আন্তর্জাতিক
ইরান ইস্যুতে কেন ও কীভাবে নেতানিয়াহুকে হারালেন ওবামা?
ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে এতক্ষণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার মাথার ওপর থেকে বিশাল বোঝা দূর হয়ে যাওয়ার কথা। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য (যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য) ও জার্মানির তথা পি৫+১-এর সঙ্গে ইরানের চুক্তি নিয়ে বিশ্বের যেকোনো স্থানের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রেই আলোচনা হয়েছে বেশি। কারণ, দেশটির সবচেয়ে বড় মিত্র ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত এটি। আর যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েল ও ইসরায়েল সরকারের বন্ধুর যে অভাব নেই, তা কে না জানে? তাই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু যখন প্রথম থেকেই ইরানের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে ইরানের সঙ্গে বিশ্বশক্তিগুলোর যেকোনো চুক্তির বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নিয়েছিলেন, তখন চুক্তির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে কথা বলার মানুষের অভাব হয়নি। গুপ্তচরবৃত্তি করে ইসরায়েল যখন বুঝতে পারল, ইরানের সঙ্গে গোপনে আলাপ-আলোচনা চালাচ্ছে আমেরিকা, তখনই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন নেতানিয়াহু। পরে তো ওবামার সঙ্গে গোপনে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনির চিঠি আদান-প্রদানের বিষয়ও প্রকাশ্যে এসেছে। নেতানিয়াহু সব টের পাওয়ার পর বেশ আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে জড়িত বিজ্ঞানীদের একের পর এক হত্যা ও অপহরণে এবং পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোর কম্পিউটার নেটওয়ার্কে ভয়ানক স্টাক্সনেট ভাইরাস প্রবেশ করানোর পেছনে ইসরায়েলের হাত রয়েছে বলে ভাবা হয়। নেতানিয়াহু একপর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়াই ইরানের ওপর হামলা চালানোর হুমকি দেন। এ বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রকে ওবামা প্রশাসনকে সবচেয়ে ভাবিয়ে তোলে। কেননা, ইরানে ইসরায়েল অভিযান চালালে যুক্তরাষ্ট্রকে অবধারিতভাবে জড়াতে হবে। না জড়ালেও মধ্যপ্রাচ্যে শুরু হতে পারে আরেকটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ, যা কিছুতেই আমেরিকা চায় না। ওবামার জন্য সুবিধা হয়েছে, খোদ ইসরায়েলের বেশির ভাগ শীর্ষ সামরিক ও মোসাদ কর্মকর্তা ইরানের ওপর হামলা চালানোর বিপক্ষে মত দিয়েছেন।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে উদ্বেগের সীমা ছিল না পশ্চিমা দেশগুলোর। একপর্যায়ে, ইরানকে অনেক আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিনিময়ে পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধের প্রস্তাব দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এ নিয়ে দীর্ঘদিন দরকষাকষির পর গত ১৪ জুলাই ইরান ও পি৫+১ একটি চুক্তিতে আসে। চুক্তির আওতায় ইরান নিজেদের সংগ্রহে থাকা বিভিন্ন মাত্রার ইউরেনিয়ামের ৯৮ শতাংশ ধ্বংস করবে, আগামী ১৫ বছরের জন্য সেন্ট্রিফিউজের সংখ্যা কমিয়ে ফেলবে দুই-তৃতীয়াংশ ও নতুন কোনো পারমাণবিক কেন্দ্র স্থাপন করবে না, পুরোনো