বং এক্সপ্রেস
তেলেভাজা বাঙালি
একদম তাই, বাঙালি কিন্তু নিজেরাই তেলেভাজা। পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ কিম্বা প্রবাসী বাঙালি এসব ভেদাভেদ একেবারেই স্থান পায় না, কারণ রসেবশে থাকা ইহা বাঙালির মজ্জাগত।স্পাইসি খেতে খাওয়াতে যে তেলের সঙ্গে অন্য কোনো উপাদানা এঁটে উঠবে না তা বলাই বাহুল্য। যখন এটা লিখতে বসলাম তখন আমার সঙ্গী পেঁয়াজি ও বেগুনী। ভাজা লাল দেহ আর তার সুবাস তার মধ্যে এই ঘন কালো করে আসা মেঘ আসলে কেন জানিনা এই বিশাল প্রকৃতিও কখনো কখনো আমাদের সঙ্গে কথা বলতে চায় বোঝা যায়। যেমন সদ্য গরম তেলেভাজারা দেখতে হয় তেমনই আজ আকাশের রঙ পশ্চিমে হলুদ মাখা ভাজা ভাজা লাল হয়ে এসেছিল। বোধ করি সেও চাইছিল আজ তাকে আমরা আমাদের পদ্ধতিতে উপভোগ করি। একটা গাঢ় ও ঘন আবেগে আমাদের মধ্যে মানে বাঙালির মধ্যে সবসময় ফল্গুধারার মধ্যে প্রবাহিত।
এই যে ঝাল খেয়ে ঝালকে গভীর থেকে গভীরতর ভাবে ইন্দ্রিয়কে হেস্তনেস্ত করে চোখে-মুখে জল এনেও আমরা তাকে ত্যাগ করিনা এটাই আসলে সেই আবেগ, যে আবেগে নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত সব বাঙালিই রোমাঞ্চকর সন্ধ্যেতে এক বাটি মুড়ি, ঘন চা আর তেলেভাজা নিয়ে এক অন্য আনন্দ উপভোগ করে। মানছি, এখন মানুষ অনেক বেশী স্বাস্থ্য সচেতন তারা এখন অলিভ ওয়েলে রান্না করে খায়, বাইরের খাবারকে পাত্তা কম দেয়, তবু আমি নিশ্চিত রোমান্টিক বাঙালি বৃষ্টির দিনে, বিষণ্ণ বিকেলবেলায় তেলেভাজাকে অগ্রাহ্য করবে না।
ফাইভস্টার, সেভেনস্টারে কন্টিনেন্টাল, বিভিন্ন রিমিক্স পদ, ডেজার্ট, ফিশ স্টেগ খেয়ে যতই আপনার ভেতরের ধনী ধর্ম আত্মম্ভরিতা দেখাক না কেন, সুযোগ পেলে সে বেড়ালের মতোই চোখ বন্ধ করেই তেলেভাজায় কামড় দেবে। রোজার ইফতারে আমি রসিয়ে বন্ধুদের তেলেভাজা খেতে দেখেছি, আর সে খাওয়া নিছক হালকা ছিমছাম খাওয়া নয় বেশ পেটপুরেই খাওয়া। ভাবুন, আপনি রাজপথের মধ্যে দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন আর হঠাৎ গাড়ি বন্ধ হয়ে গেল আপনি অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন দূর থেকে ভেসে আসছে মহম্মদ রফির গলার সুর, আর একচালা দোকানে টিমটিম আলোয় চপ ভাজা হচ্ছে; হলফ করে বলতে পারি আপনি ঐখান থেকে তেলেভাজা কিনে খাবেন যদি জাত বাঙালি হন। কিন্তু এরকম একটি বিশেষ পরিস্থিতি কেন তৈরী করলাম এটুকু বোঝাতে গিয়ে আসলে বলতে এটাই চেয়েছি বাঙালির যে বিশুদ্ধ আবেগ তার সঙ্গে এই তেলতেলে ব্যাপারটা মাখোমাখো ভাবে জড়িত, যতই তাকে বিভিন্ন আদব-কায়দায় আড়াল করা হোক না কেন!
আলুর চপ, ফুলুরি, মোচার চপ, ডালের বড়া, বেগুনী, পাউরুটির চপ, ভেজিটেবল চপ,ডিমের চপ, পেঁয়াজি, ব্যোম চপ আরো কত কী! বিভিন্ন তার স্বাদ সবজির বিভিন্নতায় ও নিজস্ব স্বাদে। হয়ত গ্রাম্য ধুলো মাখা কালো লোহার কড়াইতে ভাজা চপ বং বাঙালি কম খায় কিম্বা খায় না কিন্তু এই চপদেরই গ্রুম করে আধুনিক করে তারা রীতিমতো রসনাতৃপ্ত করে , তেলেভাজাকে তারা ত্যাগ করতে পারেনি হয়ত কোথাও কোথাও মুড়ির সহযোগিতা কমেছে, শালপাতার বদলে টিসু পেপারে তার বসবাস শুরু করেছে। কিন্তু জাতে আর কাঠামোই তারা এক। এখনো দূরের এক্সপ্রেস ট্রেনে গেলে চপ-সিঙ্গারার আবেদনকারী গন্ধ আর সেই বেতের ঝুড়ির মধ্যে তাদের একসঙ্গে থাকা আমাদের সব যখন এত এক তখন কিসের ধর্ম আমরা তো বাঙালি রক্তে, গন্ধে, মননে। সেই এক বিখ্যাত গান আছে “তু হিন্দু বনেগা না মুসলমান বনেগা/ ইনসান কি অলাদ ইনসান বনেগা” তেমন তু তেলেভাজা কি অলাদ তেলেভাজাই রেহেগা, সে শালপাতা কিম্বা টিসু যাতেই তাকে দেখা যাক না কেন!
আমেরিকায় বিভিন্ন খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের একটি শো “ফুড ফ্যাক্টরি” যা ডিসকভারি চ্যানেলে দেখানো হয়, সেখানে আমাদের বাঙালির এই তেলেভাজা সংক্রান্ত খাদ্য ওদের দেশে ওদের মতো করে বানাতে দেখেছিলাম। কিন্তু এটা অনস্বীকার্য বাঙালির তেলেভাজা পদ্ধতি ততোধিক হাইজেনিক বা পুষ্টিকর না হলেও স্বাদে-গন্ধে তা উন্নত।
ফুটন্ত গরম তেলে ভেজে ওঠা লাল সৎকারকামী এই ভাজা আমাদের মতোই বিপর্যস্ত কিন্তু তার একটা নিজস্ব লালিত ধর্ম আছে। আমি একটুও হীন মনোভাব থেকে বলছি না কিন্ত, এটা তো খুব বড় সত্যি আমরা তৃতীয় বিশ্বের মানুষ। এই গ্রীষ্মপ্রধান দেশে মানুষ ট্রেনে-বাসে ঝুলতে ঝুলতে বাড়ি ফেরে, গরমে ঘেমে হেস্তনেস্ত হয়ে থাকে, তবু তো মানুষ সমস্ত মানুষের মতো তাদের বোধও রোমাঞ্চকর মুহূর্তকে লালন করতে চায়, তাই আমরা যেমন গরমে চুপচুপে হয়ে ভাজা ভাজা হয়ে বেঁচে থাকাকে বাঁচিয়ে রাখি, সেই আমাদের বাংলার মুহূর্ত হয়ে তেলেভাজারাও আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে কিছুটা সাহায্য করে।
আসুন আমরা এক বাটি মুড়ি সহযোগে গরম আলুর চপের দিকে এগিয়ে আসি, আর ঐ যে কালবৈশাখী মেঘ ধেয়ে আসছে তাকে বলি, আমাদের এই গ্রীষ্মপ্রধান নদীমাতৃক মায়ের আঁচলে পৃথিবীর সেরা গন্ধ লুকিয়ে আছে।
লেখক: কবি, পশ্চিমবঙ্গ