আলোচনা
পরাধীনতার মধ্যে বন্দি আছি : সলিমুল্লাহ খান
নেওয়াজ মোর্শেদ দীপু প্রযোজিত এবং এস এম আকাশের উপস্থাপনায় ৯ আগস্ট দিবাগত রাত ১২টা ১০ মিনিটে এনটিভির নিয়মিত টক শো ‘এই সময়’-এর আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম ও ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান। তাঁরা কথা বলেন সমসাময়িক আলোচিত বিষয় ব্লগার হত্যা ও পুলিশের ভূমিকা নিয়ে। অনুষ্ঠানটি শ্রুতিলিখন করে নিচে দেওয়া হলো :
urgentPhoto
উপস্থাপক : প্রথমেই মুজাহিদুল ইসলাম আপনার কাছে জানতে চাই, সম্প্রতি আরো একজন নতুন ব্লগার খুন হলেন। আমরা দেখেছি, যখন কোনো ব্লগার খুন হন, তখন চারদিকে বেশ হৈচৈ থাকে এবং পুলিশ আশ্বস্ত করে এই বলে যে আমরা দেখছি, তদন্ত করছি, এটার অগ্রগতি থাকবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা দেখি যে আসামি ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকে। আবার আসামি গ্রেপ্তার হলেও তদন্তের কোনো অগ্রগতি থাকে না। এভাবে আর কত দিন চলবে?
মুজাহিদুল ইসলাম : প্রথমেই কিছু বলার আগে বলি, গত পরশু দিন নীলাদ্রি নিলয়, ডাকনাম নীল—এ নামেই বেশ পরিচিত, তাঁকে যেভাবে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে, সেটা আমি তীব্র ভাষায় নিন্দা করছি। সমস্ত দেশবাসী এই ঘটনায় স্তম্ভিত এবং ক্ষুব্ধ। এটা নতুন ঘটনা, তা না। এর আগে এই একই কায়দায় আরো কতগুলো হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করা হয়েছে। এবং সেগুলোর কোনো সুরাহা এখন পর্যন্ত হয়নি। দেশের সামগ্রিক অবস্থার দিকে তাকালেও আমরা দেখতে পাব যে, অতি সাম্প্রতিককালে এটা বেশ দৃশ্যমান যে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বেশ গুরুতর অবনতি আমরা লক্ষ করছি। নারী নির্যাতন, ধর্ষণের ঘটনা থেকে শুরু করে শিশু হত্যা, এমনকি চোখ উপড়ে ফেলা, বস্তাবন্দি লাশ আগেও পাওয়া গেছে; কিন্তু এখন এটার পরিমাণ এবং ঘনত্ব উপর্যুপরি সেটা যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, এ ঘটনার বীভৎস যে চরিত্র তার প্রতি আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করা উচিত। এবং সেটা বেশ উদ্বেগের বিষয়। কেউ হয়তো বলতে পারে, এটা ঘটনা মাত্র। কিন্তু আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, এটা সামগ্রিকভাবে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার যে কতগুলো মৌলিক গলদ, সেটারই বহিঃপ্রকাশ বা বিস্ফোরণ আমরা এটার মধ্য দিয়ে দেখতে পাচ্ছি। এবং সেই জায়গাটা ভালো করে উপলব্ধি না করলে, আমরা হয়তো এটা থেকে বের হয়ে আসতে পারব না।
এটার সঙ্গে আরো একটি প্রশ্ন জড়িত যে, এ ধরনের অপরাধমূলক ঘটনা ঘটছে; কিন্তু সেটা সমাজের ভেতর থেকেই কতগুলো অসুস্থ উপাদান এমন একটা আগ্নেয়গিরির মতো বিস্ফোরণ তাদের ভেতরে চলে এসেছে যে, চতুর্দিকে এটা ছড়িয়ে পড়ার লক্ষণ দেখছি। এটাকে আইনের আওতায় এনে একটা নিবৃত্তিমূলক ব্যবস্থা কেন গ্রহণ করা হচ্ছে না? সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরেও একটা গলদ এবং সেই গলদটা এমন জায়গায় চলে গেছে যে বিচারহীনতার একটি পরিস্থিতি মানুষের ভেতরে এবং তার ধারণার ভেতরে জিনিসটি দাঁড়িয়েছে যে, এটার কোনো বিচার পাওয়া যাবে না। যেমন নীলাদ্রির কথাই যদি ধরা যাক, কিছুদিন আগে, মাত্র দুই-তিন মাস আগে, সে কিন্তু অনুসরণ করার কথা বলেছে, সে একটু ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পুলিশের শরণাপন্ন হয়েছিল যে, এই ব্যাপারে আপনারা একটু দেখুন, আমি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। পুলিশ তাকে এক থানা থেকে আরেক থানায়—এ রকম করতে করতে পরে এ রকম একটি সুপারিশ দিল যে, একটাই আপনাকে উপদেশ দিতে পারি, আপনি বিদেশে চলে যান।
তো, এ ধরনের ঘটনা থেকে কিংবা অভিজিৎ হত্যাকাণ্ড—প্রকাশ্য একটা স্থান একেবারে বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে এবং সেখানে পুলিশ অন ডিউটি, ওই প্রাঙ্গণে বইমেলা থেকে বেরিয়ে আসার সময় তাঁকে যেভাবে হত্যা করা হয় এবং তার পরে সেটা সুরাহা করার জন্য কোন জায়গায় যাওয়া গেল না। এখানেই আরেকটি উপাদানের কথা আমি বলতে চাই যে, এটা খালি সমাজের ভেতরে বর্বরতার উপাদানগুলো বেড়ে যাচ্ছে। পচনের প্রক্রিয়াটা যে কত ভয়াবহ এবং বীভৎস হতে পারে, তারই বহিঃপ্রকাশ হিসেবে এটা ঘটছে। শুধু এইটুকু বলে দিলেই কিন্তু সবটা বলা হয় না। এটার সঙ্গে আমি দেখতে পাচ্ছি যে খুবই পরিষ্কার অন্তত আমার কাছে যে, নানা রকম আন্তর্জাতিক শক্তির কতগুলো ঘাত-প্রতিঘাতে এই ব্যাপারগুলো কিন্তু ঘটছে।
উপস্থাপক : অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খানের কাছে জানতে চাইছি, এই আলামতগুলো যে দেখা যাচ্ছে, এই যে ব্লগারদের বেছে বেছে খুন করা হচ্ছে। আগে আমরা দেখেছি, রাস্তাঘাটে সুযোগ বুঝে খুন করা হতো আর দিনের বেলা এখন তো ঘরে ঢুকে খুন করা হচ্ছে। যেখানে আশপাশে এত মানুষ ছিল, সেখানে এতটা সাহস এলো কীভাবে? এগুলো কিসের আলামত এবং পুলিশ কিন্তু এর সুরাহা করছে না কেন?
সলিমুল্লাহ খান : আমাদের পুলিশ তো অনেক ক্ষমতাশালী বর্তমানে। প্রায় সবাই বলছে, আমাদের রাষ্ট্র দিন দিন পুলিশ-রাষ্ট্র হয়ে উঠছে। এই অভিযোগটার মধ্যে কিছুটা হলেও সত্যতা তো আছেই। তদুপরি আমাদের বিশেষ বাহিনী হিসেবে র্যাব গঠন করা হয়েছে। তারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ আসামি ধরতে পারে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাদের যে সাফল্যের অভাব অনেক দিন ধরে, আমরা অনেকগুলো হত্যাকাণ্ডের খবর জানি, যেগুলো তদন্ত করে তারা কোনো ফল বের করতে পারেনি, যেমন—বিখ্যাত হত্যাকাণ্ড রাজাবাজারে, সাগর-রুনি দুই সাংবাদিকের হত্যাকাণ্ড। কাজেই পুলিশের সাফল্য আছে, অসাফল্যও আছে। এখন অভিজিৎকে হত্যা করা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায়, সেটা প্রকাশ্য বলা যেতে পারে, পাবলিক প্লেস এবং সেটাও দিনের বেলা না হলেও সন্ধ্যার পরে অনেক মানুষজন ছিল। এতে বোঝা যাচ্ছে, আমরা পাবলিক প্লেসে নিরাপদ নই।
আরেকজন যে, ওয়াশিকুর রহমানকে হত্যা করা হলো তাঁর বাড়ি থেকে দূরে তেঁজগাওতে অথবা সিলেটে অনন্ত দাশকে হত্যা করা হলো তাঁর বাড়ি থেকে একটু বাইরে রাস্তায়। এখন সর্বশেষ যে ঘটনাটা ঘটল এটা একেবারে বাড়ির ভেতরে। তাহলে মানুষ নিরাপদ কোথায়? রাস্তায় নয়, প্রাঙ্গণে নয়, এমনকি তাঁর নিজ বাড়িতেও নয়। তাতে বোঝা যাচ্ছে, সেলিম ভাইয়ের কথার সাথে আমি শতকরা শতভাগ একমত যে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অসাধারণ অবনতি হয়েছে। যেমন আরো দুটি ঘটনার কথা উল্লেখ না করলেই নয় যে, সিলেটের একজন তেরো কি চৌদ্দ বছরের বালক রাজন এবং খুলনায় রাকিব। এই হত্যাকাণ্ডগুলো শুধু হত্যা নয়, তার মধ্যে একটা বীভৎসতা আছে, একটা নির্যাতন আছে। অনেকেই বলে পাশবিক নির্যাতন, আমি বলি এটা মানবিক নির্যাতন। যেটার মধ্যে একটা যৌন নির্যাতনের বিকৃতিও লক্ষ করা গেছে। এগুলো সমাজতাত্ত্বিকদের ভেবে দেখার বিষয়। যারা ওদের নির্যাতন করেছে তাদেরকে ধরে ফেলা হয়েছে, সিলেটের ঘটনাটার নির্যাতনকারীকেও হয়তো ধরা হবে। কিন্তু যেগুলো রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, সংঘটিত হত্যাকাণ্ড যার প্রতি সেলিম ভাই সঠিকভাবেই আন্তর্জাতিক ঘাত-প্রতিঘাতের কথা নির্দেশ করেছেন, যা নিশ্চয়ই আলোচনা করা হবে। এগুলোর ক্ষেত্রে পুলিশের ব্যর্থতা অবাক লাগে। যেমন ধরুন রাজীব হায়দারকে যারা হত্যা করেছে দুই বছর আগে, এই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত কয়েকজন ছাত্রকে ধরা হয়েছিল। কিন্তু তার পর কী হলো? তার চার্জশিট কোথায়? এর কথা আমরা জানছি না কেন?