পারমাণবিক কেন্দ্রগুলো গবেষণাকেন্দ্রে রূপান্তর করে ফেলবে ইত্যাদি। এসব পারমাণবিক কেন্দ্র যখন ইচ্ছা তখন পরিদর্শন করতে পারবে আন্তর্জাতিক অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি। এ ছাড়া কোনো কেন্দ্র নিয়ে সন্দেহ হলেও তা যাচাই করার সুযোগ থাকবে। অপরদিকে বিশ্বশক্তিগুলো ইরানের ওপর আরোপিত বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করবে, বিভিন্ন দেশে বাজেয়াপ্ত ইরানের প্রায় ১০ হাজার কোটি ডলার ফিরিয়ে দেবে। আর আট বছর পর দেশটিতে ব্যালাস্টিক মিসাইল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা ও পাঁচ বছর পর দেশটিতে প্রচলিত সমরাস্ত্র রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবে। এ অর্জন সহজ ছিল না। পদে পদে ইসরায়েলি বাধা মোকাবিলা করতে হয়েছে সবাইকে। এমনকি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিসহ অন্যান্য বিশ্বশক্তির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও কূটনীতিকরা যখন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভাদ জারিফ ও তাঁর দলের সঙ্গে সুইজারল্যান্ডে ও অস্ট্রিয়ায় আলোচনা করেছিলেন, তখনো সেখানে গুপ্তচরবৃত্তি চালিয়েছিল ইসরায়েল। এ নিয়ে সুইজারল্যান্ড পুলিশ একটি তদন্তও শুরু করেছে।
কিন্তু চুক্তির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে রক্ষণশীল রিপাবলিকানদের সঙ্গে নিয়ে নেতানিয়াহু যে আক্রমণ শুরু করেছিলেন, তা বেশ সফলভাবেই সামাল দিয়েছেন ওবামা। ইরান চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পরপর বিস্তারিত জানার আগেই একযোগে বিরোধিতা শুরু করে রিপাবলিকান পার্টি, নেতানিয়াহু ও ইসরায়েলি প্রভাবশালী লবিগুলো। কেবল একটিমাত্র নতুন ইসরায়েলপন্থী সংগঠন যুক্তরাষ্ট্রব্যাপী চুক্তিবিরোধী প্রচারণায় দুই কোটি ডলার খরচের ঘোষণা দেয়, যা ছিল একটি রেকর্ড! এ জন্যই হয়তো এ ইস্যুতে জনসমর্থন এখনো ওবামার প্রতি বৈরী। কিন্তু চুক্তির পক্ষের শিবিরের জবাব, ইসরাইলি সরকার যদি বিরোধিতা না করত, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রে এ চুক্তির বিরুদ্ধে এত বিশাল প্রচারাভিযান চালানো হতো না। ফলে জনসমর্থনও বিরূপ হতো না।
ওদিকে রিপাবলিকানরা কংগ্রেসে চুক্তির বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাসের ঘোষণা দেয়। কিন্তু ওবামা ওই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভেটো দেবেন বলে আগেই জানিয়ে রাখেন। ওই ভেটো ধরে রাখতে হলে সিনেটে ৩৪টি ভোট প্রয়োজন ছিল তাঁর। গত বুধবার তিনি এরই মধ্যে তা পেয়ে গেছেন। এমনকি এখনো যদি আরো সাতটি ভোট নিজের পক্ষে জোগাড় করতে পারেন, তাহলে নিজের ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগই করতে হবে ওবামার।
কিন্তু কীভাবে আপাত এ বাধা টপকালেন ওবামা? কীভাবে কোটি ডলারের প্রচারণা ও বিপুল প্রতিকূলতা সত্ত্বেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এলেন তিনি? নিউ ইয়র্ক টাইমসের উত্তর, সমন্বিত কৌশল। মার্কিন সিনেটের আগস্ট বিরতিতে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা প্রায় ডজনখানেক ডেমোক্রেট সিনেটরকে নিয়ে রাজধানীতে বৈঠকে বসেন পি৫+১-ভুক্ত দেশগুলোর জ্যেষ্ঠ কূটনীতিকরা। বৈঠকে সিনেটরদের কূটনীতিকরা একটি পরিষ্কার বার্তা দেন – ইরানের সঙ্গে বর্তমান পারমাণবিক চুক্তিটিই তাদের সামর্থ্যের সর্বোচ্চ। আবারও আলোচনার টেবিলে ফিরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছাই তাদের নেই। দুনিয়ার ইতিহাসে এর আগে যত পারমাণবিক চুক্তি হয়েছে, তার কোনোটিই ইরান চুক্তির মতো কঠোর ও কড়া নয়। ওই বৈঠকে অংশ নেওয়া সিনেটর ক্রিস কুনস বলেন, তারা (পাঁচটি দেশের কূটনীতিকরা) মূলত সর্বসম্মতিক্রমে যা বলেছে তা হলো, আবারও যদি তোমরা (যুক্তরাষ্ট্র) নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে চাও, করো। তবে আমাদের পাশে পাবে না।
অনেক সিদ্ধান্তহীন ডেমোক্রেট সিনেটরদের রাজি করাতে এ বার্তা টনিকের মতো কাজ করছে। চুক্তি হতে না হতেই ইরানের বাজার ধরতে ইউরোপিয়ান দেশগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। জার্মানি ক্ষমতাধর একটি প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছে বাণিজ্যের জন্য। ব্রিটেন-ইরান দ্রুতই পরস্পরের মাটিতে দূতাবাস পুনরায় খুলেছে। ফলে মিছে মিছে যে বিশ্বশক্তিগুলো হুমকি দেয়নি, তা স্পষ্ট হয়ে যায়। ফলে ওবামা পেয়ে যান তাঁর কাঙ্ক্ষিত ৩৪টি ভোট।
এ চুক্তিটি ওবামার জন্য ঐতিহাসিক। কারো মতে, ওবামার শাসনামলকে মনে রাখার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হবে এটি, যাকে বলে ‘লিগ্যাসি ডিফাইনিং এচিভমেন্ট’। এ বিজয় ছিল হোয়াইট হাউস ও কংগ্রেসে ডেমোক্রেটদের মধ্যে একটি আক্রমণাত্মক ও সমন্বিত কৌশলের ফলাফল। প্রতিনিধি পরিষদে ডেমোক্রেট নেতা ন্যান্সি পেলোসির নির্দেশনায় ইরান চুক্তির পক্ষে প্রতিদিন কাজ করে গেছেন একদল কর্মী। আইনপ্রণেতাদের কাছে চুক্তির প্রতি তাদের সহকর্মী ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সমর্থন সংবলিত চিঠি বিলি করা হয়েছে। ন্যান্সি পেলোসি বলেন, ‘আমার লক্ষ্য ছিল সপ্তাহ শেষে ১০০টি ভোট নিশ্চিত করা। আমরা এখন ওই লক্ষ্য পেরিয়ে যাওয়ার পথে!’ অপরদিকে সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করেছে ওবামা প্রশাসনও। ইরান চুক্তির পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে হোয়াইট হাউসে আলাদা বিভাগ সৃষ্টি করেন কর্মকর্তারা। নিজেদের যুক্তি তুলে ধরতে @দ্যাইরানডিল নামে একটি টুইটার অ্যাকাউন্টও বানানো হয়। ওবামার মন্ত্রী ও প্রশাসনের অন্য শীর্ষ কর্মকর্তারা সরাসরি দুই শতাধিক প্রতিনিধি পরিষদ সদস্য ও সিনেটরের সঙ্গে আলাপ করেছেন। প্রেসিডেন্ট নিজে ব্যক্তিপর্যায়ে বা দলবদ্ধভাবে কথা বলেছেন প্রায় ১০০ জন আইনপ্রণেতার সঙ্গে।
এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন এমন এক কর্মকর্তা জানালেন, “আইনপ্রণেতাদের বোঝাতে আমাদের ‘গোপন অস্ত্র’ ছিলেন জ্বালানিমন্ত্রী আর্নেস্ট জে মনিজ। আর্নেস্ট মনিজ নিজে একজন পারমাণবিক পদার্থবিদ। জন কেরির পাশাপাশি তিনিও ইরান চুক্তির অন্যতম কারিগর। ওই কর্মকর্তা জানান, মনিজ কেবল বিজ্ঞান বুঝতেনই না, তিনি পরিষ্কারভাবে সবাইকে বোঝাতেও পারতেন। তাঁর কণ্ঠে জন কেরির মতো কর্তৃত্বের সুর ছিল না। আবার কেরির একটি কৌশলও বেশ কাজে লেগেছে। তিনি সাবেক দুই গুরুত্বপূর্ণ ইসরায়েলি নিরাপত্তা কর্মকর্তার বক্তব্য উদ্ধৃত করেছিলেন। তাঁরা হলেন ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সাবেক পরিচালক এফ্রাইম হেলেভি ও দেশটির অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা শিন বেটের সাবেক পরিচালক আমি আয়ালুন। অনেক আইনপ্রণেতা পরে স্বীকার করেছেন, গত মার্চে মার্কিন কংগ্রেসে চুক্তির বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে যা অর্জন করেছেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, ইরান চুক্তির পক্ষে এ দুই গুরুত্বপূর্ণ ইসরায়েলির বক্তব্য তা কার্যত ম্লান করে দিয়েছে।
আবার ইসরায়েলপন্থী সংগঠনগুলো যেমন মাঠে নেমেছে, তেমনই উদারপন্থী ডেমোক্রেটিক কয়েকটি গোষ্ঠীও চুক্তির পক্ষে মাঠে নেমেছে। বিশেষ করে প্রভাবশালী সংগঠন মুভঅন.অর্গ ইরান চুক্তি কঠোরভাবে সমর্থন করায় অনেক ডেমোক্রেট সিনেটর চুক্তির বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস পাননি। এ ছাড়া খোদ আমেরিকার বেশির ভাগ ইহুদিই ডেমোক্রেটিক দলের সমর্থক হওয়ায়, তাঁরা চুক্তির পক্ষে বলে বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে। ইহুদিদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে – এমন বাগাড়ম্বরপূর্ণ প্রচারণা কাজে দেয়নি। কৌশলে ওবামাকে ‘অ্যান্টি-সেমিটিক’ বা ‘ইহুদি-বিদ্বেষী’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তা হালে পানি পায়নি।
নেতানিয়াহু ও তাঁর মিত্ররা ইরান চুক্তি ভেস্তে দিতে ডেমোক্রেটদের যতটা বুঝিয়েছেন, তার চেয়ে বেশি ভয় দেখিয়েছেন। চুক্তির বিরোধীরা বলেন, ওবামা ও পেলোসি ইরান চুক্তিতে সমর্থন দেওয়ার বিষয়কে ডেমোক্রেট আইনপ্রণেতাদের জন্য দলের প্রতি আনুগত্যের পরীক্ষা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। এরপর আর চুক্তির বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস হয়নি অনেকের।
ওদিকে ইরান চুক্তি নস্যাতের সম্ভাবনা আপাতত শেষ হয়ে গেলেও চুক্তিবিরোধীরা এখনই হাল ছাড়তে রাজি নন। তাঁদের আশা, যদি ইরান ভবিষ্যতে চুক্তির বরখেলাপ করে, তবে হয়তো ডেমোক্রেটদের কেউ কেউ নিজেদের অবস্থান বদলাবেন। আরেক রিপাবলিকান কর্মকর্তা জানালেন, চুক্তির বিরুদ্ধে তাঁদের যাবতীয় সব প্রচারণা মাঠে মারা গেছে দুটি কারণে। আগস্টে রিপাবলিকান দলীয় প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর সব আলো ছিল গণমাধ্যমের। আবার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের ইমেইল বিতর্কও জায়গা দখল করে ছিল অনেকখানি।
ওবামা প্রশাসনের এক কর্তাব্যক্তি জানান, দুটি বিষয় ওবামার পক্ষে গেছে ভীষণভাবে। প্রথমটি হলো চুক্তিটি এমন সময় হলো, যখন কংগ্রেসে বিরতি শুরু হলো। ফলে চুক্তি নিয়ে নিজেদের প্রবল বিরোধিতা প্রকাশ করার সুযোগ পাননি রিপাবলিকানরা। দ্বিতীয়ত, চুক্তিবিরোধীরা এ চুক্তির একটি গ্রহণযোগ্য বিকল্প উপস্থাপন করতে নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। ওবামা সফলভাবে যুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন যে, এ চুক্তির বিকল্প কেবল যুদ্ধই! ওবামা এ-ও দেখিয়ে দিয়েছেন, যারা ইরাক যুদ্ধের পক্ষে ছিল, তারাই এখন আবার ইরান চুক্তির বিরুদ্ধে! অর্থাৎ যুদ্ধবাজরাই ইরান চুক্তির বিরোধিতা করছে। ফলে চুক্তির বিকল্প হিসেবে চুক্তিবিরোধীরা যে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চান, সেটা কার্যত প্রমাণ করে ফেললেন তিনি। আর ইরাক যুদ্ধের পর যে অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়েছে আমেরিকানরা, তাতে এ মুহূর্তে যুদ্ধের মতো ঘৃণা বোধ হয় আর কিছুকেই তারা করে না!
কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে বিশ্বের প্রায় সব দেশের সমর্থন আদায় করে নিয়েছে ওবামা প্রশাসন। এমনকি উপসাগরীয় দেশগুলো ভেতরে ভেতরে এ চুক্তি নিয়ে অনেক উদ্বিগ্ন হলেও, ওবামার আশ্বাস পেয়ে প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছে। ফলে চুক্তিবিরোধীদের ওবামা দাঁড় করিয়েছেন বিশ্ব জনমতের বিরুদ্ধের অক্ষ হিসেবে! ওবামার আরো যুক্তি ছিল, কংগ্রেস তার প্রশাসনের করা চুক্তি বাতিল করলে, বিশ্বমোড়ল হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতা হুমকির মুখে পড়বে। কেননা, কেউই আর আমেরিকার দেওয়া কথা বিশ্বাস করবে না। পুরো বিষয়টিকে কৌশলে বিদেশি সরকার প্রধানের (নেতানিয়াহু) সঙ্গে খোদ আমেরিকান প্রেসিডেন্টের লড়াই হিসেবে রূপ দেওয়ানো হয়েছে। যদিও এর জন্য স্বয়ং নেতানিয়াহুই সবচেয়ে বেশি দায়ী। এর ফলে অনেক আমেরিকান একে জাতীয় মর্যাদার বিষয় হিসেবে নিয়েছে। এ ছাড়া বিরোধীরা চুক্তির বিস্তারিত প্রকাশের আগেই গণহারে বিরোধিতা শুরু করায়, ওবামা দেখাতে সক্ষম হয়েছেন, সমালোচকদের উদ্দেশ্যই ছিল যত ভালো চুক্তি হোক না কেন, এর বিরোধিতা করা।
বিশেষজ্ঞদের অবস্থানও কাজে দিয়েছে। জ্বালানি মন্ত্রী আর্নেস্ট মনিজ নিজেই একজন পারমাণবিক বিশেষজ্ঞ। তাঁর কথা গ্রহণযোগ্য ছিল সবচেয়ে বেশি। তিনি বলেছেন, ইরানের তেজস্ক্রিয় পদার্থের নাড়াচাড়া মিনিটেই ধরে ফেলার প্রযুক্তি রয়েছে সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে। ফলে ইরান প্রতারণা করলে তা সঙ্গে সঙ্গে ফাঁস হয়ে যাবে। গোয়েন্দা সংস্থার বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, একটি সামরিক অভিযানের মাধ্যমে হয়তো মাত্র তিন বছর পিছিয়ে দেওয়া যেত ইরানের পারমাণবিক অগ্রগতি। আর চুক্তি দিয়ে পেছানো যাচ্ছে ১৫ বছর!
ওবামার বিজয়ে সবচেয়ে চপেটাঘাত খেয়েছেন নিঃসন্দেহে নেতানিয়াহু। একজন বিদেশি সরকারপ্রধান হয়েও আমেরিকান প্রেসিডেন্টের ভেটো ক্ষমতা অকার্যকর করার যে মিশনে তিনি নেমেছিলেন, তা মোটামুটি বুমেরাং হয়ে গেছে। ওবামাকে প্রকাশ্যে সংবাদ সম্মেলনে ইসরায়েলের ইতিহাস নিয়ে ‘জ্ঞান দেওয়া’, ওবামার দ্বিতীয় মেয়াদের নির্বাচনে প্রকাশ্যে রিপাবলিকান প্রার্থী মিট রমনির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করা, যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত হিসেবে সাবেক শীর্ষ এক রিপাবলিকান নেতাকে (যিনি পরে ইসরায়েলের নাগরিক হয়েছেন) নিয়োগ দেওয়া, জাতিসংঘে কট্টরপন্থী একজনকে ইসরায়েলের শীর্ষ কূটনীতিক হিসেবে প্রেরণ করা, নিজের শাসনামলে কখনই ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে না বলে ঘোষণা দেওয়া, চুক্তির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল প্রচারণা চালানো, মার্কিন ইহুদি নাগরিকদের ইরান চুক্তি নিয়ে নিজেদের প্রেসিডেন্টের অবস্থানের বিরোধিতা করতে প্রকাশ্যে আহ্বান, রিপাবলিকান পার্টির পক্ষে সর্বাত্মকভাবে লড়াই করা, মার্কিন কংগ্রেসে ইরান চুক্তির বিরোধিতা করে ভাষণ দেওয়া, সর্বোপরি আমেরিকান অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও পররাষ্ট্রনীতিতে নেতানিয়াহুর প্রকাশ্য হস্তক্ষেপ ওবামাকে ভীষণ ক্ষুব্ধ করেছে। অনেকের ধারণা, ওবামা বিষয়টিকে ব্যক্তিগত লড়াই হিসেবেও নিয়েছেন। ইসরায়েলি বামপন্থী দৈনিক হারেৎযে কেউ একজন লিখেছেন, এসব হলো মার্কিন প্রেসিডেন্টকে অপদস্থ (হিউমিলিয়েট) করতে চাওয়ার ফল।
ইসরায়েলের জন্য সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো, আমেরিকার সব ক্ষেত্রে ইসরায়েলের স্বার্থ দল-মতের ঊর্ধ্বে স্থান পেত। কিন্তু সে অবস্থান নড়বড়ে হয়ে গেছে। ওবামা ইরান চুক্তির পক্ষে এক ভাষণে পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, ইসরায়েল ও আমেরিকার স্বার্থ যে সব সময় এক হবে, তা নয়। আর আমেরিকার স্বার্থ আমেরিকান প্রেসিডেন্টের চেয়ে বেশি বুঝতে গিয়ে নিজ দেশের স্বার্থকেই বিপদে ফেলেছেন নেতানিয়াহু। বহুদিন ধরে ওবামার বিরুদ্ধে বিভিন্নভাবে লড়াই চালিয়ে আসছিলেন এমআইটি স্নাতক নেতানিয়াহু। কিন্তু প্রত্যেকটিতেই ওবামা পরাজিত করেছেন তাঁকে। শুধু সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে ভোটারদের মধ্যে কট্টর ডানপন্থী চেতনা উসকে দিয়ে নেতানিয়াহু উতরে যেতে পেরেছেন। সুড়সুড়ি দিয়ে নির্বাচনে জিতলেও এর জন্য কম হ্যাপা পোহাতে হয়নি তাঁকে। পরবর্তীকালে সবার কাছেই স্পষ্ট হয়ে যায়, ফিলিস্তিনে শান্তি ফিরিয়ে আনার কোনো আগ্রহই তাঁর নেই। তাঁর সব যুক্তি ফাঁকা বুলি ছাড়া কিছু নয়। নির্বাচনের আগে যে যৎসামান্য গ্রহণযোগ্যতা তাঁর ছিল বিশ্ব দরবারে, নির্বাচনের পর ততটুকুও মিইয়ে গেছে।
সাবেক ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি একবার নেতানিয়াহুর ওপর বিরক্ত হয়ে ওবামাকে বলেছিলেন, ‘আমি আর পারছি না। সে (নেতানিয়াহু) একটা মিথ্যাবাদী।’ জবাবে ওবামা বলেছিলেন, ‘তুমি এত তাড়াতাড়ি তাকে নিয়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছো? আর তাঁকে আমার প্রতিদিন সামলাতে হয়!’ দুই নেতার ব্যক্তিগত এ কথোপকথন পরে ফাঁস হয়ে যায়। এটি এখন নিশ্চিত করেই বলা যায়, নেতানিয়াহুকে সামলাতে গিয়ে বেশ দক্ষ হয়ে উঠেছেন ওবামা।