সীমানা পেরিয়ে
মরে বেঁচেছে আয়লান, ফেলানীরা
দিনভর দস্যিপনা করে ক্লান্ত হয়ে আপনার কলিজার টুকরো যখন হাত-পা ছুড়ে মুখ উল্টে ঘুমায়, পরম মমতা নিয়ে আপনি হয়তো ওর কপালে চুমু দেন, ঠিক করে শুইয়ে দিয়ে ওর কনে আঙুলে একটু আলতো কামড় দেন যেন নজর না লাগে। কী করবেন? চোখ ফেরানো যায় না যে। ওমন মায়ামাখা মুখ থেকে চোখ সরানোর সাধ্য বিধাতা কোনো মা-বাবাকেই দেননি। হয়তো ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আপনার চোখ ভিজে ওঠে আনন্দে আর ভালোবাসায়। কিন্তু গত বুধবারের পর থেকে আপনার শিশুর ঘুমন্ত মুখের দিকে যতবার আপনার চোখ গেছে ততবারই নিশ্চয়ই আপনার মন অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠেছে, রাতভর চোখের পাতা এক করতে পারেননি। কারণ, চোখ বন্ধ করলেই যে চোখের সামনে ভেসে ওঠে লাল জামা, নীল প্যান্ট আর আদুরে ছোট্ট দুটো জুতো পরা পা। সিরীয় শিশু আয়লান যেন সারা বিশ্বের সব মা-বাবার চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। আয়লানের বাবা আবদুল্লাহ কুর্দির মতোই সব বাবারই একটাই আফসোস, ইস্ হাতটা যদি ফসকে না যেত। হয়তো ঘুমের ঘোরে দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠে অনেক বাবা, পাশে ঘুমন্ত শিশুটিকে দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে আয়লানের কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুমাতে যান। কিন্তু আবদুল্লাহর জীবনের এই দুঃস্বপ্ন তাকে তাড়িত করবে আমৃত্যু।
এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। আয়লানের পরিবারকে অভিবাসী হিসেবে গ্রহণ করতে বারবার অস্বীকৃতি জানিয়ে ফিরিয়ে দেয় কানাডা। ভালোভাবে বেঁচে থাকার আশায় জীবনকে বাজি রেখেই আবদুল্লাহ-রেহানা দম্পতি ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে গ্রিসে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। মানবতার নিষ্ঠুরতাকে পরিহাস করতেই যেন সাগর কেড়ে নেয় তিন বছর বয়সী আয়লান আর তার ভাই গালিবের জীবন, মা রেহানাও মরে গিয়ে বেঁচে গেলেন, সন্তানের নিথর দেহ তাঁকে দেখতে হলো না। সাগর তার বিশালত্বের প্রমাণ দিল ঘুমন্ত আয়লানের দেহ মানুষের কাছেই ফিরিয়ে দিয়ে, যাতে জেগে-ঘুমিয়ে থাকা মানুষগুলো যেন মুখোশের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে।
বিপজ্জনকভাবে ইউরোপে পাড়ি জমাতে গিয়ে ভূমধ্যসাগরে ডুবে এ বছরই আড়াই হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে আয়লানের মতো। জঙ্গি সংগঠন আইএসের হাত লন্ডভন্ড সিরিয়া থেকে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার মানুষ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছে জীবনবাজি রেখে। যুদ্ধ দারিদ্র্যকবলিত মধ্যপ্রাচ্যসহ এশীয় দেশগুলো থেকে ইউরোপে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে দিনদিন। ভালোভাবে বেঁচে থাকার আশা ভয়ংকর সাগরে ছোট ছোট রাবারের নৌকায় পাড়ি দেওয়ার দুঃসাহস জুগিয়েছে অসহায় মানুষগুলোকে। এই যখন পরিস্থিতি, তখন সারা বিশ্বে শান্তির বাণী বিলিয়ে বেড়ানো আমেরিকা দর্শকের ভূমিকায়, আভিজাত্যের গরিমায় যুক্তরাজ্য দিবাঘুমে মগ্ন, ধনী আরববিশ্ব নিশ্চুপ আর নাক উঁচু ইউরোপ তখন অভিবাসী ঠেকাতে নতুন নতুন আইন করতে ব্যতিব্যস্ত। সেই সময় তুরস্কের সীমান্তসৈকতে শিশু আয়লানের বালুতে মুখ গুজে শুয়ে থাকার ছবি বিশ্বমোড়লদেরই যেন ব্যঙ্গ করেছে। তুর্কি সাংবাদিক নিলুফার দেমির তোলা ছবিটি ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন শীর্ষস্থানীয় পত্রিকার শিরোনামে আসে। পাথরের চোখেও অশ্রু ঝরে। ছবি প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ফ্রান্স জার্মানি সিদ্ধান্ত নেয় নির্ধারিত সংখ্যায় অভিবাসনপ্রত্যাশীদের জায়গা দিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যদেশগুলোকে বাধ্য করা হবে। এমনকি আভিজাত্যের কথা ভুলে যুক্তরাজ্যও কয়েক হাজার সিরীয় শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ার ঘোষণা দেয় যুক্তরাজ্য। জীবন্ত প্রাণবন্ত ছোট্ট আয়লানকে বারবার প্রত্যাখ্যান করলেও মৃত আয়লানকে উপেক্ষা করতে পারেনি ইউরোপীয় মোড়লরা। মৃত্যু ধর্ম জাতি-পরিচয় সবকিছুর ঊর্ধ্বে নিয়ে গেছে আয়লানকে। আয়লান এখন শান্তিতে ঘুমানোর সুযোগ পেয়েছে। হয়তো আয়লানের মৃত্যু আরো কয়েক হাজার কয়েক লক্ষ আয়লানের জীবন বাঁচাতে পারবে।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শরণার্থীদের মধ্যে আছে বাংলাদেশিরাও। ভূমধ্যসাগরে মৃত্যুর মিছিলে তারাও আছে। আয়লানের ছবিটি দেখে বারবার শুধু মনে পড়ছিল টেকনাফে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে নাম না জানা ছোট্ট শিশুটির কথা। অভিবাসী সমস্যা বাংলাদেশেও কম নয়। পশ্চিম মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী মুসলিম রোহিঙ্গারা সেখানকার সরকার এবং রাখাইন জনগোষ্ঠীর হাতে নির্যাতিত হয়ে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে এ দেশে প্রবেশ করছে বহুদিন থেকে। মায়ানমার সরকারের সঙ্গে বারবার আলোচনা করেও রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক কোনো সমাধান হয়নি। সরকারি হিসাবমতে, পাঁচ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে বর্তমানে বসবাস করছে। এ হিসাবের বাইরেও অনেক রোহিঙ্গা বিয়ে-শাদির মাধ্যমে বাংলাদেশিদের সঙ্গে মিশে গেছে। বিভিন্ন সময় সরকার ও সে দেশের রাখাইন সম্প্রদায়ের নির্যাতনের কারণে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয় মুসলিম রোহিঙ্গারা। জাতিসংঘের তথ্যমতে, রোহিঙ্গারা বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী।
রাখাইন রাজ্যে বসবাসরত রোহিঙ্গা মুসলমান সংখ্যালঘুদের দীর্ঘমেয়াদে পৈতৃক ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদের পরিকল্পনা নিয়েছে দেশটি। আদমশুমারির গণনা থেকে বাদ দেওয়ার পর তাদের বাঙালি হিসেবে জোরপূর্বক নিবন্ধনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এতেই বোঝা যায় দেশটি তার অমানবিক রাষ্ট্রীয় চরিত্র থেকে বেরিয়ে এসেছে। বাংলাদেশের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে চরম অপ্রতিবেশীসুলভ আচরণেরও বহিঃপ্রকাশ এটি। কক্সবাজার-বান্দরবান সীমান্ত হয়ে রোহিঙ্গা ব্যাপক হারে বাংলাদেশ আসতে শুরু করে ১৯৯২ সাল থেকে। ১৯৫৪ সালের কূটনৈতিক আশ্রয়দান সংক্রান্ত কনভেনশন অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিলেও এদেরকে আর ফিরিয়ে নিচ্ছে না মায়ানমার সরকার। এরপর জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় আড়াই লাখের মতো শরণার্থী দেশে ফেরত পাঠানো হলেও বাকিদের নিতে গড়িমসি করছে মিয়ানমার। কক্সবাজার ও আশপাশের সীমান্ত পেরিয়ে প্রায় প্রতিদিনই বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। বছরের পর বছর বাংলাদেশে এই রোহিঙ্গা শরণার্থীরা সংকট সৃষ্টি করছে। তাই রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা এখন বিপুল জন-অধ্যুষিত বাংলাদেশের জন্য ‘গোদের ওপর বিষ ফোঁড়া’র মতো। রোহিঙ্গারা এখন বাংলাদেশিদের নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। এসব রোহিঙ্গা বিদেশে গিয়ে বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গেও জড়িত হয়ে পড়ছে, যার দায় পড়ছে বাংলাদেশিদের ওপর। বলার অপেক্ষা রাখে না এর ফলে বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশিদের ইমেজ নষ্ট হচ্ছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক মহলের সহযোগিতা দূরে থাক, বরং আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে বাংলাদেশ সরকারের ওপর ক্রমাগত চাপ দিয়ে যাচ্ছে। ২০০৫ সাল থেকে থমকে আছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কার্যক্রম। মাঝে উদ্যোগ নিলেও তার কোনো অগ্রগতি নেই। তবে, মিয়ানমারে নিরাপত্তা পেলে দেশে ফিরতে চান রোহিঙ্গারা।
আজ বিশ্ব মিডিয়ায় ইউরোপীয় সীমান্তে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের পানীয় ফুল আর বাচ্চাদের খেলনা দিয়ে বরণের ছবি টিভি-পত্রিকায় দেখে বাংলা সিনেমার সংলাপ মনে পড়ছে, গরিবের ভালোবাসার কোন মূল্য নেই। কারণ, সাগর পাড়ি দেওয়া ক্লান্ত-ক্ষুধার্ত মানুষগুলোকে খাবার দিয়ে, আশ্রয় দিয়ে এমনকি সরকারিভাবে জমি দিয়েও বাঁচতে দিয়েছে বাংলাদেশের মতো গরিব একটা দেশ। আমরা অন্তত সাগরের মাঝখানে অভিবাসনপ্রত্যাশী নারী-শিশুসহ অসহায় মানুষগুলোকে দিনের পর দিন না খেয়ে মরে যেতে বাধ্য করিনি, থাইল্যান্ড কিংবা ইউরোপীয় দেশগুলোর মতো। দাঙ্গা পুলিশ দিয়ে হাঙ্গেরী কিংবা অস্ট্রিয়ার মতো মাঝপথে ট্রেন থামিয়ে মাইলের পর মাইল হাঁটতে বাধ্য করিনি, শত শত পরিবারকে যাদের মধ্যে কত শিশুও আছে। বলছি না অবৈধভাবে অন্য দেশে প্রবেশ করা যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু আরব বিশ্বে তেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে বিশ্বমোড়লরা যখন আইএসের মতো জঙ্গি সংগঠনকে উসকে দেয়, গরিব দেশগুলো যখন যুদ্ধ আর দারিদ্র্য থেকে বাঁচার জন্য হাসফাঁস করে তখন কোথায় যায় তাদের মানবতার নামে সুন্দর সুন্দর বুলি? মিয়ানমারকে তাদের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের পক্ষে চাপ না দিয়ে উল্টো জাতিসংঘ বাংলাদেশকেই অনুরোধ করছে রোহিঙ্গাদের যেন বিপদের মুখে ঠেলে না দেয়। এমনকি রোহিঙ্গাদের প্রকৃত সংখ্যা তারা হাজারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখছে, যেখানে মূল সংখ্যা পাঁচ লাখেরও বেশি।
একদিকের প্রতিবেশী মিয়ানমারের এমন অকৃতজ্ঞ আচরণ, অন্যদিকে আরেক প্রতিবেশী ভারতও বন্ধুত্বের চরম নিদর্শন দিতে পিছিয়ে নেই। ছোট্ট আয়লানের নিথর দেহ বাংলাদেশিদের মনে কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলে থাকা ফেলানীর কথা নিশ্চয়ই মনে করিয়ে দেয়। মানুষ হিসেবে নয়, ধনী দেশগুলোর কাছে মানুষের বড় পরিচয় তার ধর্ম আর জাতীয়তা। ফেলানীকে গুলি করে মারতে এতটুকুও হাত কাঁপেনি বিএসএফের বীর (!) সৈনিকের। ভারতীয় আদালতে ফেলানীর মা-বাবা তো ন্যায়বিচার পেলেনই না, উল্টো সে দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হলো, ফেলানীর মৃত্যুর দায় তার বাবারই, কেন সে মেয়েকে নিয়ে অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে বলব আবদুল্লাহ কুর্দি কিছুটা হলেও বেঁচে গেছেন, কারণ কেউ তাঁকে এখন পর্যন্ত অভিযুক্ত করেনি তাঁর প্রাণের চেয়েও প্রিয় সন্তান আর প্রিয়তমা স্ত্রীর মৃত্যুর জন্য তিনিই দায়ী, কেন না তিনি অবৈধপথে সাগর পাড়ি দিচ্ছিলেন।
লেখক : সাংবাদিক