জাতীয় নির্বাচন
ভোটের উৎসবে থাকুক সমান অংশগ্রহণ
একাদশ জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়েছে এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সাড়ম্বরে মনোনয়ন ফরম বিতরণও শুরু করেছে। নানা দোদুল্যমনতা কাটিয়ে নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের একটা আভাসও এরইমধ্যে লক্ষ করা গেছে। দশম নির্বাচন বর্জন করা বিএনপি জানিয়ে দিয়েছে তারা ঐক্যফ্রন্টকে সাথে নিয়ে জোটগতভাবে এই নির্বাচনে অংশ নেবে। নির্বাচনে অংশগ্রহণটাকেও গণতান্ত্রিক দাবি আদায়ে আন্দোলনের অংশ হিসেবে দেখছে বিএনপি। তবে এখনো যেহেতু তাদের মাঠ গোছানোসহ জোটের অংশীদারদের সাথে বোঝাপড়ার ব্যাপারটা সামলে উঠতে পারেনি তাই ভোটের তারিখ ২৩ ডিসেম্বর থেকে পিছিয়ে পুনঃতফসিলের দাবি জানিয়ে যাচ্ছে তারা।
ভোটের হাওয়ায় জোরদার গুঞ্জন রয়েছে বিরোধীদল ও জোটকে অপ্রস্তুত রেখেই তড়িঘড়ি করে নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে নির্বিঘ্নে তফসিল ঘোষণা করিয়ে ভোটযুদ্ধে নেমে পড়েছে আওয়ামী লীগ। বিভিন্ন দলের সাথে সংলাপ আয়োজনটা ছিল নির্বাচনী ট্রেনে ওঠার পথ প্রশস্ত করবার উপলক্ষ মাত্র। সরকারি দল ভালোই জানতবিরোধী জোটের সাত দফা তারা মানবে না। কারণ তাদের সামনে রাখা আছে সাংবিধানিক রক্ষাকবচ। তারপরও সব দলের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী দাবি-দাওয়ার সংলাপও হলো (সাপও মরল) আবার ভোট বাধাগ্রস্তও হলো না (লাঠিও ভাঙল না)। সরকার কূটকৌশলে ধরাশায়ী করতে চেয়েছিল নির্বাচনমুখী বিরোধী জোটকে। কিন্তু বিএনপি ও তাদের জোটের নির্বাচনে অংশগ্রহণের ইচ্ছেটাকে আপাতত গণতন্ত্রের পালে স্বস্তিকর হাওয়া হিসেবেই ধরা যেতে পারে।
আগের নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি আওয়ামী লীগকে যেভাবে বিনাযুদ্ধে সূচাগ্র মেদিনী পাইয়ে দিয়েছিল এবার সময় এসেছে সেই ভুলের নিদান খুঁজবার। যেকোনো অবস্থাতেই ভোটে না যাওয়া ছাড়া অন্য বিকল্প ভাবাটা এখন অর্বাচীনতারই নামান্তর হতে পারে। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল বিএনপির নিজেকে ফিরে পাবার একমাত্র মোক্ষম সুযোগ হলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা। কাউকে বারবার এককভাবে ওয়াকওভার দিয়ে শক্তিশালী বিরোধীদলবিহীন শীতল সংসদ গড়ার সুযোগ দেওয়া মানে গণতন্ত্রের অধঃপতন।
ব্যক্তি বা সামষ্টিক মানুষ কিংবা কোনো গোষ্ঠী কেউই ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। বিএনপিরও অতীত ভুলের কালিমা রয়েছে। তাদের দলের প্রধানতম দুই কাণ্ডারির একজন জেলে এবং অপরজন মাথায় দণ্ড নিয়ে লন্ডনে নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন। দণ্ড, নির্বাসন, মামলা বা জেলের উপযোগ্যতা নিশ্চিতই ইতিহাসের নিক্তিতে পরিমাপযোগ্য। কিন্তু এখনকার এমনতর সংকটের ঘূর্ণাবর্ত থেকে ফিরতে হলে তাদের নির্বাচনে আসার কোনো বিকল্প নেই। জনগণকে আস্থায় নিয়েই তাদের বোঝাতে হবে তারাও দেশ ও দশের জন্য কাজ করার সক্ষমতা রাখে। কার্যকরণ বা মানবসেবার নিরিখে দেশের কোনো দলই তাদের একক শক্তিশালী মনে করে না। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভোটের বৈতরণী পার হতে ১৪ দল, ইসলামী দল, বাম দল লাগে।
সেক্ষেত্রে বিএনপির নিজেকে ২০ দল বা ঐক্যজোটে শামিল হওয়া দোষের কিছু না। বরং বিএনপি ঘোষণা দিয়ে বলতে পারত তাদের সাথে প্রতিক্রিয়াশীল ও যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতে ইসলামী নেই। কিন্তু আওয়ামী লীগের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে আছে স্বৈরাচার এরশাদের জাতীয় পার্টি। সেক্ষেত্রে বিএনপি বরং আওয়ামী লীগের চেয়ে আলাদা। কিন্তু তারা তা পারেনি। অবশ্য ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্ট ঘোষণা দিয়েই জামায়াতকে আড়ালে রেখেছে। এমন বাস্তবতায় সবার সমান অংশগ্রহণমূলক অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে কার কী ফলাফল হবে তা কেউ আগাম বলতে না পারলেও গণতন্ত্রের জন্য আপাতত এটুকুই শুভবার্তা যে, নৌকার সাথে ধানের শীষও থাকছে ব্যালটপেপারে।
তফসিল ঘোষণায় তাড়াহুড়া করতে গিয়ে এরইমধ্যে নির্বাচন কমিশনও তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। গণপ্রতিনিধিত্ব আইন অনুযায়ী প্রতীক বরাদ্দের পর প্রার্থীরা ২১ দিন প্রচারণার সময় পাওয়ার কথা। কিন্তু ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী সময় দেওয়া হয়েছে ২৩ দিন। এর কী হেতু তা কেউ না বলতে পারলেও নির্বাচন কমিশন বলছে, তাদের ক্ষমতা অগাধ। হাস্যকর সত্য হলো, অগাধ ক্ষমতা থাকা মানেই লিপিবদ্ধ আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে যা খুশি তা করবার অধিকার পাওয়া নয়। অন্যদিকে, আসন্ন নির্বাচনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের পর্যবেক্ষক না পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে। এতে আগামী নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতাও প্রশ্নবিদ্ধ থাকার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। মানবাধিকার নিশ্চিতকরণ ও গণতন্ত্রকে সহায়তার মাধ্যমে নাগরিকের মত প্রকাশের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে বৈশ্বিক সমর্থনের বিকল্প নেই। কারণ আমাদের অর্থনীতি এখনো চায়না বা সৌদি আরবের মতো ইস্পাত কঠিন নয় যে, চাইলেই আমরা কাউকে পরোয়া না করে আজীবনের জন্য একপাক্ষিক ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করবার আইন পাস করে ফেলতে পারি! এমন বাস্তবতায় সরকারি দলই বরং চাপে থাকবে বৈশ্বিকভাবে সর্বজন গ্রহণযোগ্য একটি সুন্দর নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে। এই সুবর্ণ সুযোগটাই বিরোধীজোট কাজে লাগাতে পারে।
এখন পর্যন্ত দেশের আপামর জনসাধারণের ভবিষ্যৎ তাদের নিজের হাতে রাখতে নির্বাচনটাই একটা বর্ম। দুর্বার পাহারায় সেই বর্মকে শক্তিশালী না করে মানুষকে মাথা তুলে দাঁড়াবার আর কোনো পথ খোলা নেই। সেই অর্থে বিএনপি ও তাদের জোট নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার জন্য সাধুবাদ পেতে পারে। আপনি ভোট চুরির অভিযোগ করবেন, ইভিএম নামের ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যহারের মাধ্যমে জনমত ম্যানিপুলেট করা হবে বলে সংশয় প্রকাশ করবেন কিন্তু ভোটের মাঠে থাকবেন না তা হতে পারে না। ভোট বর্জনের অর্থ হবে অসাধুকে তার মনস্কামনা বাস্তবায়নের সহজ সুযোগ দেওয়া। ভোটে যদি ক্ষমতা নাও পান, রুলিং পার্টির স্বেচ্ছাচারিতার বিরোধিতা করবার মতো পবিত্র দায়িত্বকে তো অবহেলা করতে পারেন না।
আমরা জানি না বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে খাদের কিনারে থাকা বিএনপির খারাপ সময় কীভাবে দূর করবেন কামাল হোসেন, আ স ম আব্দুর রব, কাদের সিদ্দিকী বা মাহমুদুর রহমান মান্নারা। ভোটে জয় পেলে কার কীভাবে পদায়ন হবে সে ব্যাপারেও ভোটাররা ধোঁয়াশার মধ্যে আছেন। কারণ জোটের রাজনীতির ফলাফল ভাগের হিসেবনিকেশ এখনো ফলাও করা হয়নি। আপাত দুর্বল বিএনপি যাদের ওপর সওয়ার হয়েছে তারা শেষবিচারে দেশ ও দশের জন্য কতটা মঙ্গলজনক তা কেউ জানে না। তবে আমরা এই মুহূর্তে এইটুকু নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে চাই যে, ডিসেম্বরের পার্লামেন্ট নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণ থাকছে এবং আমরা এটাও বিশ্বাস করতে চাই যে, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে আস্থাবান, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী অসাম্প্রদায়িক, মানবতাবাদী, সংস্কৃতিবান ও ধর্মীয় গোঁড়ামিমুক্ত উদারনৈতিক ভোটাররা তাদের ইচ্ছেমতো ভবিষ্যৎনিধি নির্বাচনের সুযোগটুকু পাবেন।
দেশের মানুষ নিরাপত্তা চায়। শান্তিতে থাকতে চায়। তারা চায় অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার নিশ্চয়তা। মানুষ চাকরি চায়, নিরাপদে ব্যবসাবাণিজ্য করতে চায়। সভ্যতা ও সম্ভাবনায় দেশের সুনাম ও মানুষের সুখটাকে বাড়িয়ে তুলতে কোন অর্থে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের চেয়ে অন্য কোন জোট অধিকতর ভালো তা কথা ও কার্যাবলীতে প্রমাণের দায়িত্ব তাদেরই। সাতচল্লিশ বছর বয়সী দেশটার অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটছে এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর চেয়ে মানবিক সব সূচকেও আমরা অগ্রগামী, কিন্তু ভালো কাজের কাজিদের এখানে দাম নেই। শাসকদলের বিজয়ে এখনো অপকৌশলই নাস্তি। অহিংস ও শান্তিবাদী গণতন্ত্রের দেখা আমরা পাইনি। এখনো সহনশীল ও পরমতসহিষ্ণু সভ্যতার ছিটেফোঁটাও আমরা রপ্ত করতে পারিনি। আলোকময় সে সভ্যতার সন্ধান দিতে পারে কোথায় সেই মহামানব?
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন