অভিমত
ভেঙে ফেল নীরবতা, আনো কর্মক্ষেত্রে সমতা
জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে একজন নারীকে শত বাধা অতিক্রম করে বর্তমান অবস্থানে আসতে হয়েছে। নারীরা স্বমহিমায় এগিয়ে যাচ্ছে নিজস্ব কর্মক্ষেত্রে। খেলার মাঠ থেকে শুরু করে এভারেস্ট বিজয়—সর্বক্ষেত্রে নারীরা ইতিহাস রচনা করছে। তবুও যেন নির্যাতনের মাত্রা পরিবার থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্রে কোনোভাবেই কমছে না। এ নির্যাতনের গভীরে প্রোথিত রয়েছে পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারী হওয়ার কারণে কতগুলো অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি আমিও। তার মধ্যে একটি ঘটনা থেকে আমি অনেক কিছু শিক্ষা নিয়েছি।
জীবনের তাগিদেই পড়াশোনার পাশপাশি তখন আমি একটি বেসরকারি রেডিও প্রতিষ্ঠানে আরজে হিসেবে কাজ করছিলাম। অফিস থেকে বের হয়ে যাত্রাবাড়ীর বাসে উঠলাম। নামার সময় প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে আমি হ্যারেজমেন্টের স্বীকার হই। এরপর সে যখন পালিয়ে যেতে থাকে, মানুষ দেখেও কোনো প্রতিবাদ করে না। আমি অবাক হই এবং পরমুহূর্তেই আমার ব্যাগ থেকে সেপটিপিন বের করে আমি তার কলার ধরে অপমানের প্রত্যুত্তর দিয়ে দিই। এর পরে লোকজন আমাকেই উল্টো দোষারোপ করতে থাকে। আমি কেন প্রতিবাদ করলাম? সমাজের প্রচলিত ‘ভালো মেয়ে’ হতে হলে এ ধরনের ঘটনায় চুপ থাকতে হয়, সহ্য করতে হয়। এ ধরনের ঘটনা শুধু আমি নই , আমরা যাঁরা প্রতিনিয়ত কর্মক্ষেত্রে যাওয়া-আসা করি, তাঁদের প্রত্যেকের সঙ্গেই ঘটে থাকে। এ রকম ‘আমি’ অনেকেই আছে, যারা নীরব থাকি, চুপ থাকি, প্রতিবাদ করতে ভয় পাই।
আজও নারীদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া অন্যায়ে তাদেরই চুপ থাকতে বলা হয়। যেসব নারী ‘সিঙ্গেল’ আছেন, সমাজ তাঁদের গলায় ‘অ্যাভেইলেবেলিটির’ এক অদৃশ্য সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়। সকালে-দুপুরে তাকে তাঁর সৌন্দর্যের প্রশংসায় আচ্ছাদিত হতে হয় কর্মক্ষেত্রে, যে আচ্ছাদনে তার এত বছরের এগিয়ে চলার সংগ্রামকে শুধু তার বাহ্যিক সৌন্দর্যের সঙ্গে সংযুক্ত করে তার অন্য সব গুণকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয় এবং তার সাফল্যের চাবিকাঠি হিসেবে তার সৌন্দর্যকেই একমাত্র গুণাবলি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অনেক বেশি ব্যক্তিগত প্রশ্ন, যেমন : কবে বিয়ে করছেন? এখনো বিয়ে করছেন না কেন? প্রতিনিয়ত তাকে এ ধরনের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে হয়। এত বছরের প্রচলিত সমাজে একজন পুরুষ একজন নারীকে মা, বোন বা স্ত্রী হিসেবে অধস্তন ভূমিকায় দেখতে অভ্যস্ত। তার এই মানসিকতা নারীকে একজন ব্যক্তি হিসেবে নয়, বরং বস্তু হিসেবে ভাবতে আগ্রহী করে তোলে।
পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করতে নানাবিধ পন্থা অবলম্বন করে। এর ফলে একজন নারীকে বিভিন্ন বৈরী পরিবেশের মুখোমুখি হতে হয়। এটা আমি, আমরা, আমাদের নিত্যদিনের ঘটনা। আবার অনেক ক্ষেত্রেই নারীকে কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়। জায়গাভেদে, পরিবেশভেদে, পেশাভেদে নারীর যৌন হয়রানির রকমফেরটা আলাদা হতে পারে। এটাই শুধু পার্থক্য।
নারীদের নীরবতা তথাপি সমাজের নীরব থাকার প্রবণতা তাকে ভঙ্গুর করে দেয়। তাকে বাধ্য করে নিজেকে গুটিয়ে নিতে। তাই সময় এসেছে সব নীরবতাকে ভেঙে দেওয়ার, নির্যাতিতা নয়; বরং নির্যাতককে সমাজের সামনে অপদস্থ করার। সমতা ও সাম্যে বিশ্বাসী সব নারী-পুরুষ একসঙ্গে নারীর প্রতি অন্যায়ের প্রতিবাদ করুক। বছরের প্রতিটি দিন হোক নারী-পুরুষ সবার সমানভাবে বেঁচে থাকার দিন। সকলকে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের শুভেচ্ছা।
লেখক : প্রভাষক, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।