তাহলে বোঝা যাচ্ছে এখানে কোনো ব্যাপার আছে, যে কারণে তদন্ত স্থগিত হয়ে গেছে, না হলে গ্রেপ্তার করার পরেও এই বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই কেন? ওদের পরিচয় কেন প্রকাশ করা হচ্ছে না, যেমন সাধারণ অপরাধীদের প্রকাশ করা হয়? মিডিয়ারও এখানে একটা ভূমিকা আছে, রাষ্ট্রেরও ভূমিকা আছে। এখানে সুশীল সমাজের সমাজতাত্ত্বিক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লে চলবে না। আমাদের বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে কংক্রিট হতে হবে।
এই ব্লগার কথাটি যে আপনি বললেন, বাংলাদেশে ব্লগার কথাটি চালু হয়েছে, শব্দটি নতুন। ১০ বছরের বেশি হয়নি। সম্ভবত ২০০৬-এর আগে বাংলাদেশে ব্লগিং চালুই হয়নি। তার পরই এলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তারপরই গত ১০ বছরে ব্লগারের সংখ্যা বেড়েছে আর এই শব্দটিকে খারাপ শব্দ হিসেবে চালু করার চেষ্টাও হচ্ছে। বিশেষ করে ২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ব্লগার শব্দটিকে টার্গেট করে আক্রমণ করা জন্য সংঘবদ্ধ হয়ে পরিকল্পনা করা হয়েছে কিছু মহলের পক্ষ থেকে। তার মধ্যে একটি বিখ্যাত পত্রিকাও জড়িত ছিল। ব্লগার কথাটিকে গালি দেওয়ার জন্য যেভাবে চালু করা হয়েছে, তার পিছনে একটা পরিকল্পনা রয়েছে। আমি ষড়যন্ত্র বলব না। যেমন আগে যারা পাত্রিকায় লিখতেন, পত্রিকাকে ফরাসি ভাষায় জার্নাল বলা হয় এ জন্য তাদেরকে জার্নালিস্ট বলা হয়, এখন জার্নালিস্ট বামপন্থীও হতে পারে, আবার ডানপন্থীও হতে পারে। সেভাবে ব্লগিং কিন্তু সবাই করতে পারে। যেমন কবি, একসময় কবিতা নিয়েও নিন্দা করা হতো, প্লেটোর মতো দার্শনিক বলেছেন, কবিরা মিথ্যুক। কিন্তু তাই বলে পৃথিবী থেকে কবিতা বন্ধ হয়ে যায়নি। মানুষ এখনো কিন্তু কবিতা লেখে। ব্লগিংও বন্ধ হবে না।
মানে এটা হচ্ছে মত প্রকাশের একটি নতুন মাধ্যম। যখন ছাপাখানা ছিল না, তখন পৃথিবীতে ধর্মগ্রন্থও ছাপানো যেত না, কাব্যগ্রন্থও ছাপানো যেত না এবং অন্যান্য গ্রন্থও ছাপানো যেত না। এটা গত পাঁচশ বছরের কাহিনী। দৈনিক পত্রিকা যখন মুদ্রণ হওয়া শুরু হলো, তখন বইয়ের পাঠক বেশি হলো। এখন এই যে ইলেকট্রনিক মিডিয়া যাঁরা দেখছেন, এটারই মতো মিডিয়া ব্লগিং হচ্ছে এমন একটি জায়গা, যেখানে মানুষ মত প্রকাশ করতে পারে। এখানে একটা কথা শুধু আমি বলব, যেহেতু সেখানে কোনো সম্পাদক নেই, ব্যাপক অর্থে, সে জন্য মানুষ অবাধে তার মত প্রকাশ করতে পারে। এবং তারা অনেকের মনকে আহত করে, এটা সত্য। এ ক্ষেত্রে কী করা উচিত, সে জন্য আমাদের একটি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক করা উচিত। যেমন নিউইয়র্ক টাইমসের মতো পত্রিকাও এখনো ছাপায় ‘এভরিথিং ফিট টু প্রিন্ট’, যা কিছু ছাপার যোগ্য সবই আমরা ছাপব। কিন্তু ছাপার যোগ্য কোনটা? এটা ঠিক করবে কে? সম্পাদকই তো ঠিক করেন। কিন্তু ব্লগিংয়ের মধ্যে তেমন কোনো পাবলিক অথরিটি নেই। এ জন্য আমাদের বাকস্বাধীনতার জন্য যে সীমা, সেগুলো প্রয়োগ করতে হয়। বাকস্বাধীনতার কোনো সীমা নেই। বাকস্বাধীনতার সীমা দুটি—আপনার বাকস্বাধীনতা যেন অন্যের বাকস্বাধীনতাকে নিহত না করে অথবা সমাজের বাকস্বাধীনতাকে নিহত না করে। এ ছাড়া আপনার কোনো আর বাধা নেই। এখন যেহেতু সমাজের মধ্যে বিভিন্ন সম্প্রদায় আছে। দ্বন্দ্ব হতে পারে। সেটার মীমাংসার পথ হচ্ছে পাবলিক এড জুরিসডিকশন।
বিরোধ হলেই যে হত্যা করা হচ্ছে, এটা কিন্তু আসলে তাদের মতের জন্য নয়। কথাটা পরিষ্কার করতে চাই—যদি কারোর মতের সাথে আপনার দ্বিমত থাকে, তাহলে তার বিরুদ্ধে মামলা করা যায়, আন্দোলন হতে পারে, ক্ষোভ প্রকাশ করতে পারেন, কিন্তু তা না করে তাকে হত্যা করার পথ হলো সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক বিভ্রান্তের পথ, এটা সন্ত্রাসবাদী পথ।
এর বিরুদ্ধে আমরা যারা প্রতিবাদ করছি, যেমন সেলিম ভাই বললেন জনসাধারণ বিক্ষুব্ধ, কিন্তু সেই বিক্ষোভের প্রকাশ কোথায়? বিক্ষোভের প্রকাশ যদি সরকার করতে না দেয়, তাহলে সাধারণ জনতার পক্ষ থেকে বিক্ষোভটা কীভাবে প্রকাশ পাবে? এখানে পরিষ্কার বলা উচিত, হত্যা যারা করেছে, তাদের কাছ থেকে যে বার্তা আসছে হত্যাকারীদের নামে অথবা তারা যে স্লোগান দিয়ে যাচ্ছে, এটা পত্রিকায় রিপোর্টও প্রকাশিত হচ্ছে। এতে বোঝা যাচ্ছে যে তারা ইসলাম ধর্মের নামে এই কাজটা করছে। কিন্তু এই কাজটি যে ইসলাম ধর্মেরই বিরোধিতা, ইসলাম ধর্মের তো নয়ই বরং ইসলামের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা সেই কথাটি মুসলমানদেরকেই বলতে হবে। শুধু রাষ্ট্র হিসেবে বা নাগরিক হিসেবে আমরা বলব, তা যথেষ্ট নয়।
একজন মানুষ নাগরিক হতে পারে এবং তাঁরা অন্য ধর্মের অনুসারী হতে পারেন অথবা তিনি ইসলাম ধর্মের অনুসারী হতে পারেন। ব্লগারের নামে যেকোনো নাগরিককে হত্যা করা অপরাধ—ব্লগার খারাপ কিছু লিখলেও অপরাধ এবং না লিখলে তো বেশি অপরাধ। এ জন্য এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ধরনের প্রতি বর্তমান রাষ্ট্রের একটি ত্রুটির কথা বলছি। রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে কতগুলো ব্লক আছে, অর্থাৎ প্রতিরোধযন্ত্রের মধ্যে বালি আছে। রাষ্ট্র যদি এটি দমন করতে চাইতো, তাহলে পারত। কিন্তু রাষ্ট্র কোথায় যেন চাইছে না। এটিই হচ্ছে আশঙ্কার বিষয়। আর যদি সে চেয়েও না পেরে থাকে, তাহলে এটা তাদের অপারগতা, এটার জন্য ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।
আমাদের কাছ থেকে যে সহায়তা রাষ্ট্র চাইতে পারত, জনসাধারণের কাছ থেকে, সেটা হলো দুই প্রকার—সাধারণ জনতা হিসেবে রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে সমস্ত সংগঠন এর বিরুদ্ধে জনমত গঠন করতে পারত। উদাহরণস্বরূপ বলছি—আমাদের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ভূমিকা কী এ ক্ষেত্রে? তাদের বক্তব্য কী? তারা কেন রহস্যময়ীদের মতো চুপচাপ? আর এ কথা তো বলতেই হবে, বাংলাদেশ শুধু সার্বভৌম দেশ নয়, এটি বিশ্বের সব মুসলিমপ্রধান দেশের সদস্য। তার এখানে মুসলিম দেশগুলোর জনমত গঠন করার ক্ষেত্রে, দেশের মধ্যে যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান আছে তাদের বিভিন্ন সংগঠন আছে। যেমন ইমামদের সমিতি আছে, মাদ্রাসা কমিটির সমিতি আছে, সাধারণ মুসলমানদের সমিতি আছে। তাদের মধ্যেও এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং ধিক্কার আসতে হবে। এটা না হলে এই সমস্যা প্রতিরোধ করা যাবে না।
উপস্থাপক : আমরা দেখেছি, এর আগের ঘটনাগুলোর সময় আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থা আমেরিকার এফবিআইয়ের লোকেরা এসেছে, তদন্ত করেছে। কিন্তু তার ফলাফল কী, আমরা জানি না। এবারও তারা এসেছে। মুজাহিদুল ইসলাম আপনার কাছে জানতে চাই, আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট সম্বন্ধে একটু ব্যাখ্যা করেন।
মুজাহিদুল ইসলাম : এ প্রসঙ্গটা আরো বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলতে চাচ্ছি। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দেখা যাবে যে, একটি শত্রু ইমেজসম্পন্ন কোনো একটা শক্তি না থাকলে আধুনিক সাম্রাজ্যবাদ বা পুঁজিবাদ টিকে থাকতে পারে না। তাদের সামনে একসময় ছিল সমাজতন্ত্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত হওয়ার পর ঐতিহাসিকভাবে আমরা দেখতে পাই যে, ওয়ারসা চুক্তি কিন্তু বাতিল হয়ে গেল, কিন্তু ন্যাটো তার অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখল। বরং শক্তিশালী করার দিক থেকেই অগ্রসর হতে লাগল। এবং আপনি যদি সংখ্যাতত্ত্ব নেন, তাহলে দেখা যাবে যে বিশ্বব্যাপী তথাকথিত এই ঠান্ডা যুদ্ধের সময় যত যুদ্ধবিগ্রহ হয়েছে, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এই যুদ্ধবিগ্রহ এবং মানুষের মরণ তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিস্থিতি কিন্তু প্রয়োজন হয় আপনি মিলিটারি অস্ত্রপাতির ব্যবসাপাতি বাড়ানোর জন্য। সেটা না বাড়াতে পারলে বর্তমানের শক্তিশালী দেশগুলো তাদের অর্থনীতিকে তারা কোনোভাবেই টিকিয়ে রাখতে পারবে না। সেটার পরিবেশ তৈরি করতে হলে আর একটা শত্রু শক্তি ইমেজ তার তৈরি করতে হবে। এবং যেটা বর্তমানে আবর্তিত হয়েছে সেটা ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন। এই শব্দটা একসময় পশ্চিমা রাষ্ট্রনায়করা ব্যবহার করত। তারা বলত, ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ চালাতে হবে। এ ধরনের একটি আহ্বান নিয়ে তারা একটি প্রচারণা চালাতে শুরু করল। এবং এ রকম ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ৯/১১-এর মতো ঘটনা ঘটেছে। এটা নিয়ে নানা মত-দ্বিমত রয়েছে। এটার ব্যাখ্যা আমি দিতে চাই না। কিন্তু এ ঘটনাকে ব্যবহার করে সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়াটাকে একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হলো যে, ওয়ার অ্যাগেইনস্ট টেররিজম। এবং এ অবস্থাটা মেনে নিতে হলে মার্কিন নিয়মগুলো মেনে নিতে হবে এবং তাদের গোয়েন্দাদের সব জায়গায় যেতে দিতে হবে।
