আন্তর্জাতিক
আইএস, দ্বৈত নাগরিক ও বাংলাদেশের ঝুঁকি
রুহুল আমীন ওরফে আব্দুল রাকিব সুমন ওরফে বারা আল হিন্দ। হিন্দ মুল্লুকের সাথে এই যুবকের কোনো সম্পর্ক না থাকলেও শেষের এই নামটি ধরে অনলাইনে সার্চ দেওয়া হলে ২৫ বছর বয়সি এই যুবকের হাজার হাজার ছবি ও ভিডিও মিলবে। প্রায় সব ভিডিওতে তিনি আইএস জঙ্গিদের গুণকীর্তন করে মুসলিম নরনারীদের এ্ই জঙ্গিদলে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। রুহুল আমীন ওরফে আব্দুল রাকিব সুমনের এই ভিডিও দেখে কত যুবক-যুবতি আইএসে যোগ দিয়েছে এই তথ্য জানা না গেলেও এই ভিডিওর বদৌলতে মোটামুটি দুনিয়াব্যাপী পরিচিতি পেয়ে গেছেন রুহুল আমীন। আইএসের শীর্ষস্থানীয় একজন জঙ্গি সদস্য হয়ে ওঠা রাকিব সুমনের জন্ম ১৯৮৯ সালে সিলেটের মৌলভীবাজারে। পাসপোর্টের (ব্রিটিশ পাসপোর্ট নম্বর 705477212) তথ্য অনুযায়ী ব্রিটিশ-বাংলাদেশি এই দ্বৈত নাগরিকের ঠিকানা আবেরডিন, স্কটল্যান্ড, যুক্তরাজ্য। এমআইসিক্স ও এফবিআইর তালিকায় তিনি এখন মোস্ট ওয়ান্টেড। তাঁর বর্তমান অবস্থান সিরিয়ার রাকা অথবা আলেপ্পোর কোথাও।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে একটি জরুরি চিঠি আসে। ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের ধারণা আমিন যুক্তরাজ্যে সন্ত্রাসী হামলা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অর্থ জোগানে সক্রিয় রয়েছে। যুক্তরাজ্য সরকারের এই চিঠির পর দেশের সব ব্যাংকে রেড নোটিশ পাঠায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট বা বিএফআইইউ (সংস্থাটি জঙ্গি অর্থায়ন ও মানিলন্ডারিং ঠেকাতে কাজ করে)। শেষ পর্যন্ত দেশের ব্যাংকে তাঁর কোনো অ্যাকাউন্টের হদিস পাওয়া গেল কি না এ নিয়ে কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক।সাধারণত এসব তথ্য আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয় না। আমিনের মতো উগ্রপন্থি যুবকদের ঠেকাতে গত জুলাইয়ে সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসী অর্থায়নবিষয়ক আইন সংশোধন করে ব্রিটিশ সরকারের ট্রেজারি বিভাগ । টেররিস্ট অ্যাসেট ফ্রিজিং-অ্যাক্ট ২০১০ নামের এই আইন সংশোধনের পর তাঁর সব সম্পদ ও পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করেছে ব্রিটিশ সরকারের ট্রেজারি বিভাগ।
২০১৩ সালের শেষভাগে সিরিয়ার পথে পাড়ি জমান পোর্টসমাউথের পাঁচ ব্রিটিশ বাংলাদেশি। তাঁদের নেতৃত্বে ছিলেন মাসুদুর চৌধুরী। ৩৩ বছর বয়স্ক মাসুদ পোর্টসমাউথের ১০ বাংলাদেশি যুবককে নিয়ে অল ব্রিটানি ব্রিগেড বাংলাদেশি ব্যাড বয়েজ নামের একটি দল গঠন করেছিলেন।
স্ত্রী ও সন্তানদের মর্মান্তিক একটি মিথ্যা তথ্য দিয়ে বাড়ি ছেড়েছিলেন মাসুদুর। বলেছিলেন তাঁর ক্যানসার ধরা পড়েছে। চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা দরকার। উদ্বিগ্ন আত্মীয়স্বজন ধার-দেনা করে তাঁর হাতে ৩৫ হাজার পাউন্ড (প্রায় ৪৩ লাখ টাকা) তুলে দেন। ওই টাকা দিয়ে গোপনে একটি গাড়ি কিনে একজন পতিতাকে সঙ্গে নিয়ে প্রমোদ ভ্রমণে যান মাসুদুর। সেখান থেকে ফিরে আরো চার বাংলাদেশি তরুণ, আসাদুজ্জামান (ছদ্ম নাম আবু আব্দুল্লাহ আল ব্রিটানি), মেহদি হাসান, হামিদুর রহমান ও মাননুর রশিদকে নিয়ে গ্যাটউইক বিমানবন্দর দিয়ে তুরস্ক হয়ে সিরিয়ায় পাড়ি জমান। ২০১৩ সালের ৮ অক্টোবর তাদের গ্যাটউইক বিমানবন্দর ত্যাগের এই ছবি আদালতে প্রমাণ হিসেবে দাখিল করা হয়। চার তরুণকে সিরিয়ায় রেখে ডিসেম্বরে লন্ডনে ফিরেই পুলিশের হাতে ধরা পড়েন মাসুদুর। সন্ত্রাসী তৎপরতায় যুক্ত থাকার অপরাধে গত বছরের ডিসেম্বরে তাঁকে চার বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেন লন্ডনের আদালত। মাসুদুরই প্রথম কোনো ব্রিটিশ নাগরিক, আইএসের সাথে যুক্ত হওয়ার অপরাধে যার শাস্তি হলো। জেল থেকে মুক্তি পাবার পর মাসুদুর আদৌ ব্রিটেনে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি পাবেন কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। কারণ আইএস ফেরত এই নাগরিকদের পাসপোর্ট বাতিলের মতো কঠোর আইন করেছে যুক্তরাজ্য।
মাসুদুর ও তাঁর দলটির আগেই সিরিয়ায় পাড়ি জমান পোর্টস্মাউথেরই আরেক ব্রিটিশ বাংলাদেশি যুবক ইফতেখার জামান। আদি নিবাস সিলেটের হবিগঞ্জে। তুরস্কে ইসলামিক স্টাডিজে পড়তে যাওয়ার নাম করে মা-বাবার সাথে প্রতারণা করেছিলেন ইফতেখার। গত বছরের জুলাইয়ে সিরিয়া থেকে স্কাইপে সরাসরি বিবিসির জনপ্রিয় অনুষ্ঠান নিউজ নাইটকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জিহাদের ডাক দিয়েছিলেন এই যুবক। কিন্তু খুব বেশি দিন জিহাদের নামে রক্তারক্তি করার সুযোগ পাননি ইফতেখার। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে সিরিয়ার দে’র আল জিউরে সরকারি বাহিনীর অস্ত্র গুদামে হামলা চালাতে গিয়ে তিনি মারা যান। তাঁর সাথেই মৃত্যু হয় আরেক ব্রিটিশ বাংলাদেশি যুবক হামিদুর রহমানের। ২৫ বছরের হামিদুর লন্ডনের রিটেইলার প্রাইমার্কের সুপারভাইজার ছিলেন। বলাবাহুল্য তিনিও স্বজনদের মিথ্যা বলেছিলেন। বলেছিলেন একটি সাহায্য সংস্থার পক্ষ থেকে সিরিয়ার নিপীড়িত মানুষের জন্য ত্রাণ কার্যক্রম চালাতে যাচ্ছেন।
সিরিয়ায় নিহত তৃতীয় ব্রিটিশ বাংলাদেশি যুবকটির নাম মামুনুর অথবা মাননুর রশিদ। গত বছরের ডিসেম্বরে সিরিয়া তুর্কি সীমান্তের কোবানিতে মার্কিন নেতৃত্বাধীন যৌথ বাহিনীর বিমান হামলায় তাঁর মৃত্যু হয়েছে। পোর্টসমাউথের পাঁচ তরুণের দলটির চতুর্থজন আসাদুজ্জামান ওরফে আবু আব্দুল্লাহ আল ব্রিটানীর মৃত্যু হয়েছে চলতি বছরের জুলাইয়ে। আইএসে যোগ দেওয়া ব্রিটিশ নাগরিকদের কর্মকাণ্ডের ওপর নজর রাখছে সরকারি এমন একাধিক সূত্র তাঁর মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছে।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে পূর্ব লন্ডনের বাঙ্গালি অধ্যুষিত এলাকা বেথনাল গ্রিনের তিন ছাত্রীর আইএসে যোগ দেওয়ার খবরটা গোটা বিশ্বের নজর কেড়েছে। এদের দুজন শামীমা বেগম ও খাদিজা সুলতানা। বয়স যথাক্রমে ১৫ ও ১৬। আর তৃতীয় জন তাদের বান্ধবী আফ্রিকান ব্রিটিশ আমিরা আবাসি। সম্প্রতি ডেইলি টেলিগ্রাফের অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত এক ভিডিওতে এই তিন কিশোরীকে আইএসের কথিত খিলাফত রাজ্যের রাজধানী রাকায় দেখা গেছে। বলা বাহুল্য জঙ্গিদের কঠোর আইন অনুযায়ী তাদের একটি করে জিহাদি স্বামী জুটেছে। এই দুই কিশোরীর আগেই গত বছরের ডিসেম্বরে সিরিয়া পাড়ি জমায় আরো এক ব্রিটিশ বাংলাদেশি কিশোরী শাহিনুর। ধারণা করা হচ্ছে অনলাইনে শাহিনুরের প্ররোচনাতেই শামীমা ও খাদিজার সিরিয়া যাত্রা।
সবশেষ সিরিয়ায় যোগ দেওয়া ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের তালিকার মর্মান্তিক সংযোজন হলো একই পরিবারের ১২ সদস্য। লন্ডনের লুটনের এই পরিবারটি আইএসে যোগ দেওয়ার ঘটনাটি এখনো রহস্যে ঢাকা। গত জুলাইয়ে সিলেট থেকে তুরস্কে বেড়াতে গিয়ে পরিবারটি নিখোঁজ হয়। পরিবারের সদস্যরা হলেন মুহাম্মদ আব্দুল মান্নান (৭৫), তার স্ত্রী মিনারা খাতুন (৫৩), তাঁদের মেয়ে রাজিয়া খানম (২১), পুত্র মোহাম্মদ জায়েদ হুসেইন (২৫), মোহাম্মদ তৌফিক হুসেইন (১৯), মোহাম্মদ আবিল কাশেম (৩১), তাঁর স্ত্রী সাইদা খানম (২৭), মোহাম্মদ সালেহ হুসেইন (২৬), তাঁর স্ত্রী রোশনারা বেগম (২৪) এবং এ দম্পতির ১ থেকে ১১ বছর বয়সি তিন সন্তান। পরিবারটির লন্ডনে থাকা স্বজনদের দাবি আইএসের গুপ্তচররা ইস্তাম্বুল থেকে তাঁদের অপহরণ করেছে।
নিশ্চিতভাবেই আইএসের পথে পা বাড়ানো এই নাগরিকদের দেশে ফেরার সব পথ বন্ধ করে দিয়েছে ব্রিটিশ সরকার। দ্বৈত নাগরিক হিসেবে তাঁরা বাংলাদেশের পাসপোর্টও ব্যবহার করেন। কিন্তু এই তরুণদের বাংলাদেশে ফিরে আসা বা তাদের দ্বারা সম্ভাব্য জঙ্গিবাদের বিস্তার ঠেকাতে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেই। এমনকি আইএসে যোগ দেওয়া এই ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের কোনো তালিকা সরকারের হাতে আছে কি না, সরকারি কোনো সংস্থা এই নাগরিকদের কর্মকাণ্ডের ওপর নজর রাখছে কি না সেটি স্পষ্ট নয়।
অন্তত সামিউন ওরফে ইবনে হামদান নামের এক ব্রিটিশ বাংলাদেশির দেশে ফিরে আসাটা সেটাই প্রমাণ করে। সামিউন যে কেবল নির্বিঘ্নে বিমানবন্দর পেরিয়ে দেশে ফিরেছেন তাই নয়। রীতিমতো তিনি সিরিয়ায় পাঠানোর জন্য জিহাদি সংগ্রহ করছিলেন। গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার কমলাপুর থেকে তাঁকে আটক করে পুলিশ। ধারণা করা যায় সিরিয়ায় জঙ্গিদলের সাথে যোগ দেওয়ার অপরাধে লন্ডনে ফিরলে তিনি বিচারের মুখোমুখি হতেন। সেই তুলনায় ঢাকায় ফেরাটা তাঁর জন্য নিরাপদ ছিল। আর কোনো বাধা ছাড়াই তুরস্ক হয়ে ঢাকা এবং নিরাপদে সিলেটে চলে যান সামিউন। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে সিরিয়ার নুসরা ফ্রন্টের সাথে লড়াই করার কথা স্বীকার করেছেন তিনি। দেশে ফেরার পর জিহাদি সংগ্রহে গুলশানের আজাদ মসজিদ ও সিলেটের হযরত শাহজালাল মাজার মসজিদে বেশ কটি গ্রুপের সাথে বৈঠক করেন। এসব বৈঠকে জেএমবি ও আনসারউল্লাহ ‘বাংলা টিম'সহ কয়েকটি উগ্রপন্থি দলের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন৷ প্রথম দফায় অন্তত ১০০ জনকে সিরিয়া পাঠানোর মিশন নিয়েই তাঁর ঢাকায় আসা।
কেবল ব্রিটেন নয়। সামিউনের মতো নাগরিকরা এখন গোটা বিশ্বেই অবাঞ্ছিত। কোনো দেশই আর তাঁদের গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়। ইউরোপের প্রায় সবকটি দেশ আইএসে যোগ দেওয়া নাগরিকদের পাসপোর্ট বাতিল করেছে। একই পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা আর অস্ট্রেলিয়ারও। আইএসে যোগ দেওয়া এই দ্বৈত নাগরিকদের ব্যাপারে বাংলাদেশের আদৌ কোনো উদ্বেগ আছে বলে মনে হয় না। যেমন উদ্বেগ নেই অনলাইনে ও সামাজিক যোগাযোগ ওয়েবসাইটে উগ্রপন্থার অবাধ প্রচার-প্রচারণা নিয়ে। বাংলাদেশে সক্রিয় রয়েছে আইএসের মতো চরম উগ্রপন্থাকে সমর্থনকারী হাজার হাজার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট। যেখানে প্রতিনিয়ত আইএসের বর্বরতাকে সমর্থন করে ধর্মের নামে হিংসা আর সংঘাত উসকে দেওয়া হচ্ছে। বিচার তো দূরে থাক এ ধরনের কার্যকলাপে যুক্ত কাউকে আজ অবধি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হয়েছে- এমনটা শোনা যায়নি। সম্ভবত বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেখানে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এমন বাধাহীন উন্মুক্ত উগ্রপন্থী প্রচারণা চালানো সম্ভব।
লেখক : সাংবাদিক, ২০১৪ সালে প্রকাশিত ‘আল-কায়েদা থেকে আইএস’ বইয়ের লেখক।