আন্তর্জাতিক
জাপান কি ভুলে গেছে হিরোশিমার স্মৃতি?
‘সামরিক বিল বাতিল কর, দেশকে রক্ষা কর, আবের ক্ষমতা রোধ কর, দেশে দাও শান্তি’ এমন স্লোগানে মুখরিত পুরো টোকিও শহর। মানুষজন রাস্তায় নেমেছে প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন হাতে, গায়ে প্রতিবাদী টি-শার্ট। আন্দোলনের উত্তেজনায় ভাসছে পুরো জাপান। জাপানের মতো একটি দেশে আন্দোলন সত্যি অন্যরকম একটা ব্যাপার। কোনো জটিল সমস্যা ছাড়া রাস্তায় নামার সময় তাদের নেই। এই বিক্ষোভের কারণ হলো জাপানের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে গত সপ্তাহে উত্থাপিত হওয়া একটি নিরাপত্তাবিষয়ক সামরিক বিল। দেশের নিরাপত্তার জন্য সামরিক নিরাপত্তা বিল উত্থাপন স্বাভাবিক, কিন্তু যদি তা হয় দেশের জন্য বিপজ্জনক, তবে জনগণ নিশ্চয়ই তা মেনে নেবে না। তেমনি অবস্থা ঘটেছে জাপানের পার্লামেন্টে সম্প্রতি উত্থাপিত সামরিক নিরাপত্তা বিলের বেলায়ও।
এই বিলের মূল বিষয় হচ্ছে, জাপানি সেনারা আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ হয়ে যে কোনো দেশের যুদ্ধে অংশ নিতে পারবে। এই প্রস্তাবটি মেনে নিতে পারেনি জনগণ। তারা বলেছে, বিলটির ফলে দেশে অনাকাঙ্ক্ষিত যুদ্ধ-বিগ্রহ বাড়তে পারে, কিন্তু জাপানিরা তা কখনোই চায় না। বিলটি আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষে পাস হওয়ার কথা রয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছে, রোববার সকাল ৯টা থেকে ধীরে ধীরে পার্লামেন্টের আশপাশে মানুষজন আসতে শুরু করে। এর প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পর পুরো পার্লামেন্ট প্রাঙ্গণে প্রায় ১১ হাজার বিক্ষোভকারী জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করে। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে কিছু সময় লাঠিপেটাও করে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০১২ সালের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কর্মসূচি বন্ধের দাবিতে যে বিক্ষোভ হয়েছিল, এই বিক্ষোভটি তার চেয়েও বড়।
এখন কথা হচ্ছে, জনরোষের মাঝে জাপান সরকারের এ বিলটি পাস করা কি ঠিক হবে? বেশির ভাগ উত্তর আসবে মোটেই না। তার কারণগুলোও পরিষ্কার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি এখনো ভুলতে পারেনি জাপান। হিরোশিমা কিংবা নাগাসাকির দিকে তাকালে চোখে ভেসে ওঠে সেই সময়ের বিভীষিকার চিত্র। তবে সেসব এখন ভুলতে চলেছে জাপান। পরিশ্রম ও মেধা দ্বারা পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে তারা এখন শীর্ষস্থানীয়। সেখানে আবার আসছে সেই যুদ্ধের কথা। পুরো পৃথিবীতে একটা অস্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করছে। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক এই অবস্থার মধ্যে জাপান সরকারের এই বিল কতটুকু ক্ষতিকর হতে পারে তা জনগণ ঠিকই বুঝতে পেরেছে। এটা একটা বিষয় যে, জাপানের সৈনিকরা কাদের হয়ে যুদ্ধ করবে। যুদ্ধ যাদের হয়েই করুক না কেন, তার প্রতিপক্ষের কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব জাপানের ওপর ঠিকই পড়বে। এমনটা হলে আঞ্চলিক রেষারেষি আরো বাড়বে। এতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে জাপান।
একটা দেশের মূল শক্তি হচ্ছে জনগণ। তাদের সমর্থন ছাড়া সরকারের কোনো সিদ্ধান্তই নেওয়া উচিত হবে না। ইয়োগুচি মানামি নামের এক বিক্ষোভকারী বলেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের খেসারত আমরা এখনো দিচ্ছি। আমরা শান্তি চাই। আমার সন্তানের ভবিষ্যৎ আর আমি নষ্ট করতে চাই না। প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে জনগণের কথা না ভেবে পশ্চিমাদের তুষ্ট করতে বিলটি পাস করতে চলছেন। আমরা অবিলম্বে এ বিল বাতিলের দাবি জানাচ্ছি।’ এর আগে গত শুক্রবার টোকিওতে কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নিরাপত্তা বিলটি বাতিলের দাবিতে আমরণ অনশনের হুমকি দেয়। এরপর শনিবার সরকারের পক্ষ থেকে ওই ছাত্র জমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়। এভাবে নিষিদ্ধ করে তো আর আন্দোলন দমানো যায় না। সরকার যদি এই ঘটনার সঠিক সুরাহা করতে না পারে, তবে আন্দোলন সরকার পতনের আন্দোলন পর্যন্তও যেতে পারে। এতে জাপানের পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে। বিক্ষোভের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের মন্ত্রী ইয়োশিদা বলেন, ‘বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী নজরে রেখেছেন। প্রয়োজনীয় আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সামরিক ওই বিলটি সংশোধনও করা যেতে পারে।’ এটা অবশ্য আশাব্যঞ্জক কথা। যুদ্ধপ্রবণ এলাকাগুলো থেকে পূর্ব এশিয়ার অবস্থা অনেকটাই শান্ত। এই অবস্থায় দেশের শান্তি এবং সমৃদ্ধির কথা বিবেচনা করে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই বিভীষিকা স্মরণ করে সরকারের উচিত হবে যুদ্ধকে না বলা, এমন একটা অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসা।
লেখক : শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।