নানা ধরনের মতবাদ নিয়ে তারা সারা বিশ্বকে নিজেদের আয়ত্তে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। তালেবানকে তৈরি করেছিল আমেরিকা আবার তালেবানকে দমনের নাম করে সেনাবাহিনী পাঠিয়েছিল আমেরিকা। আল-কায়েদা তৈরি করেছিল তারা, তারাই আবার এটি দমনের জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। আমাদের দেশের জামায়াতে ইসলামী সংগঠনের পিছনে যে আমেরিকার হাত রয়েছে, তা সবাই জানে। এর মধ্যেও জঙ্গিবাদ ঢুকে গেছে। এই পরিস্থিতি নিয়েও তারা নতুনভাবে খেলতে শুরু করেছে। সবশেষে বলতে চাই, বিএনপি নীরবতার মধ্য দিয়ে বিষয়টিকে এক্সপোজ করেছে। কিন্তু আমি সঙ্গে সঙ্গে বেশ অবাক হই, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আওয়ামী ওলামা লীগ গতকাল (৮ আগস্ট) মানববন্ধন করেছে, ব্লগারদের মৃত্যুদণ্ডের দাবি করেছে, সব ব্লগ বন্ধ করতে বলেছে। এবং আরো অনেক রিয়েকশনারি দাবি সেখানে উত্থাপন করেছে। আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে, তাঁর (প্রধানমন্ত্রীর) ছেলের মুখ থেকে এমন সব শব্দ শোনা গেছে যে, এ রকম নাস্তিক ব্লগারদের সঙ্গে আমরা আমাদের নামকে জড়িত করতে চাই না। এখন ব্লগারদের সঙ্গে নাস্তিকতার কী সম্পর্ক, আমি তো বুঝি না। এবং নিলয়কে যে হত্যা করা হলো, তার ফেসবুক যদি ভালো করে দেখেন, সেটার অধিকাংশ ক্রিটিসিজম কিন্তু হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে। হিন্দু ধর্মের যে কতগুলো কুৎসিত এবং বৈজ্ঞানিক কতগুলো উপস্থাপনা আছে, সেগুলোকে সে এক্সপোজ করার জন্য চেষ্টা করেছে। তাহলে পরে ইসলামের শত্রু বলে আখ্যায়িত করে এটা যে করা হচ্ছে, এটার সঙ্গে কিন্তু কোনো সামঞ্জস্য নেই। এর ভিতরে আপনি যে বললেন, এফবিআই এর আগেও এসেছে অভিজিতের হত্যাকাণ্ডের সময়, বিরাট ঢাকঢোল পিটিয়ে এলো, সেটার কী রেজাল্ট, মানুষ তো তা জানে না। এখন আবার তারা এসেছে। সুতরাং সন্দেহের বীজ কিন্তু ওইদিকে অগ্রসর হচ্ছে।
উপস্থাপক : সলিমুল্লাহ খান আপনি এই মন্তব্যের সঙ্গে একমত কি না বা আপনার বিশ্লেষণ কী?
সলিমুল্লাহ খান : আমি এই মতের ওপর একমত। এখানে শুধু দুটো কথা বলা দরকার। যে নতুন জিনিস ঘটে, যেটা আমরা অনেক সময় বুঝতে পারি না। যেমন ব্লগিং এটা নতুন ফেনোমেনা। এখানে নানা ধরনের লোক লেখে। এখানে ইসলামপন্থীরা লেখেন, ইসলামবিরোধীরাও লেখেন। কিন্তু শুরুতেই যে আমরা দেখলাম তালেবান, আল-কায়েদা বা এখন আইএসের যে অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, অনেক সময় আমরা সরল বিশ্বাসে বলি মুক্তচিন্তা। কিন্তু এই কথাটাও পরীক্ষা করে দেখা দরকার। ধর্মের বিরুদ্ধে প্রচার করাটাও একমাত্র মুক্তচিন্তা নয়। আধুনিক সাম্রাজ্যবাদ বিজ্ঞানের নামে যেমন এখন বাংলাদেশে বিজ্ঞানের নামে বিটিবেগুন চালু করছে বর্তমান সরকার। এ বিষয়ে প্রশ্ন করলেই আপনাকে দেশদ্রোহী বলা হচ্ছে। আপনার সঙ্গে প্রায় দেশদ্রোহীর মতো আচরণ করা হচ্ছে। এটা কোনো মুক্তচিন্তা হলো? অর্থাৎ আমাকে এক ভদ্রলোক এক টিভিতে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা তো উন্নয়ন চান। তাহলে আবার রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের সমালোচনা করেন কেন? অর্থাৎ তাঁর ধারণা, উন্নয়ন চাইতে হলে আমাকে এটাই চাইতে হবে। অর্থাৎ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প যে দেশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, লাভজনক নাও হতে পারে, সেই কথাটি বললেও আপনাকে যদি বলা হয় আপনি দেশপ্রেম হারিয়েছেন, তাহলে তো আর আপনি কথা বলতে পারবেন না। তাহলে মুক্তচিন্তা রইল কোথায়? এখন মুক্তচিন্তা বলতে শুধু বলা হয় ধর্মের সমালোচনা করার অধিকার, তাহলে এটা তো সাম্রাজ্যবাদও প্রমোট করতে পারে।
