ঈদ উৎসব
বাড়ি যেন সবার আনন্দলোক
কাজের চাপে ব্যস্ত দিন পার করতে করতে হাপিয়ে ওঠবার পর মন পুড়ে খুব। একটু স্বস্তির জন্য, সুখের জন্য, মায়ের হাতের এক গ্লাস ঠান্ডা জলের জন্য তৃষ্ণায় কাতর হয় প্রাণ। মনে হয় যত সুন্দর এইখানে, যত মঙ্গল এইখানে, ফেলে আসা শৈশবের সবুজ গ্রামে। স্নেহ প্রেম দয়া ভক্তি সবটাই সঞ্চিত যেন বাড়ির আঁতুড়ঘরে। হৃদয় রাখা থাকে যে বাড়িতে, যার জন্য মনপ্রাণ আনচান করে সেই বাড়িতে ফিরবার উপলক্ষ নিয়েই আসছে ঈদ। জগতের সকল মহোৎসব যেন ওই বাড়িকে ঘিরেই। উৎসব ও আয়োজনে আপনালয়ের এই ঐশ্বরিক ও অনির্বচনীয় প্রশান্তি আর আবেশকে লক্ষ্য করেই বুঝি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গেয়েছিলেন :
আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর।।
…
বহে জীবন রজনীদিন চিরনূতনধারা,
করুণা তব অবিশ্রাম জনমে মরণে।
বছরঘুরে আবার এলো ঈদুল ফিতর। মাসব্যাপী সংযম সাধনার অপার মহিমায় উদ্ভাসিত সবার মন। নিশ্চিতই ত্যাগী মানুষের অন্তরাত্মা ভরে ওঠেছে সৌহার্দিক মানবিকতায়। মানুষের মন কাঁদতে শিখেছে ওই মানবতার জন্যই। জগতের এই যে মহোৎসব আর বিশ্বের বিস্ময়কর বন্ধন এর জন্যই তো মানুষের প্রাণপণ ব্যাকুলতা। আনন্দ, আহ্লাদ আর বেপরোয়া ভালোবাসায় মানুষের হাত ধরে সকল শুভবোধের যুথবদ্ধতায় বেঁচে থাকবে এই মানবিক পৃথিবী।
মানুষের মনের সব শঙ্কা আজ অপসৃয়মান। ঈদযাত্রার দুর্ভোগের সাথে টক্কর দিয়ে পেরে ওঠে তবেই ঘরে ফিরতে হচ্ছে সবার। যানবাহনের টিকেট সংগ্রহের ঝক্কি ঝামেলা, অপ্রতুল পরিবহন, উত্তাল নদীতে জীবন হাতে নিয়ে লঞ্চযাত্রা, সড়ক-মহাসড়কে তীব্র যানজট, সময়মতো বাড়ি ফিরতে পারার অনিশ্চয়তা আজকালের জন্য সব অতীত। আবার কর্মস্থলে ফেরার পথে ঝুঁকিরা ঝাঁক বেঁধে আসতে পারে, নাও পারে। বছরে মাত্র এক দু’বারের ছুটিতে যাদের বাড়ি আসার সুযোগ ঘটে, আত্মীয়স্বজনদের খোঁজখবর করবার সুযোগ ঘটে তাদের জন্য এসব গা সওয়াই।
নানা বিড়ম্বনা গায়ে মেখে তবু আষাঢ়ে টানা বৃষ্টিতে নগরের জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ ছেড়ে মাত্র ক’দিনের জন্য গ্রামে পা ফেলাটা সবার জন্যই বড় স্বস্তির, বড় আয়েশের। ঈদ উদযাপন করতে করতে যদি বিকেলে নেমে পড়ে অঝর ধারার বৃষ্টি। তবে টিনের চালে ঝমঝম মেঘসঙ্গীতে তাল মিলিয়ে জানালায় ভেজা সবুজ জমিনে দৃষ্টি রেখে আনমনে গেয়ে ফেলতে পারেন রাবীন্দ্রিক অমৃত সুর :
মন মোর মেঘের সঙ্গী,
উড়ে চলে দিগদিগন্তের পানে
নিঃসীম শূন্যে শ্রাবণবর্ষণসঙ্গীতে
রিমিঝিম রিমিঝিম রিমিঝিম।
শত ঝঞ্জাট সয়ে তবু যারা বাড়ি ফিরতে পেরেছেন, যারা সকলকে নিয়ে ঈদ করবেন, ঈদের মাঠে গিয়ে প্রাণভরে কোলাকুলি করবে তাদের কর্মস্থলে ফিরতি যাত্রার জন্যও সতর্ক থাকতে হবে, যেই সতর্ক সংকেত মেনে নিয়েই সবাই বাড়ি ফিরেছে।
বাড়ির পথে আসতে আসতেই হয়তো ভেবে নিয়েছিলেন, নিজের আপন আঙিনায় পৌঁছেই প্রাণভরে পুরোনো সেই সজীব সতেজ নিঃশ্বাস গ্রহণের কথা। ধকলে জর্জরিত ফুসফুসের প্রশান্তি, আহা। ভেবে রেখেছিলেন, যেই ভূমিতে পুতে রাখা আছে আপনার সাথে মায়ের জনম জনমের সংযোগ স্মারক সেই নাড়ি; সেখানকার আলোতে দেহমন আলোকিত করবার এইতো সময়। বাড়ি থেকে বের হয়ে সড়কের মোড়ে পুকুর বা বটবৃক্ষের সবুজছায়ায় দুদণ্ড জিরিয়ে নেওয়ার শহুরে আক্ষেপের আজ নিদান হবে। ঈদে বাড়ি ফিরেছেন আপনি, আর ফিরেছেন আপনার চিরায়ত চিরচেনা শৈশবে। স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও প্রতিবেশীর সাথে সবার ঈদ উদযাপন হোক মঙ্গলময় ও কল্যাণময়। আজ গলা খুলে উচ্চারণ করবেন,‘কী আছে জীবনে আমার’। এ সময় প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ এসে আপনাকে কবিতা শুনিয়ে যাবে :
সময়ের কাছে এসে সাক্ষ্য দিয়ে চ’লে যেতে হয়
কী কাজ করেছি আর কী কথা ভেবেছি।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন