নুসরাতের কবরে সাদা ফুল আর…
নুসরাত হত্যার রায়ের আগের রাতে খুবই চিন্তা হচ্ছে, কখন ঘুম থেকে উঠব। সময় মতো উঠতে পারব তো। এসব চিন্তা করতে করতে ঘুমালাম। তার আগে সহকর্মী ফটোগ্রাফার ইব্রাহিম ভাইকে কিছু পরিকল্পনার কথা বলে রাখলাম। ভোর ৬টায় ঘুম থেকে উঠেই প্রস্তুতি শুরু করি। সহকর্মীদের নিয়ে হোটেলে নাস্তা সেরে সকাল ৮টার মধ্যে ফেনী আদালতের সামনে পৌঁছাই। তখন কিছু পুলিশ কোর্টের গেটে দাঁড়িয়ে আছে। তখনো আদালতের গেট খুলেনি। তবে নিরাপত্তা নিয়ে দায়িত্বরত পুলিশ অফিসারের সঙ্গে কথা বলে একটি নিউজ ধরালাম।
তখন জানার চেষ্টা করছি; কখন কারাগার থেকে আসামিদের আনা হবে। স্নায়ু চাপ বেড়ে চলেছে। এর মধ্যেই সকাল ৯টায় আদালতের গেট খুলে দেওয়ায় রায় প্রদানকারি বিচারকক্ষ রেকি করে আসি। এজলাসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে পরিচিত হয়ে রায়ের পরপর রায়ের কপি যেন দেন, সে বিষয়ে সহযোগিতা করতে বলি। এর মধ্যে সংস্থার একজন কর্মকর্তা এসে বললেন সাংবাদিকদের বিচারকক্ষে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। তখন যেন আকাশ ভেঙে পড়ল মাথার ওপর। চিন্তা করছি, বিচারকক্ষে প্রবেশ করতে না পারলে রায়ের সময়ের যে দৃশ্য, সেটি নিয়ে তো নিউজ করতে পারব না। আর ঢাকা থেকে আসাটাই বৃথা। পরে ওই কর্মকর্তাকে বিভিন্নভাবে বোঝানোর চেষ্টা করি, সাংবাদিকরা ভেতরে প্রবেশ করতে না পারলে সমস্যা হবে। এত কষ্ট করে ঢাকা থেকে আসার দরকার ছিল না। আইনজীবী থেকে রায় জেনে নিউজ করা যেত। এ সময় আমি গিয়ে বিচারক মামুনুর রশিদের ব্যক্তিগত কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলি। বিষয়টি জানানোর পর তিনি বিচারকের অনুমতি নিয়ে সাংবাদিকদের বিচারকক্ষে প্রবেশ করান।
পরে বেলা ১০টা ৫০ মিনিটে আসামিদের একে একে এজলাসে হাজির করা হয়। প্রধান আসামি সিরাজ-উদ-দৌলা লম্বা পাঞ্জাবি ও টুপি পরা অবস্থায় এজলাসে স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ানো। তবে মাস্টার আফছার উদ্দিনকে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন দেখা যায়। তিনি এজলাসে উঠে কান্না করছেন আর প্রার্থনা করছেন। তবে দুই নারী আসামির মধ্যে পপি স্বাভাবিক থাকলেও কামরুন নাহার মণি চার মাসের শিশুকে কোলে নিয়ে এজলাসে দাঁড়িয়ে আছেন অনেকটা অসহায় ভঙ্গিতে। আসামি মো. নুর উদ্দিন, আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমীনকে হাসিখুশি দেখাচ্ছিল। এ ছাড়া অপর সব আসামিই অনেকটা উদ্বেগ উৎকণ্ঠায়। বিচারকক্ষের ডানপাশে কাঠগড়া। এর ভেতরে আসামিরা। তাদের সামনে পুলিশ নিরাপত্তা দিয়ে দাঁড়িয়ে। মাঝখানে আইনজীবী, সাংবাদিক ও কয়েকজন মানবাধিকার কর্মীতে ঠাসা। ঠিক ১১টা ৬ মিনিটে রায় পড়া শুরু করেন ফেনী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ। রায়ের প্রথম অংশে এ মামলায় অত্যন্ত দ্রুত অভিযোগ গঠন ও সাক্ষী হাজিরার জন্য তদন্ত কর্মকর্তাকে ধন্যবাদ জানান। এবং আইনজীবীদের সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ জানান। একই সঙ্গে এ বর্বোরোচিত ঘটনা মানুষের সামনে তুলে ধরার জন্য মিডিয়াকে ধন্যবাদ জানান। এরপর তিনি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।
এরপর চূড়ান্ত রায় ঘোষণার আগে আদালত তাঁর পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা ফেনী জেলার অন্যতম বৃহৎ বিদ্যাপীঠ। মাদ্রাসার আলোকোজ্জ্বল ভূমিকায় কালিমালিপ্তকারী এ ঘটনা বিশ্ববিবেককে নাড়া দিয়েছে। নারীর মর্যাদা রক্ষায় ভুক্তভোগী নুসরাত জাহান রাফির তেজোদীপ্ত আত্মত্যাগ তাঁকে এরই মধ্যে অমরত্ব দিয়েছে। তাঁর এ অমরত্ব চিরকালের অনুপ্রেরণা। পাশাপাশি আসামিদের ঔদ্ধত্য কালান্তরে মানবতাকে লজ্জিত করবে নিশ্চয়। বিধায়, দৃষ্টান্তমূলক কঠোরতম শাস্তিই আসামিদের প্রাপ্য।’
এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিচার্য বিষয়কে রাষ্ট্রপক্ষের অনুকূলে সিদ্ধান্ত গ্রহণমূলক আসামিদের পূর্ব পরিকল্পিতভাবে অত্র মামলার ভুক্তভোগী নুসরাত জাহান রাফিকে গত ৬ এপ্রিল সকাল ৯টা ৪৫ থেকে ৫০ মিনিটের মধ্যে মাদ্রাসার সাইক্লোন শেল্টার ভবনের তৃতীয় তলার ছাদে ডেকে নিয়ে ওড়না দিয়ে নুসরাতের হাত-পা বেঁধে তাঁর গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে তাঁকে পুড়িয়ে হত্যা করায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধিত ২০০০ (সংশোধিত/০৩)-এর ৪(১)/৩০ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে সবাইকে দণ্ডিত করা যায়।
