আন্তর্জাতিক
শরণার্থীদের দায়িত্ব ইউরোপকেই নিতে হবে
মৃত্যু তাঁদের পিছুতাড়া করছে। মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার জন্য সবকিছু ছেড়ে পথে নেমেছেন তাঁরা। কিন্তু ফের সেই মৃত্যুর সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন তাঁরা। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের দেশগুলোতে আশ্রয় নেওয়ার জন্য ধেয়ে আসছে মানুষ। আর তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে যে ইউরোপ-আমেরিকা মানবাধিকারের সুললিত বাণী দিয়ে আসছে, তাঁরা এখন চোখে শর্ষের ফুল দেখছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শরণার্থীর সংখ্যা এখন ছয় কোটির মতো, যাঁদের বেশির ভাগই অবস্থান করছেন পাকিস্তান, তুরস্কসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে। এই বাংলাদেশেও রয়েছেন রোহিঙ্গা শরণার্থী। অথচ মাত্র কয়েক লাখ শরণার্থীর চাপে ইউরোপের দেশগুলো তারস্বরে চিৎকার জুড়েছে। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন তো বলেই বসেছেন, অভিবাসীরা নাকি পালে পালে ধেয়ে আসছেন তাঁদের দেশের দিকে।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার হিসাবে, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে আসার সময় উদ্ধার করা হয়েছে প্রায় দুই লাখ মানুষ। আর মারা গেছেন দুই হাজারের বেশি মানুষ। কিন্তু এই পরিণতির কথা জানা থাকার পরও পথে নামছেন তাঁরা। কেননা, পেছনের চিত্র আরো ভয়াবহ। কিছুদিন আগে অভিবাসীদের ধকল সামলাতে হচ্ছিল গ্রিসকে। কিন্তু গ্রিসের চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পর শরণার্থীরাই আর আগ্রহী নন সেখানে আশ্রয় নিতে। গ্রিসের পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে এখন আর নাকি কোনো পর্যটক নেই। সেসব স্থানে এখন শরণার্থীর ভিড়। স্যান্ডউইচ আর কফির চেয়ে দামি কিছু কিনে খাওয়ার সামর্থ্যও নেই তাঁদের। বিনোদন কেন্দ্রগুলো এখন পরিণত হয়েছে আশ্রয়শিবিরে, তাই অন্ধকার নেমে এসেছে পর্যটন ব্যবসায়ীদের চোখে। শরণার্থীরা গ্রিসে থাকতে চান না বলে তাঁরা সেখানকার উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ঢুকে পড়ছেন মেসিডোনিয়ায়। গত কয়েক দিনে পরিস্থিতির এত অবনতি ঘটেছে যে মেসিডোনিয়ার মতো রাষ্ট্র জারি করেছে জরুরি অবস্থা। জার্মানির দাবি, এ বছরের মধ্যেই সাড়ে সাত লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে তারা। এসব শরণার্থী মূলত সিরিয়া ও বলকান রাজ্য থেকে আসা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাম্প্রতিক তথ্যমতে, গত জুলাইয়ে ইউরোপের সীমান্তে এসে ভিড় করা শরণার্থীর সংখ্যা এক লাখ সাত হাজার ৫০০। ইউএনএইচসিআরের মুখপাত্র গত মঙ্গলবার জানিয়েছেন, প্রতিদিন তিন হাজার করে শরণার্থীর ইউরোপযাত্রা নাকি অব্যাহত থাকবে আগামী নভেম্বর মাস অবধি।
