প্রতিক্রিয়া
চলুন বরং কথা বলি কিরণমালা নিয়ে
অনেক প্রশ্ন আসছে মনে, মাথার মধ্যে ঘুর ঘুর করছে। অনেকটা আলপিন দিয়ে খোঁচা দিলে যেমন লাগে, তেমন অবস্থা। তবে এসব প্রশ্ন বা কথা বলতে মানা। না, মা মানা করেনি। দেশ, সমাজ ও সমাজের মানুষের মানা। কাগজেকলমে আমি বাকস্বাধীন, তারপরও বলতে মানা। আর যদি ভুলেও এসব কথা বলেই ফেলি তবে রক্ষে নেই। হয়তো প্রাণটাই হারাতে হবে। তবে অন্য অনেক বিষয়ে নিয়ে হয়তো টুকটাক কথা বলা গেলেও যেতে পারে, কিন্তু ধর্ম নিয়ে তো কথা আমি বলবই না।
ধর্ম নিয়ে তো প্রশ্ন তোলাই যাবে না, যদি তুলেও ফেলি তাহলে হয়ে যাব নাস্তিক। আর যদি ধর্মের প্রতি আস্থা বেশি রেখে ফেলি তাহলে হয়ে যাব মৌলবাদী, জঙ্গি। এপাশে ফিরলে মৃত্যু; ওপাশে ফিরলে আইন, সন্ত্রাসবিরোধী কামান।
পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে ডাঙায় বাঘ আর জলে কুমিরের মতো। (জল বললেও সমস্যা আছে। কারণ শব্দভেদে এখানে ধর্মের বিচার করা হয় বা ধর্ম বিবেচনা করা হয়)।
আবার যদি আমি সমাজ নিয়ে কথা বলি, তাহলে গায়ে লাগবে সুশীল তকমা। যারা নামেই শুধু সুশীল, কিন্তু কাজে কতটা তা নিয়ে সংশয় রয়েই গেছে। সমাজে আসলে এ শ্রেণির মানুষের কতটা প্রয়োজন আছে, তা নিয়েও আমার আছে হাজারো প্রশ্ন। তাই সমাজ নিয়ে বলা যাবে না।
বিজ্ঞান নিয়ে কথা বললে হয়ে যাব যুক্তি কিংবা বিজ্ঞানবাদী। প্রায়শই তাদের নাস্তিকও বলা হয়। যুক্তি দিয়ে বিচার করতে গেলে যদি কোনো অসঙ্গতিকে খারিজ করে ফেলি? তাই ওপথও মাড়াব না।
আবার যদি নারীসমাজ নিয়ে কথা বলি, তাহলে হব নারীবাদী। আর সাহিত্য, সংস্কৃতি বা এ সম্বন্ধীয় বিষয়ে কথা বলতে চাই, তাহলে তো কথাই নাই। লোকে বলতে শুরু করবে আঁতেল। আঁতলামি করছে। সুবিধাবঞ্চিতদের নিয়ে কিছু বললে বলা হবে মানবাধিকারকর্মী বা এনজিওকর্মী।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বেশি আবেগ দেখালে লোকে বলবে, আমি সরকারি দল করি। কিংবা চেতনাবাজ। আর যদি একটু নড়াচড়া দেই, তবে বলবে আমি বিরোধী দল। আমি রাজাকার কিংবা এর থেকে আরো বেশি। আমার সাজা হওয়া উচিত। আমার বিচারের দাবিতে আবার কোনো মঞ্চ বা সংগঠন আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে। যদিও আমি তেমন উঁচু জাতের কেউ নই।
এসব ‘স্পর্শকাতর’ বিষয়ে কথা বলে কী হবে? তার চেয়ে বরং আমি একটা কাজ করতে পারি। আমি কথা বলব কিরণমালা, পাখি কিংবা বাহাকে নিয়ে। আগের পর্বটা আমি মিস করেছিলাম, সেটাতে কী হয়েছিল, সেটাই জানতে চাইতে পারি। ওরা কী কী পোশাক পরেছিল তেমন একটা জামা বা শাড়ি আমি হাজার হাজার টাকা দিয়ে কিনতে পারি।
কিংবা অপু বিশ্বাসের ডায়েট চার্টে কী কী খাবার ছিল তা জেনে ডায়েট শুরু করতে পারি। অথবা বাজারে হাল ফ্যাশনে কী কী নতুন পোশাক এসেছে। কোন দোকানে কী কী জামা, জুতা, স্যান্ডেল বা শাড়ি এসেছে। অথবা কোন দোকানে খেতে যাওয়া যায়, এসব সম্পর্কে জানা থাকাই যথেষ্ট।
এসব কথা বললে তো আর কেউ আমাকে খুন করতে আসবে না। হত্যার হুমকিও দেবে না।
আমি বরং কোনো সস্তা বিষয়ে কলম ধরি। কলামও লিখতে পারি। তাতে মুহূর্তের মধ্যে হাজার হাজার লাইক কমেন্ট পড়বে। বাহবা পাব। কিংবা লেখার জন্য সমালোচিত হয়ে নিজেকে বড় কিছু মনে করতে পারব।
আরেকটা কাজও করা যেতে পারে। কী করলে আমার ত্বক আরো ‘ফর্সা’ হবে, নিজেকে ‘সুন্দর/অপরূপা/লাবণ্যময়’ করে তোলা যাবে তার খবরাখবর নেওয়া। কোন ক্রিম বা কোন বিউটি পার্লারে গেলে নিজেকে আরো সুন্দর করে তোলা যাবে, সে খোঁজখবর নেওয়া যেতে পারে। এখানে অবশ্য একটা কথা মনে রাখতে হবে যে নিজেকে সুন্দর করে উপস্থাপন করতে গিয়ে আবার ‘বেআব্রু’ করা যাবে না। তাহলে পুরুষ জাতের মাথা ঘুরে গেলে সমস্যা। পর্দার মধ্যে থেকেই সব করতে হবে। কারণ যদি কোনো নির্যাতনের ঘটনা ঘটে যায় তাহলে তো তার জন্য আমিই দায়ী হব। নির্যাতন না বলে অপ্রীতিকর ঘটনা বলা ভালো, কারণ তাতে আর পুরুষদের সম্মানে লাগবে না। কারণ মেয়েরা ছোট ছোট জামা পরলে কিংবা গায়ে ওড়না না রাখলে তাদের মন বিগড়ে যায়। কিন্তু তারা যখন হাফপ্যান্ট কিংবা তার থেকেও ছোট প্যান্ট পরে ঢ্যাং ঢ্যাং করে রাস্তা দিয়ে ঘোরে, তখন তা শোভনই দেখায়। কারণ পুরুষ মানুষ বলে কথা। যাক এটা নিয়েও কথা বলা যাবে না। তাহলে আবার নারীবাদী বলা হবে আমাকে।
আবার আরেকটা কাজও করা যেতে পারে। কথা না বলে বা প্রশ্ন না করে বিটিভি হয়ে যাওয়াই ভালো। দেশে শুধু উন্নয়নের জোয়ারই দেখব আমি। কোথাও কোনো অনিয়ম নেই, খুনখারাবি নেই, নেই কোনো বঞ্চনা। আছে শুধুই উন্নয়ন। এমন হলে ভালোই হতো।
আমি কোনো রাজীব, অভিজিৎ বা নিলয়ের খুন হওয়ার খবর শুনিনি বা দেখিনি। দেখিনি রাজন, রাকিব আর নাম না জানা আরো অনেক শিশু হত্যার খবর। শুনিনি কোনো শিশু ও নারী ধর্ষণের ঘটনা। দেখিনি জন্ম নেওয়ার আগেই মায়ের পেটে শিশু গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা। কারণ আমি তো বধির। আমি কোনো খবরের কাগজও পড়িনি। কারণ আমি তো চোখেই দেখি না। কখনো কখনো দেখতে পেলেও পড়তে পারি না। আমার অক্ষরজ্ঞান নেই। এককথায় নিজেকে প্রতিবন্ধী বলাও চলে।
সব দেখেও আমি নিশ্চুপ। সব শুনেও আমি কিছুই শুনিনি। আমি কিছুই জানি না, জানতেও চাই না। জানলে যদি আবার আমার ভেতরের মনুষ্যত্ব, বিবেক জেগে ওঠে। আর ওসব কোনো বাস্তবসম্মত বিষয় নয়। ওগুলো মহাজাগতিক বিষয়। যদি মনুষ্যত্ব বা বিবেক জেগে ওঠে তবেই বিপত্তি। মন বিদ্রোহ করে বসবে। নানা কথা জানতে চাইবে; নানা প্রশ্ন করতে চাইবে।
কেন শুধু লেখার দায়ে মানুষকে প্রাণ দিতে হবে? কেন ধর্মের নামে চলবে মানুষ হত্যা? কেন আমাদের বিশ্বাস এত নড়বড়ে হবে যে, কেউ কিছু বললে তা মুহূর্তের মধ্যেই ভেঙে যাবে? কেন কোনো খুনি ধরা পড়বে না? কেন কোনো হত্যার বিচার হবে না? কেন মানুষ হিসেবে আমি আমার স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা পাব না? কেন রাজীব, রাজনদের এভাবে মরতে হবে? কী দোষ ছিল ওদের?
এসব প্রশ্ন আমি করব না। উত্তর দেওয়ারও কেউ নেই। অথবা যারা দিতে চায় তারাও আমারই মতো ভয়ে আছে।
নিজেকে এখন মানুষ ভাবতেই ভয় হয়। ভাবতে চাইও না। কীভাবে ভাবব, মানুষ হওয়ার প্রধান ও অন্যতম উপাদান বিবেকই তো নেই আমার মাঝে। আমি শুধু তিনবেলা পেট পুরে খেয়ে বেঁচে আছি। হাত-পা ঠিক আছে, হেঁটেচলে কাজ করে বেড়াই। আশপাশের কোনো কিছু দেখি না, শুনি না। ওগুলো আমাকে কখনো ছুঁয়েও যায় না। ছোঁয়ার প্রশ্নই আসে না। আমি তো এভাবেই ঠিক আছি। ওগুলো ভাবার জন্য তো অন্যরা আছে। তবে কেন আমি আমার মহামূল্যবান মাথা ঘামাতে যাব?
আমি নিজেকে মানুষ ভাবব না, পাছে যদি তাদের মতো হয়ে যাই যারা মতপ্রকাশের অপরাধে নির্মমভাবে ওই মানুষগুলোকে হত্যা করেছে! আমি যদি অভিনব কোনো উপায়ে শিশুদের হত্যা করি! হত্যার উৎসবে মেতে উঠি! না আমি মানুষ হতে চাই না। এই পরিচয়ই দিতে চাই না।
লেখক : সাংবাদিক