ভাষা আন্দোলন প্রথম পর্ব : দৃশ্যপট ভাটির শহর খুলনা
বাহান্নর একুশ বাঙালি জাতির ইতিহাসে যুগান্তকারী একটা দিন। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় সেদিন সূচনা হয়েছিল এক অভূতপূর্ব আন্দোলনের, যা আত্মত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত। সালাম বরকত রফিক জব্বারের রক্তে লাল হয়েছিল বাংলা বর্ণমালা। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে অযৌক্তিকভাবে উর্দুকে প্রতিষ্ঠিত করার ঔপনিবেশিক চক্রান্তের বিপরীতে বাংলা ও বাঙালির চেতনার রঙে বাঙানো একুশ। শোণিত-তপ্ত সূর্যালোকে বাঙালি রচনা করেছে মৃত্যুঞ্জয়ী এক ইতিহাস। সাতচল্লিশ থেকে বাহান্ন, আমাদের ভাষা আন্দোলনের প্রথম প্রহরে এর কিরণচ্ছটা ঢাকাকে আলোকিত করেছিল। ক্রমে সে আলো ঢাকার বাইরে ছড়িয়ে পড়েছিল, প্রাচীন গাঙদ্বীপের বর্ধিষ্ণু শহর খুলনায়। আধুনিক খুলনার পূর্ব ইতিহাস নিয়ে দু-একটা কথা এখানে বলতে হচ্ছে। ইংরেজ আমলের প্রথম দিকে খুলনার নাম ছিল নয়াবাদ। শহরের জেলখানা ঘাটের অপর পারে তালিমপুর নামে একটা জায়গা আছে। জায়গাটা জমিদার শিবনাথ ঘোষের জমিদারির অধীন ছিল। সেখানে এলেন রেনী নামের এক ইংরেজ নীল বণিক। রেনী স্থানীয় লোকজনদের ঘৃণার চোখে দেখতেন। ব্যবসা এবং এলাকার প্রভুত্ব নিয়ে জমিদার শিবনাথ ঘোষের সঙ্গে রেনীর সংঘাত লেগেই থাকত। এই সংঘাত এড়াতে কোম্পানি আমলে ওই দুজনের বাড়ির মধ্যস্থলে পুলিশ চৌকি স্থাপিত হলো। ছোট্ট সেই চৌকিই সময়ের সঙ্গে খুলনা জেলা শহর এবং হালে বিভাগীয় শহর। সেকালে সুন্দরবনের বাইরে মনুষ্যবসতির শেষ এলাকা ছিল নয়াবাদ। ১৮৮২ সালে যশোর প্রশাসনিক জেলা থেকে খুলনা পৃথক হয়।
‘দুঃসংবাদ বাতাসের আগে ধায়’ এ প্রবাদ প্রতিফলিত হয়েছিল দ্রুত তালে-দ্রুত লয়ে। আজকের বন্দরনগরী খুলনা সেদিন অন্যান্য জেলার মতো ভাষা আন্দোলনের তপ্ত আবেগে আপ্লুত হয়েছিল। আজকের সরকারি ব্রজলাল (বিএল) বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ সকল আন্দোলন সংগ্রামের পীঠস্থান, সেদিন কিন্তু এই অবয়বে ছিল না। ওর নাম ছিল দৌলতপুর হিন্দু একাডেমি। এ ছাড়া খুলনায় স্কুল বলতে ছিল জেলা স্কুল, সেন্ট জোসেফ স্কুল, বি কে স্কুল ও মডেল স্কুল। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করেই সেদিন রচিত হয়েছিল খুলনার ভাষা আন্দোলনের সব আয়োজন। সেকালে দৌলতপুর হিন্দু একাডেমিসহ অন্য স্কুলগুলোতে ছাত্র বলতে যারা, তারা অধিকাংশই হিন্দু। অন্যদিকে সেদিন রাজনৈতিক দল বলতে তা মুসলিম লীগ, যারা আবার প্রকাশ্যে উর্দুর পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। কংগ্রেস নামের একটা দল থাকলেও তাদের তেমন কোনো কর্মকাণ্ড এখানে ছিল না। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নেওয়ার মতো রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত কোনো শক্তি ছিল না। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির আদর্শে মার্কসীয় দর্শনে পরিচালিত সংগঠন ছাত্র ফেডারেশনই ছিল একমাত্র ভরসা। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪৭ অবধি দৌলতপুর হিন্দু একাডেমির নেতৃত্বে ছিল ওই বাম ধারার ছাত্র ফেডারেশন নামের সংগঠনটা। এ ছাড়া ভাষার প্রশ্নে মুসলিম লীগের মধ্যকার টানাপড়েনে ওদের ছাত্র সংগঠনের অপেক্ষাকৃত উদারপন্থিদের দু-একজন এসে যোগ দিয়েছিল ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে। ভাষা আন্দোলনের সূচনা পর্বে তাই বলতে গেলে বাংলা ভাষার দাবির প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনে ওই ছাত্র ফেডারেশনের ভূমিকাই ছিল মুখ্য।
১৯৩৭ সালে প্রথম জেলা সম্মেলনের মাধ্যমে খুলনা জেলা ছাত্র ফেডারেশনের আনুষ্ঠানিক জন্ম হয়। প্রায় একই সময়ে নিখিলবঙ্গ মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন নামে আরো একটা ছাত্র সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। এরপর ’৪৭ সালের স্বাধীনতার পর সরকারবিরোধী ছাত্র সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নামের ছাত্র সংগঠনটি। এদিকে ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং ’৪৭-এর ভারত বিভক্তি সূত্রে অনেক হিন্দু ছাত্র দেশত্যাগ করে, ফলে অনেকটা দুর্বল সাংগঠনিক অবস্থার মধ্যে খুলনার ভাষা সংগ্রাম শুরু হয়। ’৪৮-এ খুলনার ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন ছাত্র ফেডারেশনের সম্পাদক স্বদেশ বসু, অন্যান্যের মধ্যে সন্তোষ দাশগুপ্ত, এম এ গফুর, আশাশুনি থানার আনোয়ার হোসেন এবং কপিলমুনির ধনঞ্জয় দাশ প্রমুখ। এই আনোয়ার হোসেন পরবর্তীকালে রাজশাহী জেলের খাপরা ওয়ার্ডে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। এ সকল ছাত্রনেতাদের সঙ্গে ভাষা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলের মুসলিম ছাত্রলীগের জিল্লুর রহমান, মতিয়ার রহমান, তাহমিদ উদ্দীন আহম্মেদ প্রমুখ টগবগে তরুণ।
মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অনিবার্য ফসল হিসেবে ১৯৫০ সালে পূর্ববঙ্গে আবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অবতারণা করা হয়। ওই দাঙ্গার উদ্দেশ্য ছিল দেশের প্রগতিশীল ধারার রাজনৈতিক শক্তিকে সমূলে ধ্বংস করা। ’৫০-এর দাঙ্গায় খুলনা অঞ্চলে বিভীষিকার সূত্রপাত হয়, হিন্দু ছাত্ররা সপরিবারে দেশত্যাগে বাধ্য হয়। এদিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী আততায়ীর গুলিতে নিহত হলে তাঁদের বশংবদ খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তিনি ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগের প্রকাশ্য অধিবেশনে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে জিন্নার উক্তি পুনর্ব্যক্ত করেন, নিলর্জ্জের মতো বলে ফেলেন ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু’। নাজিমুদ্দিনের ওই উক্তির প্রতিবাদে ভাষা আন্দোলন সহিংস ধারায় প্রবাহিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবদুল মতিনের নেতৃত্বে এবং মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকাসহ সারা দেশে হরতাল আহ্বান করা হয়।
খবর খুলনায় পৌঁছাতে দেরি হয় না। খুলনার হাল সুন্দরবনঘেঁষা কয়রা উপজেলার হরিনগর (হড্ডে) গ্রামের এম এ গফুর বিএল কলেজের ছাত্র ফেডারেশনের নেতা, সবেমাত্র ছাত্রত্ব ছেড়ে কমিউনিস্ট আদর্শের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে খুলনা শহরের যশোর রোড ও সারদা বাবু রোডের সংযোগ স্থলে একটা একতলা বাড়িতে থাকেন। ওই বাড়ির অন্য একটা কামরায় এ কে সামসুদ্দিন (সুনু মিয়া) ‘আজাদ লাইব্রেরি’ নামের একটা গ্রন্থাগার পরিচালনা করেন। উৎসাহী অনেকে সেখানে পড়তে আসেন। দুজনের মধ্যে ছিল আদর্শিক মিল। ঢাকার খবর শুনে ১৮ ফেব্রুয়ারি তাঁরা একত্রে বসলেন, তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলেন হিন্দু একাডেমির (বিএল কলেজের) ছাত্র তোফাজ্জেল হোসেন। তিনজন মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন একুশ তারিখে ভাষার দাবিতে হরতাল পালন করবেন। শিশি ভর্তি আলতা কেনা হলো, দাতন জোগাড় করা হলো, কাগজও কেনা হলো। রাতে শখানেক পোস্টার লেখা হয়ে গেল। পোস্টারগুলো আঠা দিয়ে স্কুলের দেয়ালে গোপনে লাগিয়ে দেওয়া হলো। পরদিন তিনজন একত্রে স্কুলগুলোতে গেলেন, ছাত্রদের বুঝিয়ে হরতাল পালন করতে বললেন। এ খবর শুনে এগিয়ে এলেন মিজানুর রহিম, নূরুল ইসলাম নান্নু, মালিক আতাহার, জাহিদুল হক প্রমুখ ছাত্রনেতা। এদের নেতৃত্বে দৌলতপুর হিন্দু একাডেমি এবং জেলা স্কুল ছাড়া খুলনা শহরের সব স্কুলে হরতাল পালিত হলো।
একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে নূরুল আমিন সরকারের পুলিশ বাহিনী ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালাল। শহীদ হলেন বরকত, সালাম, জব্বার ও রফিক, আহত হলেন অনেকে। খবর ছড়িয়ে পড়তেই পুরো ঢাকা শহরে আগুন জ্বলে উঠল। খুলনা শহরে ওই ছাত্র হত্যার খবর পৌঁছে গেল। এবার ছাত্র ফেডারেশনের আন্দোলনের সঙ্গে মুসলিম ছাত্রলীগের তরুণ যুবনেতা আবু মোহাম্মদ ফেরদৌস এগিয়ে এলেন, আরো এলেন এম এ জলিল, নূরুল ইসলাম দাদু প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। ২২ তারিখে পুরো খুলনা শহরে হরতাল পালিত হলো। চোঙা ফুঁকিয়ে ২৩ তারিখে গান্ধীপার্কে (হাদিস পার্ক) নূরুল আমিন সরকারের গণবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভার আহ্বান জানানো হলো। রাস্তার মোড়ে মোড়ে কৌটা রেখে আন্দোলনের সমর্থনে চাঁদা তোলা হলো। বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্যে ২৩ ফেব্রুয়ারি মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে খুলনায় প্রথম সফল জনসভা হলো গান্ধী পার্কে। ওই সভায় বক্তৃতা করলেন আবু মো. ফেরদৌস, এম এ গফুর, মিজানুর রহিম, জাহিদুল হক প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। অগ্নিঝরা