এখন আওয়ামী ওলামা লীগের দাবি প্রসঙ্গে আসি, এটা বন্ধ করে দিলেই যে সমস্যার সমাধান হবে, সেটা তো এর আসল উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য হচ্ছে যে প্রথমেই নাগরিকদের যে কথা বলার অধিকার, সেটা ট্রিট করার অধিকার একমাত্র দেশের আদালতের আছে। তাকে হত্যা করার অধিকার কারো নেই, এটা বলার আগে অন্য কোনো কথা বলা যেতে পারে না। তার পর আমি বলছি, ব্লগার কেন, জার্নালিস্টদেরও সমালোচনা করা যেতে পারে। আমরা তো পত্রিকারও সামালোচনা করি। কারণ, কোনো কোনো পত্রিকা আছে, যারা ইচ্ছা করে মিথ্যা খবর ছাপায়। যেমন একটা পত্রিকা ছেপেছিল, ২০১৩ সালের আন্দোলনের সময়। এ জন্যই বলছি, সাংবাদিক হিসেবে যেমন আমরা দোষমুক্ত না হতে পারি, ব্লগার হিসেবেও দোষমুক্ত নাও হতে পারি। কিন্তু এই প্রচারণা যারা চালাচ্ছে, তাদের উদ্দেশ্য একটা আছে তা হলো, জনতার মধ্যে বিভক্তি আনা।
আজকে আপনাকে ব্লগার হিসেবে হত্যা করা হচ্ছে। যেন আমি কিছু না বলি। কিন্তু এভাবে একেকটা গোষ্ঠীকে হত্যা করার মাধ্যমে দেশে হত্যার সংস্কৃতি চালু করা। অথবা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি করা। এটা দেশীয় শক্তিও করতে পারে, আবার বিদেীশ শক্তিও করতে পারে। এখন আর একটা সহজ প্রশ্ন, এফবিআইকে আমরা আমন্ত্রণ করলাম, কিন্তু এটার সুরাহা এখনো করতে পারছি না কেন? আর এফবিআইকে আমন্ত্রণ করার প্রয়োজনটা কী? আমাদের কোনো ক্যাপাবিলিটি নেই? যেমন ধরুন, পদ্মা সেতু ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের সাহায্য ছাড়া হতে পারবে না, এটা আশঙ্কা করা হয়েছিল। আমরা যদি নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতুও করতে পারি, তাহলে এটা না পারার তো কারণ নেই। এবং কথায় কথায় এফবিআইকে ডেকে আনার মানে হলো লিমিটেড সভরেনটি—তার মানে কী? আপনাদের নিজেদের সভরেনটি স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, তাদের আসতে দিতে হবে। এটার আরো একটি নাম হয়েছে হিউমেনিটারিয়ান ইন্টারভেনশন। আমরা দেখছি, যেকোনো দেশের মানবাধিকার লঙ্ঘন হলে সেখানে সেনাবাহিনী ঢুকে যাচ্ছে। এটা লিমিটেড সভরেনটির একটি বহিঃপ্রকাশ। একটা গভীর রাজনৈতিক, আমি বলব না চক্রান্ত, আমরা একটা দুরবস্থার মধ্যে পড়ে গেছি। বাংলায় এটাকে বলা যায় দুর্বিপাক।
মুজাহিদুল ইসলাম : সম্ভবত আমাদের দেশের পলিটিক্যাল এজেন্ডটাকে আমাদের অন্যান্য জনগণের স্বার্থসম্পৃক্ত বিষয় থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে টোটাল কনফ্লিক্টটা ইসলাম বনাম মুক্তচিন্তা—এ রকম একটা জায়গায় নিয়ে আটকে ফেলার একটা ষড়যন্ত্র হচ্ছে।
সলিমুল্লাহ খান : আধুনিক জাতীয়তাবাদ, আধুনিক মানবাধিকার শুরু হয়েছে মাত্র ২২৫ বছর আগে, ফরাসি বিপ্লবের সময় থেকে। ফরাসি বিপ্লবের সময় দুটো বড় স্লোগান ছিল—একটি স্বাধীনতা, আরেকটি সাম্য। তৃতীয়টা ছিল ভ্রাতৃত্ব। সেটাকে আমরা জাতীয়তা বলি। সভরেনটির ভিত্তি হচ্ছে সবার ঐক্য, রাজা নয়। এই তিনটি কথা দিয়ে শুরু হয়েছিল। বর্তমানে গত দেড়শ বছরে কিছু পরিবর্তন হয়েছে কি না, সেটা লক্ষ করার বিষয়। জাতিসংঘ যখন আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের সনদ গ্রহণ করল, সেখানেও তারা বলল, এই দুটাই আমাদের লক্ষ্য। আমি সোজা করার জন্য বলছি, স্বাধীনতা এবং সাম্য—এখনো লক্ষ করবেন, বিশেষ করে বার্লিন দেয়ালের পতনের পর, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আর সাম্যের কথা বলছে না। বলেছে কী তার জায়গায়? সিকিউরিটি, খুব ইন্টারেস্টিং। সিকিউরিটি মানে কী? তারা বলছে কি ফিজিকাল সেফটি—এটা রক্ষা করার জন্য প্রয়োজন হলে ইম্পেরিয়াল আর্মি ক্যান মার্চ। অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদের সেনাবাহিনী আপনাদের দেশে ঢুকতে পারবে। সেটা রুয়ান্ডাতে তারা না ঢুকলেও বসনিয়াতে তারা ঠিকই ঢুকে পড়েছে, পরে দেরি করে, অনেক মারার পর। মানুষের সামনে বলল, দেখ বসনিয়ায় মুসলমানদের কেমন করে মারছে? তখন মানুষজনই চিৎকার করল, তোমরা কেন হস্তক্ষেপ করছ না? তখন তারা হস্তক্ষেপ করল। তখন তারা যুগোস্লাভিয়ার প্রাক্তন সার্বিয়ানদের ধরে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করল। সেখানের তারা বোম্বিং করল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানিতে যেমন করেছে, প্রয়োজনে করেছে, প্রয়োজনের অতিরিক্তও করেছে। জাপানে যেমন এটম বোমা মেরেছে।
এ জন্য আমরা বলি, বর্তমানে তাদের লিবার্টিটা ঠিক আছে। পয়সা করার লিবার্টও লিবার্টি, লোকের ওপর আক্রমণ করাটাও লিবার্টি। কিন্তু এখন ইকুয়ালটির জায়গায় তারা বলছে, মানবাধিকারকে রক্ষাকারী হিসেবে আমাদের ওখানে ঢোকার অধিকার থাকবে। এটা হচ্ছে লিমিটেড সভরেনটির থিওরি। আমি মনে করি, আমরা এই দুর্বিপাকের মধ্যে ঢুকে পড়েছি। এখন এ থেকে উদ্ধারের পথ কী? পথ একটাই, এটা সম্বন্ধে আগে তো জানতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের সাথে বলতে হয়, আমাদের যারা তথাকথিত বুদ্ধিজীবী বা শিক্ষিত সম্প্রদায়, তাদের মধ্যেও এ ব্যাপারে সচেতনতার অভাব আছে। তার একটা প্রমাণ হচ্ছে, এই যে যাদেরকে হত্যা করা হচ্ছে, তাদের নাগরিক হিসেবে না, দেখানো হচ্ছে ব্লগার হিসেবে, ব্লগারকে হত্যা করা হচ্ছে। তাহলে রাজন বা রাকিব কি ব্লগার? যাদের হত্যা করা হয়েছে ওরা মানুষ, মানুষের বাচ্চা। এখানে একটি বিষয় লক্ষ করা দরকার, বর্তমানে দেশের ধনী-দরিদ্রের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু এই রাকিব বা রাজনকে যারা হত্যা করছে, তারাও কিন্তু তাদের শ্রেণির লোক। গ্যারেজ মালিক এবং গ্যারেজের শ্রমিক কাছাকাছি। আমাদের শিশুকে কেন শ্রম করতে হয়েছে, এই প্রশ্নটা উঠছে না।
এই শিশু শ্রমিককে যে নিপীড়িত করে মারা হচ্ছে, অপরাধীদের ধরা হচ্ছে। কিন্তু এখানে ব্লগারদের যারা মারছে, তারা রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত একটি চক্র। দেশীয় হতে পারে। বিদেশিও হতে পারে। এবং আন্তর্জাতিকভাবে সম্পৃক্ততাও থাকতে পারে। কিন্তু এই রাজনৈতিক হত্যাকারীকে আমরা যেন মনে করছি, কোনো অর্ডিনালি ক্রিমিনাল কেস। এটি ক্রিমিনাল বটে। কিন্তু এটাকে রোধ করতে পুলিশকে তো তার ভূমিকা পালন করতে হবে। এবং দেশের জনগণকে তার সাথে যুক্ত হতে হবে। এ জন্য যদিও বা আমরা এটাকে বলি, একটা আন্তর্জাতিক চক্রান্তের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। দেশের পলিটিক্যাল ডিস্টেবলাইজেশন করার চেষ্টা করা হচ্ছে, আমি তো অবাক হয়ে বলি যে, আওয়ামী ওলামা লীগের হয়ে যারা এ কথাগুলো বলছে তাঁরা এর পরিণতি কী জানেন? আমি তো বলছি, তাঁরা এই পরিণতি জানেন না। এটা বলে তাঁরা যে সরকারকে সমর্থন করছেন, এসব করে তাঁরা যে সরকারকে বিপদগ্রস্ত করছেন, এটা তাঁরা বুঝতে পারছেন? শুধু এটা এই নয় যে, আমি কয়েকজন নাস্তিকের সঙ্গে জড়িত হলে আমার সরকারের পতন হবে—আমি কিছু বলব না, এটা তো ভুল তত্ত্ব। বলা উচিত, যদি আমার সরকারের পতনও হয়, তবু আমি একটা নীতিগত অবস্থান থেকে সরতে পারি না। সেটা কী? আমার দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির আমি অবনতি হতে দিতে পারি না। যেকোনো নৃশংস অপরাধে রাষ্ট্রই তার বিচার করবে। আমি একজন প্রাইভেট কিলারকে অনুমতি দিতে পারি না। আমি মনে করি, আমাদের রাজনীতি সেদিক থেকে ভুল পথে চলেছে। কি সরকার, কি বিরোধী দল। বিরোধী দল যেমন নিশ্চুপ, সরকার কিন্তু বিপরীতভাবে নিশ্চুপ। এটাই হচ্ছে সবচেয়ে ভয়াবহ এবং আশঙ্কার জিনিস।
উপস্থাপক : নাগরিকরাও কেমন যেন নীরবতা পালন করছে। এর কারণটা কী?
মুজাহিদুল ইসলাম : বুদ্ধিজীবীদের একটা অংশ এখন একটা বিভ্রান্তজনক অবস্থার মধ্যে বিরাজ করছে বলে আমার মনে হচ্ছে, সেটাই আশঙ্কা হচ্ছে। এই কথাটা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে তাদের ভিতরে, আমার সঙ্গে যখন ইন্টারেকশন হয়, তখন দেখি যে—যেটা স্লোগানে বলা হয়, আগে উন্নয়ন তার পরে গণতন্ত্র। সুতরাং আমরা মাহাথিরের পথ অনুসরণ করে চলব। এই কথাটা বলার মধ্যে এটি প্রকাশিত হয়, এই ধরনের বীভৎস হত্যাকাণ্ড এবং সেনসেটিভ ইস্যুগুলো সামনে আনা যাবে না। আমাদের একেবারে স্ট্রিমলাইন রেজিমেন্টেড জনগণকে দিয়ে পুলিশি রাষ্ট্রের মাধ্যমে জোর করে উন্নয়নের ছবক আমাদের মানুষের ভিতরে গিলিয়ে খাওয়াতে হবে। এই ধরনের একটা প্রবণতা এবং অনেকেই এটি বিশ্বাস করে। কিন্তু এটা তারা বুঝতে অক্ষম যে উন্নয়ন কোনো দিন কেবল আপনি বৈষয়িক দিকটা বিবেচনা করলে এটা কোনো দিন সম্পূর্ণ হতে পারে না। এবং গণতন্ত্রহীন উন্নয়ন যাঁরা বলেন, তাতে না হবে গণতন্ত্র, না হবে উন্নয়ন। এবং তার নমুনা আমরা আমাদের দেশের ভিতরেও কিন্তু দেখতে পাচ্ছি। আর যদি এত কথাই বলে, তাহলে আমাদের রাষ্ট্রীয় চার নীতি থেকে আমাদের গণতন্ত্রটাকে বাদ দিচ্ছে না কেন? সরাসরি বলে দিলেই পারে, কিছুদিন পর্যন্ত মানুষকে অধিকারহীন রেখে আমরা পুলিশি রাষ্ট্রের মাধ্যমে আমরা এটা করব। কিন্তু সেটা কত বড় আত্মঘাতী, তারা নিজেরাও জানে না।
