সোশ্যাল মিডিয়া-নির্ভরতা অনলাইন সাংবাদিকতার জন্য ক্ষতিকর
২০০০ সালে যুক্তরাজ্যে প্রথম যাত্রা শুরু করেছিল স্বতন্ত্র অনলাইন নিউজপোর্টাল। তবে এর কিছুকাল আগেই প্রিন্ট মিডিয়ার প্রবেশ ঘটে অনলাইন দুনিয়ায়। সুতরাং স্পষ্ট করে বলা যায়, অনলাইন মিডিয়ার ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। এই সামান্য সময়েই অনলাইন মিডিয়া অফলাইনকে বাণিজ্যিকভাবে হুমকির মুখে ঠেলে দিতে সক্ষম হয়েছে। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে পৃথিবীর সব দেশেই কাগজের পত্রিকাগুলো বলা চলে অনলাইন ভার্সনে যেতে অনেকটা বাধ্য হয়েছে।
অনলাইন মিডিয়ার এই দ্রুত সম্প্রসারণের প্রভাব জেঁকে বসেছে বাংলাদেশেও। শুরু হয়েছে এক ২৪ ডটকম প্রতিযোগিতা। যদিও বিশ্বের বড় বড় নিউজপোর্টালের বেশির ভাগই তাদের ওয়েব ঠিকানায় যুক্ত করেনি ২৪ কথাটি। তবুও এই ধারা বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়ে গেছে। এর পেছনে রয়েছে বিডিনিউজ২৪ডটকমের অবদান। দেশের প্রথম অনলাইন নিউজপোর্টালের হাত ধরেই ‘২৪’ হয়ে উঠেছে এ দেশে নিউজভিত্তিক ওয়েব ঠিকানার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। দু-একটি নিউজপোর্টাল অবশ্য এই ধারা থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের স্বকীয়তা প্রমাণে এরই মধ্যে সক্ষম হয়েছে।
অনলাইন মিডিয়া দেশের বাজারে সুস্থভাবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আগেই শুরু হয় এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতার নেতিবাচক প্রভাব বিভ্রান্ত করেছে পাঠক ও পৃষ্ঠপোষকদের। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠায় মূলধারার অনলাইন সাংবাদিকরা প্রতিনিয়তই বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়ছেন। আর নিজেদের প্রচার ও প্রসারের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া। ফেসবুক, টুইটার বা অন্য সব সোশ্যাল সাইটকে সর্বোচ্চ ব্যবহারে এগিয়ে থাকছে অপেশাদার নিউজপোর্টালগুলো।
সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী বা নেটিজেনরা প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছে এসব সস্তা লিংক শেয়ারের কারণে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, খুব আকর্ষণীয়ভাবে নানা রং-ঢং করে শিরোনাম দিয়ে লিংক শেয়ার করে সেগুলোতে ক্লিক করতে পাঠকে আকৃষ্ট করে এই অপেশাদার সাইটগুলো। তবে এসব ক্ষেত্রে কোনো প্রশিক্ষণ বা গবেষণা না থাকার ফলে বেশির ভাগ সময় চটকদার অনলাইনওয়ালারা জানেনও না যে, পুনরায় কোনো পাঠক ওই সব সাইটে প্রবেশ করছেন না।
বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীর সঙ্গে আলাপ করা জানা গেছে, প্রতি ১০ জনে আটজনই লিংক-সংক্রান্ত প্রতারণার শিকার হন এবং তাঁরা পুনরায় ওই সাইটে প্রবেশ করেন না। আবার কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, লিংকে শুধু ভুল তথ্যই নয়, অনেক সময় কম্পিউটার, ট্যাব বা মোবাইল ফোনের ক্ষতি করতে পারে এমন উপকরণও পাওয়া যায়। তবে ব্যাপকভাবে যে কয়টি নিউজপোর্টাল পরিচিতি অর্জনে সক্ষম হয়েছে, সেসব সাইটের লিংকে ক্লিক করতে তাঁরা ভয় পান না বা অনিশ্চয়তায় ভোগেন না।