বক্তৃতা। ওই প্রতিবাদ সভায় রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবির পাশাপাশি নূরুল আমিন সরকারের পদত্যাগ দাবি করা হলো। ওই রাতেই ঢাকা থেকে নির্দেশ এলো ভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠন করতে হবে এবং ২৫ তারিখে সারা দেশে পূর্ণ দিবস হরতাল পালন করতে হবে। নির্দেশমতো, ১১ সদস্যের ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলো। সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক হলেন এম এ গফুর, সদস্য আবু মোহাম্মদ ফেরদৌস, এম এ জলিল, নূরুল ইসলাম, এম এ বারী, এ কে সামসুদ্দীন সুনু মিয়া, আলতাফ হোসেন খান, কে এ হাফিজ, জাহিদুল হক, মিজানুর রহিম ও মডেল স্কুলের কেরানি খন্দকার এনামুর রহিম।
সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতা কাজী নূরুল ইসলাম ঢাকা থেকে এরই মধ্যে দৌলতপুর পৌঁছালেন, তিনি ঢাকার হত্যাকাণ্ডের লোমহর্ষক বর্ণনা দিলেন। উপস্থিত সবাই বর্ণনা শুনলেন- শিউরে উঠলেন। খুলনার আন্দোলন নতুন মাত্রা পেল। ২৫ তারিখে সফল হরতাল পালিত হলো। হরতালের পর ২৮ তারিখে গান্ধী পার্কে জনসভা আহ্বান করা হলো। কে এ হাফিজের সভাপতিত্বে ওই বিশাল সভায় বক্তৃতা করলেন এম এ গফুর, আলতাফ হোসেন খান, এ এফ এম আবদুল জলিল, আবদুল জব্বার, এ এইচ দেলদার আহম্মদ, গোলাম শহীদ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। ওই সময় খুলনায় ভাষা সংগ্রামের আর এক নেতা সমীর আহম্মেদের সম্পাদনায় ‘সবুজ পত্র’ নামের একটা মাসিক পত্রিকা খুলনা থেকে বের হতো। ওই পত্রিকায় থাকত ভাষার দাবির সমর্থনে নিবন্ধ, থাকত আন্দোলনের সব খবর। এদিকে মুসলিম লীগ সরকারের চামচারা কিন্তু হাত গুটিয়ে বসে ছিল না, তারাও মেতে উঠল নানা ষড়যন্ত্রে। একদিন পুলিশ হানা দিল সুনুমিয়ার লাইব্রেরিতে। সেখান থেকে তারা উদ্ধার করল ভাষার দাবি সংবলিত পোস্টার। ওরা বলল, ওগুলো নাকি রাষ্ট্রবিরোধী পোস্টার। ওগুলো সিজ করে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে মামলা করা হলো। গ্রেপ্তার হলেন আবু মোহাম্মদ ফেরদৌস, এম এ বারী, নূরুল ইসলাম ও সুনু মিয়া। পুলিশের সঙ্গে যোগ দিল সবুর সাহেবের ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনী। তারা ভাষাসংগ্রামী সমীর আহম্মেদকে ধরে নিয়ে মারপিঠ করল। একইভাবে তাদের আক্রমণ মারাত্মক আহত হলেন এম এ গফুর ও আবু মোহাম্মদ ফেরদৌস। রাষ্ট্র ভাষার দাবিতে বাঙালি রচনা করল অবিনাশী ইতিহাস। লেখায় লেখায় অবিনাশী পঙতিমালার সে ইতিহাস আজ মা, মাটি মাতৃভূমি এবং আমাদের জাতিসত্তার প্রতি সুগভীর ভালোবাসার অবিনশ্বর মহিমায় উদ্ভাসিত। খুলনাসহ দেশের অন্যত্র সেদিনের আন্দোলন অসংগঠিত হলেও তা ছিল তপ্ত আবেগে প্রাণবন্ত। বাঙালির সেই প্রাণাবেগই একুশেকে বিশ্বসভায় স্থান করে দিয়েছে। একুশ এখন বিশ্বব্যাপী মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত।
লেখক : গবেষক, কপিলমুনি, খুলনা।