দৃষ্টিপাত
রাজকীয় বিয়েতে মন জিতলেন ধর্মযাজক!
মার্কিন খ্রিস্টীয় ধর্মাধ্যক্ষ মাইকেল কারি সম্প্রতি বিশ্বজুড়ে আকর্ষণের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছেন প্রিন্স হ্যারি এবং মেগান মার্কেলের বিয়ের আয়োজনে এক প্রলম্বিত এবং শক্তিশালী বক্তব্য উপস্থাপনের পরে। শিকাগো বংশোদ্ভূত এই ধর্মযাজক এই আয়োজনে ভালোবাসার শক্তি নিয়ে এক দৃঢ় বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তার বক্তব্যে তিনি মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের উদ্ধৃতি দিয়েছেন।
মাইকেল বলেন, ‘ভালোবাসার মাঝে যে শক্তি ও ক্ষমতা অন্তর্নিহিত তাকে কোনোভাবেই হেয় করবেন না।’ তার এই চমৎকার বক্তব্যকে দেখা হচ্ছে ঐতিহ্যের শিকল ছিড়ে নতুন এক ধারার জন্ম হিসেবে।
২০১৫ সালে নিযুক্ত হওয়ার পর অত্যন্ত সম্মানীয় মাইকেল কারি ছিলেন এপিস্কোপাল চার্চের প্রথম কৃষ্ণবর্ণের ধর্মগুরু। অতীতেও তিনি সামাজিক নৈতিকতার সমস্যা নিয়ে কথা বলেছেন, যার মধ্যে ছিল সমকামীতার অধিকার (এলজিবিটি) এবং যৌন হয়রানি সমস্যা বিষয়ক আলাপ। তাঁর সে বক্তব্য ছিল ইতিহাসের নানান উদাহরণে পরিপূর্ণ। তার বক্তব্য শুনে ডেভিড বেকহাম এবং কর্ণওয়াল এর ডিউক-পত্নীসহ অনেকের ঠোঁটের কোণায় হাসির আভা দেখা গিয়েছিলো। তবে অনেকে অবাক হয়ে বসেছিলেন তার বক্তব্য শুনে। বিয়ের পাত্র আর পাত্রীর আহ্বানেই তিনি এসেছিলেন বক্তব্য রাখতে। আর তার সেই বক্তব্যের পুরো সময়টাই তাঁরা দুজন হাতে হাত রেখে তাঁর কাছাকাছি বসেছিলেন।
উপস্থিত সবাইকে ‘ভাই ও বোন’ বলে সম্বোধন করে তিনি বলেন, ‘ভালোবাসাই যখন পথ, তখন আমরা ন্যায়কে এক প্রবল ঝর্ণার মতো বয়ে চলতে দেখতেই পারি। আর ন্যায়পরায়ণতা এক বহমান নদীর মতোই চলমান থাকবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘ভালোবাসাই যখন পথ, দারিদ্র্য তখন ইতিহাস হতে বাধ্য। যখন ভালোবাসাই আমাদের পথ, তখন বিশ্ব হবে এক চমৎকার অভয়ারণ্য।’ তিনি তাঁর বক্তব্য চালিয়ে গেলেন, আর অনেকটা সময় অতীতের কৃতদাসদের গাওয়া ‘ডাউন বাই দ্য রিভারসাইড’ নামের এক আফ্রিকান-আমেরিকান গানের লাইন থেকে উদাহরণ টানেন। তিনি বলেন, ‘যখন ভালোবাসাই পথ, তখন আমরা আমাদের তরবারি আর বর্ম ফেলে দেব নদীর ধারে, আর কোনোদিন যুদ্ধের চর্চা করব না।’
সাথে তিনি আরো যোগ করেন, ‘ভালোবাসাই যখন পথ, তখন ঈশ্বরের সব সৃষ্টির জন্য কল্যাণ নিশ্চিত। কারণ ভালোবাসাই যখন পথ, কেবল তখনই আমরা পরস্পরকে নিজের পরিবারের মতো ভাবতে পারব।’
তবে বক্তব্যের এক পর্যায়ে তিনি বুঝতে পারলেন যে তিনি অনেকক্ষণ সময় নিয়ে কথা বলে চলেছিলেন। তাই তিনি শেষ করার আগে বললেন, ‘আমার উচিত এখন বক্তব্য সংক্ষেপ করে আপনাদেরকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করা!’
অনুষ্ঠানের আগে সম্মানীয় জাস্টিন ওয়েলবি, যিনি সেইন্ট জর্জে’স চ্যাপেলে বিবাহের কাজ সম্পন্ন করেছেন, বললেন, ‘আমি খুব আনন্দিত হয়েছি যে প্রিন্স এবং মিস মার্কল বিশপ কারিকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য। তিনি একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব এবং একজন চমৎকার ধর্মযাজক।’
কারির এই বক্তব্যকে অনেকে বলছেন ‘আগুনঝরা ভাষণ’। আর এই কথাগুলো এরই মাঝে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে সাড়া জাগিয়েছে। সাবেক লেবার পার্টি নেতা এড মিলিব্যান্ড জানান, ‘এই ধর্মযাজক আমাকে প্রায় একজন বিশ্বাসী হিসেবে পরিণত করে ফেলতে সক্ষম!’
বিশপ কারি বক্তব্যের শেষ অংশে আগুন নিয়ে কথা বলেছেন অনেকক্ষণ। এ সময়ে তিনি ফ্রেঞ্চ দার্শনিক এবং ধর্মযাজক পিয়েরে তিলহার্দ ডি চার্ডিনের উদ্ধৃতিও দিয়েছেন। তিনি বলেন যে সেই ফ্রেঞ্চ ব্যক্তি বলেছেন, “আগুন আবিষ্কার ও তা নিয়ন্ত্রণ করতে শেখা ছিলো মানব ইতিহাসের অন্যতম এক প্রযুক্তিগত অগ্রগতি”।
তিনি আগুনের বহুবিধ ব্যবহার সম্পর্কে কথা বলেন, রান্না থেকে শুরু করে আকাশে উড্ডয়ন, এমনকি এই চলমান বিয়ের আয়োজন বিশ্বের কাছে ব্রডকাস্ট করার কাজেও আগুনের ভূমিকা তুলে ধরেন তিনি।
এরপর তিনি আবার ফিরে আসেন ডি চার্ডিন প্রসঙ্গে। চার্ডিন বলেছিলেন, ‘মানব সম্প্রদায় যদি কখনো ভালোবাসার শক্তিকে হাতের মুঠোবন্দি করতে সক্ষম হয়, তাহলে তা হবে ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মতো আগুন আবিষ্কার করা।’তিনি বলেন কেবল ভালোবাসার পথ বরণ করার মাধ্যমেই সূচনা হবে এক নতুন পৃথিবীর। সবশেষে পাত্র ও পাত্রীর উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘আমার ভাই, আমার বোন, ঈশ্বর আপনাদেরকে ভালোবাসেন। ঈশ্বর আপনাদের মঙ্গল করুক এবং আমাদের সকলকে যেন ঈশ্বর তার পরম ভালোবাসায় আগলে রাখেন।’
মাইকেল কারি ১৯৭৮ সালে ধর্মযাজক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি এপিস্কোপাল চার্চের প্রধান বিশপ এবং তিনি সামাজিক নৈতিকতা, ইমিগ্রেশন নীতি এবং বৈবাহিক সমতা নিয়ে কথা বলেন। তাঁর হাতের কাছের তিন এলাকা- নর্থ ক্যারোলাইনা, ওহাইও এবং ম্যারিল্যান্ডের শহরজুড়ে পারিবারিক ডে কেয়ার ব্যবস্থা, শিক্ষাকেন্দ্র এবং আঞ্চলিক উন্নয়নে বিনিয়োগের জন্য প্রচারণা চালান। নর্থ ক্যারোলাইনাতে তিনি চার্চের উন্নয়ন ফান্ডের অর্থ দ্বারা ম্যালেরিয়া আক্রান্ত এক লাখ মানুষের জীবন রক্ষায় এগিয়ে আসেন। বিশপ কারি এপিস্কোপাল চার্চে সমকামীদের বিবাহের বৈধতা নিয়ে কাজ করেছেন। ২০১৫ সালে তিনি এর বৈধতা দেওয়ার পর অন্যান্য অনেক চার্চ তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন।