শোকাবহ আগস্ট
বঙ্গবন্ধুর ছবি
১৯৯৬ সালের কথা। তখনো বিএনপির শাসনকাল চলছে। সম্ভবত এডিবি অর্থ জোগান দিয়েছে। মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক পর্যায়ে এনসিটিবির পাঠ্য বই নতুন ও যুগোপযোগী করে রচনা করতে হবে। সিলেবাস তৈরি ও গ্রন্থ প্রণয়ন কমিটির সদস্য করা হলো আমাকে। নবম-দশম শ্রেণির মানবিক শাখার জন্য পাঠ্য ইতিহাস বইয়ের পাঠক্রম তৈরি ও গ্রন্থ প্রণয়নের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল আমাকে। মনে পড়ে কারো খবরদারি ছাড়াই স্বাধীনভাবে গ্রন্থ রচনার দায়িত্ব শেষ করতে পেরেছিলাম। সে বই বিএনপির শাসনামলেই শিক্ষার্থীদের হাতে চলে যায়। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সময়কালের ইতিহাস নানা পর্বে রাজনৈতিক কাটা ছেড়া হয়েছে। আমরা ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধতা নিয়ে ইতিহাস লেখার নিয়ম পদ্ধতি মেনে লিখেছিলাম। বঙ্গবন্ধুর মূল্যায়ন, জিয়াউর রহমানের মূল্যায়ন ইতিহাসনিষ্ঠভাবেই করা হয়েছিল। তখনো সম্পাদনার কোনো কাঁচি চলেনি। এর অল্প পরই আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। একদিন বিস্ময়ের সাথে দেখলাম আমি এবং আমার সহলেখক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক রতনলাল চক্রবর্তীকে অজ্ঞাত রেখেই সরকারের গঠন করা সংস্কার কমিটি অনেকটা অপ্রয়োজনে জিয়াউর রহমানের অংশটি কিছুটা খাটো করে দিলেন। আর যায় কোথায়- টনক নড়ল বিএনপি নেতাদের। পালাক্রমে বিএনপি এরপরে সরকার গঠন করল। তারাও সংস্কার কমিটি গঠন করল। যথারীতি আমরা লেখকরা অবহিত হলাম না। এবার মনের ঝাল মিটিয়ে কাটাকুটি হলো। খুব মনোযোগে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিটি ছাটাই হয়ে গেল। নিরাভরণ শেখ মুজিবুর রহমান লেখা হলো সর্বত্র। ৭ মার্চের ভাষণ থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটুকু বাদ দিয়ে পাকিস্তানিদের সুযোগ দিতে যে চারটি শর্ত দেওয়া হয়েছিল তাই শুধু উল্লেখ করা হলো। ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল’, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’-এই গভীর তাৎপর্যবাহী বাক্যগুলো আড়াল করে ফেলা হলো। জিয়াউর রহমান জীবদ্দশায় যে দাবি করেননি। তা যুক্ত করে জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বানানোর প্রণান্ত চেষ্টা করা হলো।
তখন থেকে মুক্তিযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট কয়েকটি প্রশ্ন আমাকে তাড়িয়ে বেড়াত। ইতিহাস বিকৃত করে অথবা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তে বঙ্গবন্ধু আর তাঁর পরিবারকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে যে অন্যায়কে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না এ সত্য কেন বুঝতে পারে না চক্রান্তকারীরা। মুক্তিযুদ্ধে সেক্টর কমান্ডার হিসেবে জিয়াউর রহমানের একটি উজ্জ্বল অবস্থান ছিল। একে ধারণ করে দলকে প্রাণিত করা উচিত ছিল বিএনপির। এই সত্যটি কি ইতিহাস ধারণ করবে না যে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া হঠাৎ কোনো ঘটনা নয়। দীর্ঘদিনের আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যদিয়ে বাঙালি ১৯৭১ সালে এসে দাঁড়িয়েছিল। ততক্ষণে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু সুপ্রতিষ্ঠিত। এই দীর্ঘ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে জিয়াউর রহমান স্বাভাবিকভাবেই অনুপস্থিত ছিলেন। সেনাবাহিনীর একজন বাঙালি মেজর জিয়াউর রহমানের নামের সাথে মানুষের প্রথম পরিচয় ১৯৭১-এর ২৭ মার্চে। কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করার পর থেকে।
৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর প্রকৃত পক্ষে আনুষ্ঠানিক আর কোনো ঘোষণার প্রয়োজন ছিল না। না হলে ২৫ মার্চের রাতে ফার্মগেটে কোন অগ্নিমন্ত্রে ছাত্র জনতা পাকবাহিনীর সাঁজোয়া যানের সামনে প্রতিরোধ গড়ে তুলে আত্মাহুতি দিয়েছিল! ইপিআরের বাঙালি জোয়ানরা কেমন করে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে পেরেছিল পিলখানায়। আর রাজারবাগে পুলিশ বাহিনীর বীরোচিত প্রতিরোধ যুদ্ধ হয়েছিল ২৭ নয় ২৫ মার্চের কালরাতেই। সে সময় আমাদের সামনে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি অনুভব করতে কিছুমাত্র অসুবিধা হয়নি।
পাকবাহিনীর বুলেট বৃষ্টির মধ্যদিয়ে হাজার হাজার বাঙালির সাথে আমরাও নারায়ণগঞ্জের বাড়ি রেখে সপরিবারে পালিয়ে ছিলাম। গ্রাম থেকে গ্রামে বার বার অবস্থান পাল্টিয়েছি। আর এ সময় প্রতিটি মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু জীবন্ত ছিলেন আমাদের সবার বুকে। এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে কাগজ-কলম নিয়ে কতবার বঙ্গবন্ধুর ছবি আঁকার চেষ্টা করেছি। কতগুলো বৈশিষ্ট্যের কারণে বঙ্গবন্ধুর ছবি আঁকাটা আমার কাছে অনেক বেশি সহজ মনে হয়েছিল। ব্যাকব্রাস করা চুল। মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। পুরু গোঁফ।... কয়েকবার চেষ্টায় বঙ্গবন্ধুর মুখাবয়ব যেন কিছুটা ফুটিয়ে তুলতে পারতাম। বড়রা উৎসাহ দিতেন। এখন বুঝতে পারি পাকিস্তানের কারাগারে অন্তরীণ হলেও আমাদের বুকে বঙ্গবন্ধু কতটা জীবন্ত ছিলেন। আমাদের নানি, মা, ফুপুদের দেখেছি কতদিন তাঁরা রোজা রেখেছেন বঙ্গবন্ধু যাতে নিরাপদ থাকেন সেই প্রার্থনায়।
দৃষ্টির আড়ালে থাকলেও বঙ্গবন্ধু মনের আড়ালে ছিলেন না। তাই স্পষ্টই বলা যায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের প্রত্যক্ষ পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। কিছু সংখ্যক পাকিস্তানের তাবেদার দালাল ছাড়া দলমত নির্বিশেষে সব বাঙালি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থাকলেও বঙ্গবন্ধুর প্রেরণা গোটা নয় মাসই উজ্জীবিত রেখেছে বাংলার মুক্তিপাগল মানুষকে। তাই মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর স্বাধীন বাংলাদেশে মার্কিন-পাকিস্তান-সৌদি লবি প্রতিশোধের নেশায় মত্ত হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর সফল নেতৃত্ব তাদের ভীত করে তুলেছিল। ভারত-রাশিয়া মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিকে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেছে। বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা স্বাধীন দেশেও আকাশচুম্বী। বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শক্ত পায়ে দাঁড়াতে পারলে দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন প্রভাব দুর্বল হয়ে পড়বে। পাকিস্তানের চেষ্টা ছিল বাংলাদেশে তাদের সেবাদাস ধর্মীয় দলগুলোর মাধ্যমে নৈরাজ্য তৈরি করে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগকে অজনপ্রিয় করে তোলা। এই লক্ষ্যে তারা অনেক দূর অগ্রসরও হয়েছিল। আওয়ামী লীগের ভেতরে ভাগাড়ের শকুন খোঁজার চেষ্টা হলো। মোশতাকের মতো শকুন পেতেও দেরি হলো না। উপমহাদেশের পারিবারিক রাজনীতির ঐতিহ্য ষড়যন্ত্রকারীদের সতর্ক করে তুলেছিল। এরা বুঝেছিল প্রো-মার্কিনি আর প্রো-পাকিস্তানি প্রভাব প্রতিষ্ঠা করতে হলে বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে সমূলে বিনাশ করতে হবে। কারণ বাংলার মানুষের হৃদয় থেকে বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসা মুছে ফেলা কঠিন। এভাবেই ১৫ আগস্টের কালরাত্রের নীল নকশা তৈরি হলো। সেনাবাহিনীর ভেতর পাকিস্তানপন্থী শকুন পেতে দেরি হলো না। এক চরম বীভৎসতায় এরা সপরিবারে জাতির জনককে হত্যা করল।
পরবর্তী রাজনীতিতে পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রের বিষয়টি স্পষ্ট হতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত হত্যাকারীদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় না করিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। পাকিস্তানিদের ইচ্ছে পূরণে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত এমন অনেক মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে গোপন বিচারে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করার বিষয়টি কারো অজানা নয়। রাজাকার-আলবদরের চিহ্নিত নেতারা স্বাধীন দেশে মন্ত্রিসভায় জায়গা করে নিল। বঙ্গবন্ধুর এই হত্যাকাণ্ড জাতির জন্য চরম ক্ষতি সন্দেহ নেই। তবে ষড়যন্ত্রকারীরা জিতে গেছে এমনটি ভাবারও কোনো কারণ নেই। স্থূলবুদ্ধির পাকিস্তানি নেতারা ১৯৪৭ সালেই যেমন বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিবেচনায় না এনে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চেয়ে হোঁচট খেয়েছিল, নির্বিচার গণহত্যা চালিয়ে বাঙালির মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে নির্বাপিত করতে গিয়ে বাংলা ছাড়তে হয়েছিল তেমনি ১৫ আগস্ট সৃষ্টি করে রাজনীতি থেকে নিশ্চিহ্ন করা যায়নি বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে। আর বঙ্গবন্ধুর রক্তকণা থেকে বাঙালির হৃদয়ে লক্ষ মুজিব জীবন্ত হয়েছে। তাই ইতিহাসের স্বতঃস্ফূর্ত ধারাবাহিকতা বোঝার ক্ষমতা থাকলে পাকিস্তানপ্রেমী স্বপ্নবিলাসীদের বোঝা উচিত বাংলাদেশের মাটি পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের মতো নিরস কঙ্করময় নয়, সরস মানবিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য লালন করেছে হাজার বছর ধরে। এখানে বাঙালি তার নিজস্ব সত্তা নিয়েই বেঁচে থাকবে। যে মনস্তাত্ত্বিক ভীতি থেকে ষড়যন্ত্রকারীরা ১৫ আগস্টের অন্ধকার জন্ম দিয়েছিল সে ভীতি মুক্ত হওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়