তারা যদি ভেবে থাকে, এভাবে তারা তাদের রেজিমের কন্টিউনিটি এনশিওর করতে পারবে—এটা ইম্পসিবল। কেননা, একটা গণতান্ত্রিক দলের জন্য তাদের জনগণের জায়গা থেকে, শিকড় থেকে রসটা না নেওয়া হয়, তাহলে অবধারিতভাবে সে জিম্মি হয়ে যাবে ইন্সট্রুমেন্ট সাবস্টেটের ওপরে। এখন এই কথাটা একটু ভেবে দেখার জন্য বলব যে, ইন্সট্রুমেন্ট সাবস্টেট দে আর রানিং পলিটিক্স। কিন্তু পলিটিশিয়ানরা কিন্তু ইন্সট্রুমেন্ট সাবস্টেট পরিচালনা করছেন না।
সলিমুল্লাহ খান : আমরা বলি, মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হচ্ছি। কিন্তু মধ্যম আয়ের কোন দেশের মতো পরিচালিত হচ্ছি? এ প্রশ্নটাও আসে। মধ্যম আয়ের মানুষের দেশ হচ্ছি না, মধ্যম আয়ের ভিখিরির দেশ হচ্ছি, না মধ্যম আয়ের ক্রিমিনালের দেশ হচ্ছি? এই কথাটা তো জিজ্ঞাসা করার দরকার। দেশে যে ক্রাইম বাড়ছে, যদি আমরা মনে করি, এটা একটা দুর্ঘটনা মাত্র, মুষ্টিমেয় বিপথগামী লোক করছে, তাহলে এটা সহজ হবে না। হত্যাকাণ্ডগুলো দুভাবে হতে পারে, হয়তো মুষ্টিমেয় বিপথগামী লোক করছে, আরেকটা হতে পারে, আমরা যে উন্নয়ন নীতি অনুসরণ করছি—যে রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতি অনুসরণ করছি এটা তারও একটা ফল হতে পারে। আমি মনে করি, এখানে সমাধান একটাই, যাদের দেশে এখনো একটা শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা বিরাজ করছে। জিনিসটা এ জন্য বলি যে, ১৯৭৫ সালে যখন বাকশাল করা হয়েছিল। তখন পত্রিকাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তখন আমরা জানি যে লিমিটেড পত্রিকা ছিল। এখন কিন্তু আমাদের দেশে অনেকগুলো পত্রিকা আছে, অনেকগুলো মিডিয়া আছে কিন্তু ঘুরেফিরে সবাই একই কথা বলছে এবং কতগুলো কথা কেউ বলছে না।
এখানে একটা সংস্কৃতি বেড়ে উঠেছে যেটাকে আমরা কিছু বলতে না পারি, ভয়ের সংস্কৃতি বলতে পারি। ভয়টা আসে কোথা থেকে? দুই জায়গা থেকে। মানুষ যখন আদর্শহীন হয়। আমাদের রাজনীতিতে আদর্শের রাজনীতি বলতে কিছু নেই। যারা আদর্শের রাজনীতি করতে, তারা ব্যর্থ বলে সমাজে নিন্দিত হচ্ছেন। অরেকটা হলো ভয়। বলে না লোভ থেকে মানুষ ভয় পায়। হয় আপনার কোনো লোভ আছে, এ জন্য আপনি ভয় পান অথবা আপনি অজ্ঞ। অজ্ঞতাও এক ধরনের ভয়। আমাদের বর্তমানে যে নীরবতা বিরাজ করছে, সেটা দুই ধরনের লোকের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি। বুদ্ধিজীবীরা এখন স্ব-স্ব জন্মদিন পালন করছেন। একজন বলছেন আমার ৭০ বছর, একজন বলেন আমার ৬৫ বছর। আমি সেদিন এক বুদ্ধিজীবীকে দেখে বললাম, আপনি তো সেদিন একটা পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি বলেন, না ওটা একটা আনন্দ অনুষ্ঠান। কথাটা খেয়াল করন। সবাই মনে করছেন, আমার জীবনে যা পাওয়ার, তা পাওয়া হয়ে গেছে। ভবিষ্যতে কী হবে, সেটা আমি জানি না। এটাকে আমি মনে করি, বাংলায় একটা কঠিন শব্দ আছে—অপরিণামদর্শিতা। আরো একটি কঠিন শব্দ আছে—অবিমৃষ্যকারিতা। ভবিষ্যতে কী হবে, সেটা আমি জানছি না। কিন্তু আমরা তো বর্তমান জেনারশনের লাভের জন্য ভবিষ্যৎ জেনারেশনকে বন্ধক রাখতে পারি না। কিন্তু সেটিই আমরা করছি। এখন আমি দেখছি, আওয়ামী লীগ সরকার অনেক উন্নয়নের কাজ করছে। কিন্তু এ কথা আমাদের বলতে হবে দুঃখের সাথে যে, তাদের ভবিষ্যৎ দৃষ্টি অন্ধকার। কেন অন্ধকার বলি—যেমন ধরেন বিদ্যুৎ প্রকল্প যেগুলো করা হচ্ছে, এগুলোর পরিবেশ-সংক্রান্ত কী প্রভাব পড়বে এ বিষয়ে তারা দেশের সাধারণ মানুষের অপিনিয়ন সেটা কিন্তু শুনছেন না। এটা সিমটম আকারে বললাম। আরো বহু সিমটম আছে, যা তারা শুনতে চাচ্ছে না। এবং অহংকার পতনের মূল। অতি দর্পে হতো লঙ্কা। আমরা এখন স্বাধীনতার মধ্য দিয়েই এক ধরনের পরাধীনতার মধ্যে বন্দি আছি।
উপস্থাপক : আপনাদের দুজনকেই ধন্যবাদ এই অনুষ্ঠানে আসার জন্য।