এসব নিউজ সাইট যে গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের চেয়ে লাইকে শেয়ারের সংখ্যা বাড়াতেই অধিক মনোযোগী, তা প্রতীয়মান হয় শেয়ার করা নিউজের হেডলাইনের ধরন দেখলেই। যেমন—কী বলেছিলেন মাশরাফি?, একি করলেন মিম? অমুকের মন্তব্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলপাড় ইত্যাদি।
নিউজের সঙ্গে ছবি ব্যবহারেও দেখা যায়, রগরগে করে তোলার প্রবণতা। এ ঘটনাটি বেশির ভাগ ঘটে থাকে বিনোদন জগতের সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে। যে বিষয়ে নিউজ করছে, সে-সংক্রান্ত ছবি প্রকাশ না করে পুরোনো ছবি থেকে স্বল্প বসনার ছবি প্রকাশই থাকে মুখ্য উদ্দেশ্য। এ পদ্ধতিতে পাঠককে কিছুটা আকৃষ্ট করা সম্ভব হলেও গ্রহণযোগ্যতা অর্জনে এটি বড় বাধা হয়ে কাজ করে। কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠানকেও এমন চর্চায় দেখা যায়। অনলাইন নিউজপোর্টালের পাঠকদের প্রতি ১০ জনের ৯ জনই মনে করেন, ‘নোংরা’ ছবি প্রকাশের এই প্রবণতা সুস্থ সাংবাদিকতা নয়।
অনলাইন নিউজপোর্টালগুলোর পাঠকদের বড় একটি অংশ মনে করে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দায়সারা গোছের সংবাদ প্রকাশ করে মূলধারার অনেক নিউজ সাইট। বিশেষ করে কোনো কোনো সংবাদ প্রবাহকে শুধু তাৎক্ষণিকভাবে যতটুকু ঘটনা, ততটুকু প্রকাশেই শেষ করে দেওয়ার ফলে তাদের পরের দিনের কাগজের দৈনিকে চোখ রাখতেই হয়।
৮০ জন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের প্রতি ১০ জনে পাঁচজন শুধু সোশ্যাল মিডিয়ার লিংক থেকেই নিউজপোর্টালে প্রবেশ করতে অভ্যস্ত। আলাদা করে পোর্টালের ওয়েব ঠিকানা তারা ব্রাউজ করেন না। অন্যদিকে এদের মধ্যে ছয় ভাগই পরের দিনের কাগজের দৈনিক পড়তে অভ্যস্ত নয়। সাত ভাগ পাঠক মনে করেন, প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি নিউজপোর্টাল বাদে অন্যরা সবাই অন্য সাইট থেকে নিউজ কপি করে কিছুটা বদলে কখনো কখনো তাও না করে নিজেদের সাইটে প্রকাশ করে।
সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে যাঁরা সংবাদপাঠে অভ্যস্ত, অর্থাৎ যেসব পাঠক কোনো সাইটে প্রবেশ না করে সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করা লিংক থেকে সংবাদপাঠে অভ্যস্ত, তাঁরা সংবাদপাঠের কিছুক্ষণ পর সংবাদটির সূত্র ভুলে যান। এর কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, যেহেতু অনেক অনেক লিংক চোখে আসে, সেখানকার কোনোটিই বা একাধিক তাঁরা পাঠ করেন, সেহেতু পাঠ-পরবর্তী সময়ে তাঁদের মনে থাকে না কোন নিউজপোর্টালের নিউজটি তিনি পড়েছেন। এ কারণে অবশ্য কখনো কখনো পাঠকরা প্রতারিত হয়েছেন, এমন সাইটে পুনরায় ঢুকে পড়েন।
এ ধরনের লিংক শেয়ার ও রগরগে ছবিনির্ভর অনলাইন সাংবাদিকতা এই মাধ্যমটিকে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত করবে, তা সময় বলে দেবে। তবে এটুকু অনুমান করা যায় যে, যেসব নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান নীতিমালার মাধ্যমে নানা মাধ্যমকে এরই মধ্যে হাত-পা বেঁধে দেওয়ার চেষ্টায় রয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠান এসব দুর্বলতাকে পুঁজি করে সাংবাদিকতার এই অগ্রসরমান নতুন ধারাটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
অতএব, নিজেদের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে, এ ধরনের চর্চা থেকে এখনই বের হওয়া জরুরি।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী