও একই।
পরিশেষে বলব, যারা মওকার মতো ভিডিও তৈরি করে জাতিগত বিভেদকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে চায় তাদের জন্য ঘৃণা রইল। খেলাধুলার মাধ্যমে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব আরো শক্তিশালী হোক, শান্তির সোপানতলে অস্তমিত যাক অশুভ সব সূর্য।
লেখক : সাংবাদিক