কিন্তু কেন দেশ ছেড়ে অনিশ্চিত জীবনের পথে পা বাড়াচ্ছেন এসব মানুষ? কারণ নিজেদের মত-পথ ও জীবনযাপনের অনিশ্চয়তা, কারণ ভয়ংকর যুদ্ধ, কারণ দারিদ্র্য। ইউরোপগামী এই শরণার্থীদের সবাই মূলত সিরিয়া, লিবিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, ইয়েমেনসহ বিভিন্ন যুদ্ধ-আক্রান্ত দেশের মানুষ, সাহারীয় আফ্রিকার মানুষ। আর ওই সব দেশের মানুষের জন্য যুদ্ধ ও দারিদ্র্যের এই ভয়ংকর পরিস্থিতি ডেকে নিয়ে এসেছে ধর্মবাদী মৌলবাদী রাজনীতি এবং ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোর সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতি। নিজেদের রাজনীতি-অর্থনীতিকে সুরক্ষিত করতে আর অস্ত্র ব্যবসার ফাঁদ পাততে এতদিন আড়াল থেকে ধর্মবাদী মৌলবাদী রাজনীতিকে উসকে দিয়ে এখন নিজেদের খনন করা কুয়োতে নিজেরাই আছাড় খাচ্ছে তারা। বিভিন্ন দেশের যুদ্ধ-পরিস্থিতির দায় পাশ্চাত্যের দেশগুলোর পক্ষে কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। অথচ শরণার্থীর দায় নিতে তারা রাজি নয় কিছুতেই।
ইউরোপের দেশগুলো এখন চিন্তাভাবনা করছে শরণার্থীদের নিয়ে নীতিনির্ধারণ করার। অনুমান করা যায়, তা হবে এমন কিছু যাতে এই চাপ থেকে ইউরোপ নিজেকে রক্ষা করতে পারে। বিভিন্ন দেশ থেকে যাঁরা ইউরোপে আসছেন, তাঁরা পথে বেশ কয়েকটি দেশ পাড়ি দিচ্ছেন। ইউরোপের লক্ষ্য এখন পথের মধ্যের কোনো দেশকেই কায়দা করে শরণার্থীদের চাপ নিতে বাধ্য করা, তাদের ভাষায় অবশ্য সহায়তা করা। বাস্তবে এটি হবে শরণার্থীপ্রবাহ সেখানেই থামিয়ে দেওয়ার নীতি। ফ্রান্স আর যুক্তরাজ্য তো এর মধ্যেই জোট বেঁধেছে। আর জার্মানি সাড়ে সাত লাখ শরণার্থীর ভার নেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পাশাপাশি তুরস্ক, লেবানন ও জর্ডানে ১০ বিলিয়ন ইউরো সহযোগিতার কথা জানিয়েছে। সহযোগিতার কথা আসছে এই শরণার্থীর স্রোত ঠেকানোর উদ্দেশ্যে। ওই তিনটি দেশে চার মিলিয়ন সিরীয় শরণার্থী ইউরোপের দিকে যাত্রা করার জন্য অপেক্ষা করছেন। ইউরোপ তাই প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন কিছু করার, যাতে তাঁরা সেখানেই থেকে যান। এ ধরনের সহযোগিতা কেবল তিনটি দেশে সীমিত থাকবে না, অচিরেই তা প্রসারিত হবে আরো বেশ কয়েকটি দেশে।
কিন্তু সমস্যা কি দূর হবে তাতে? নাকি আরো জট পাকাবে? আশু পরিকল্পনা হিসেবে তাই এর দায়িত্ব ইউরোপ-আমেরিকাকেই নিতে হবে। প্রয়োজনীয় আবাসন, কর্মসংস্থান, শিক্ষা-দীক্ষা ও অবকাঠামো নির্মাণকে তাদের পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আর সুদূরপ্রসারী বিবেচনায় ইউরোপ-আমেরিকাকে কইয়ের তেলে কই ভাজার রাজনীতি থেকে সরে আসতে হবে। অভিবাসী ও শরণার্থীর মধ্যে অর্থগত বড় একটি তফাৎ হলো, অভিবাসীরা কেবল অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যের লক্ষ্যে, উন্নত জীবনযাপনের লক্ষ্যে দেশ ত্যাগ করে; আর শরণার্থীরা দেশ ত্যাগ করে, জাতিসংঘের পরিভাষায় বলতে গেলে, তাদের বর্ণ, জাতীয়তা এবং সামাজিক-রাজনৈতিক-মতাদর্শের কারণে। আপাতদৃষ্টিতে অর্থনৈতিক কারণ বলে মনে হলেও যে মানুষরা ইউরোপের দিকে ছুটছে, তারা আসলে নিজেদের বর্ণ, ধর্ম, মতাদর্শ ও জাতীয়তাকেই আর নিরাপদ মনে করছে না। বিশেষ করে আরব বিশ্বে মৌলবাদী জঙ্গিবাদের উত্থান সাধারণ মুসলমানদেরও ভীত করে তুলেছে। আর এর দায় ইউরোপ-আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতিরই। স্লোভেনিয়া খোলাখুলি বলেছে, মুসলিম শরণার্থী নিতে রাজি নয় তারা। কিন্তু তা ইউরোপের প্রতিটি রাষ্ট্রেরই নীতিনির্ধারকদের গোপন আকাঙ্ক্ষা। যদিও তাদের শরণার্থী হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি করেছে তারাই।
লেখক : সাংবাদিক