এর পরই রায় ঘোষণা করে বিচারক বলেন, ‘এ মামলার সব আসামিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ দেওয়া হলো।
রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বিচারকক্ষে হৈচৈ শুরু হয়ে যায়। সংবাদকর্মীরা রায়ের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য চেষ্টা করেন। অপরপক্ষে আসামিরা চিৎকার, চেঁচামেচি শুরু করেন। মনে হলো, কেয়ামতের ময়দান।
রায় ঘোষণা করেই বিচারক এজলাস থেকে নেমে যান। রায়ের পরপর প্রধান আসামি অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা কান্না করতে থাকেন। অপরদিকে এজলাসে দাঁড়ানো মাস্টার আফছার উদ্দিন কান্নারত অবস্থায় চিৎকার করে বলেন, মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়েছে, আত্মহত্যাকে হত্যা বলে দণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ রায় মানি না। কেয়ামতের মাঠে দেখা হবে! কারাগারে নেওয়ার আগ পর্যন্ত কান্না করতে থাকেন এ আসামি।
অপর আসামি হাফেজ আব্দুল কাদের কান্নারত অবস্থায় চিৎকার করতে করতে বলেন, এ রায় মানি না। এটা সাজানো রায়। মিডিয়ার কারণে আমাদের মিথ্যা সাজা দেওয়া হয়েছে। বিচারক টাকা নিয়ে রায় দিয়েছে। এ সময় নুসরাতের ভাই নোমানকে হুমকি দেন আসামি আব্দুল কাদের। অপর আসামি মো. নুর উদ্দিন রায়ের পর মাথায় হাত দিয়ে এজলাসে কান্না করতে করতে বসে পড়েন।
এ ছাড়া বাচ্চা কোলে নিয়ে আসামি কামরুন নাহার মণি, পপি রায়ের পর কান্নায় ভেঙে পড়েন। আসামিরা সবাই নুসরাতের মা-বাবা ও ভাইকে গালাগাল করতে থাকেন। একইসঙ্গে আসামি হাফেজ আব্দুল কাদের মিডিয়াকে বকাঝকা করতে থাকেন। তবে আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমীন নীরবে কান্না করতে থাকেন। পুলিশ আসামিদের নিভৃত করার চেষ্টা করে। কিন্তু তারা থামছেই না।
এর পরই আইনজীবী সাংবাদিক সবাই নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এভাবে ১০ মিনিট যাওয়ার পর আদালত কক্ষ থেকে নিরাপত্তা দিয়ে নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান, বাবা এ কে এম মুসাকে আদালত থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। এরপর আইনজীবী, সাংবাদিকসহ সবাইকে বিচারকক্ষ থেকে বের করে দেওয়া হয়।
পরে আসামিদের একে একে তিনতলার আদালত কক্ষ থেকে নামিয়ে প্রিজনভ্যানে উঠানো হয়। প্রিজনভ্যানে উঠানোর আগেই জনতার রোষানলে পড়েন প্রধান আসামি সিরাজ-উদ-দৌলা। উত্তেজিত জনতা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে সিরাজ-উদ-দৌলাকে দেখে। অনেকে ধর ধর বলে ধাওয়া করতে থাকে। পুলিশ কড়া নিরাপত্তা দিয়ে প্রিজনভ্যানে উঠালেও কয়েকজন আসামি সিরাজকে বুকে-মুখে চড়-থাপ্পড় মারতে থাকেন। এরপর কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয় আসামিদের।
এদিকে রায়ের পর পর পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি পাওয়ার জন্য বিচারকের অফিস কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করি। তখনো সংবাদকর্মীরা ব্যস্ত রায়ের প্রতিক্রিয়ার জন্য। রায়ের কপি সংগ্রহ করে প্রতিক্রিয়া নিতে শুরু করি। নিচে নামার পর আসামিদের পরিবারের কান্নায় ভারি হয়ে উঠে আদালত প্রাঙ্গণ। কিন্তু নুসরাতের প্রতি বর্বোরোচিত ঘটনায় আসামিদের পরিবারের প্রতি সহানুভূতি দেখানোর কেউ ছিল না। বরং ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশ করে দণ্ড কার্যকরের দাবি তুলে স্লোগান দিতে থাকে সাধারণ মানুষ। সহানুভূতি নিতে পারেনি চার মাসের শিশুকে কোলে নিয়ে ফাঁসির দণ্ড পাওয়া কামরুন নাহার মণিও। বরং বিচারিক আদালতের রায় বহাল রেখে ফাঁসি কার্যকর করার আওয়াজ শোনা গেল বেশি। সাধারণ মানুষ দাবি তোলে দণ্ড দ্রুত কার্যকর করতে হবে। নুসরাতের মতো আর কোনো মেয়ের স্বপ্ন যেন অকালে ঝরে না পড়ে। বর্বোরোচিত হত্যার মাধ্যমে আর কোনো মায়ের বুক যেন খালি না হয়।
লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, এনটিভি অনলাইন।