রাকিব হত্যা
অপরাধের মনস্তত্ত্ব
গত ৫ আগস্ট। আমার মনটা খুব খারাপ। পত্রিকায় ১৩ বছর বয়সী শিশু রাকিবের হত্যার এক ভয়াবহ বিবরণ এসেছে। আমি খুব ছোট বয়স থেকেই পত্রিকা পড়ি। গত ৩৫ বছরের মধ্যে হত্যাকাণ্ডের এ ধরনের পদ্ধতির প্রয়োগ কখনো চোখে পড়েনি। মলদ্বার দিয়ে বাতাস পাম্প করে শিশুটিকে হত্যা করা হয়েছে। মানুষ হিসেবে নিজেকে খুব ছোট লাগছে। পশু-পাখিও সম্ভবত বিনা প্রয়োজনে হত্যা করে না, শিশু হত্যার তো প্রশ্নই আসে না। অনেক প্রজাতি আছে, যারা সামাজিকভাবে সব বাচ্চাকে লালন-পালন করে। মানুষ খুব বড় ধরনের ব্যতিক্রম। ৫ আগস্টই ঢাকা মেডিকেলের সামনে আরেকটি আট-নয় বছর বয়সী শিশুর ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া গেছে। জুলাই মাসে রাজন নামের আরেকটি ১৩ বছরের শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করে সোশ্যাল মিডিয়ায় তার ভিডিও ছেড়েছে হত্যাকারী চক্র। আমার মনে নানা প্রশ্ন জাগে। এই অপরাধীদের মানসিক গঠন কেমন? এরা কি আগেও নির্যাতন করেনি? এরা কি বাড়িতে বউ-বাচ্চা পেটাত? এরা কি মাদক নিত? থানায় এদের নামে কি কোনো অপরাধের অভিযোগ আছে? এরা কি রাজনীতির নামে সহিংসতা করেছে কখনো? এরা কি... আরো কত প্রশ্ন খেলে মনে। হঠাৎ করেই কি এমন ধরনের নৃশংসতা করা সম্ভব?
এ ধরনের ঘটনাগুলোর যথাযথ বিচার করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সে জন্য রয়েছে প্রশাসন ও বিচার বিভাগ। আমি পত্রিকার পাঠক মাত্র। আমি একজন মনোবিজ্ঞানী। তবে আমার মনে তাৎক্ষণিক যে প্রতিক্রিয়া এসেছে, তাকে ঠিক মনোবৈজ্ঞানিক প্রতিক্রিয়া বলা চলে না।
মনোবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি বিচার করে দেখার চেষ্টা করি বরং। এই লেখায় কেন রাজন হত্যাকাণ্ড হলো বা কেনই বা রাকিবকে মরতে হলো, তার মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিচ্ছি না। মোটের ওপর কেন দেশে দেশে অপরাধ ও সহিংসতা ঘটে ও আমরা কী করতে পারি, সে বিষয়ে বলছি।
কেন সহিংসতা হয়, কেন অপরাধ ঘটে?
অপরাধ ও সহিংসতার কারণ বহুমাত্রিক। আচরণবাদী মনোবিজ্ঞানীদের মতে, অনেক অপরাধমূলক আচরণ সৃষ্টি হয় মূলত শিক্ষণের মাধ্যমে। ছোট বয়সে বাবা-মা ও অভিভাবকদের কাছে শুনে এবং তাদের দেখে আমরা সামাজিকতা শিখি। অর্থাৎ কোনটি করা চলবে, কোনটি করা চলবে না, কোনটি ভালো আর কোনটি মন্দ—সে বিষয়ে আমাদের ধারণা তৈরি হয়। সমাজ আমাদের কিছু আচরণকে উৎসাহিত আর কিছু আচরণকে নিরুৎসাহিত করে। এই প্রক্রিয়াটিকে বলে সমাজিকীকরণ বা সোশ্যালাইজেশন। কিন্তু এমন সমাজও আছে, যেখানে অপরাধকে সাহস বলে, অত্যাচারকে পৌরুষ বলে প্রশংসিত করা হয়। এই সমাজের শিশু সোশ্যালাইজেশনের মাধ্যমে সমাজবিরোধী আচরণ, সহিংস আচরণ, অপরাধী আচরণ শেখে। বাবা হয়তো রিকশাওয়ালাদের নিয়মিতই মেরে থাকেন। বাসায় মাকেও মারেন। ছেলে বাবাকে শক্তিশালী মনে করে। সেও বাপকা ব্যাটা হতে চাইবে। সেও মারপিট শিখে নেবে। এ জন্যই অপরাধী বাবা-মায়ের সন্তানদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বেশি দেখা যায়। আবার কোনো এলাকায় সমাজের মধ্যে অপরাধের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব থাকলে সেখানকার সোশ্যালাইজেশন তেমনই হবে। ফলে শিশুরা অপরাধপ্রবণ হয়ে গড়ে উঠবে। কোনো একটি অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর যদি অপরাধী পুরস্কৃত হয়, যদি সুবিধা পায়, তবে তার আরো অপরাধ করার আশঙ্কা বাড়বে। এভাবে বারবার পুরস্কৃত হওয়ায় ব্যক্তির মধ্যে অপরাধমূলক আচরণ করার প্রবণতা দেখা দেয়। একবার যদি ছিনতাই করে রেহাই পায়, কেউ তাহলে পরেরবার রুজির এই পথটিই সে বেছে নেবে। ধর্ষক আরো ধর্ষণ করবে, খুনি করবে খুন। পুরস্কার (সুবিধা, বিচার হয়নি) পাওয়ার ফলে অপরাধ বাড়বে। কেউ হয়তো অপরাধ করে সুবিধা পেল, বড় নেতা হলো, সম্পদ পেল, প্রভাব-প্রতিপত্তি পেল। সমাজের অন্যরা তা দেখবে। সমাজের কেউ কেউ এমনটা করে নিজেও সুবিধা নিতে চাইবে। অর্থাৎ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আমরা অপরাধী আচরণ শিখতে পারি। মনোবিজ্ঞানী বান্ডুরা একে ‘ভিক্যারিয়াস লার্নিং’ বলে অভিহিত করেছেন।
অ্যালকোহল ও মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে উচ্চমাত্রায় অপরাধ প্রবণতা দেখা যায়। তাদের মধ্যে উচিত-অনুচিতের ধারণা কমে যায়, মাদকের প্রভাবে থাকলে বা বেড়া (উইথড্রয়ালে) থাকলে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ বা ইনহিবিশন কমে যায়। মনের গহিনের পশু তাদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। বিবেক হয়ে যায় অকার্যকর।
অপরাধমূলক আচরণের আরেকটি মনস্তাত্ত্বিক কারণ হলো পরিবেশগত চাপ। ব্যক্তি যদি এমন কোনো অবস্থার মধ্যে পড়ে যে বাধ্য হয়েই তাকে আইন অমান্য করতে হয় বা অপরাধ করতে হয়, এমন ক্ষেত্রে ব্যক্তি তার আত্মরক্ষামূলক আচরণের অংশ হিসেবে অপরাধ সংঘটিত করে। এ কারণে কোনো কোনো আবাসিক এলাকায় অপরাধ প্রবণতা বেশি দেখা যায়। দারিদ্র্য ও বঞ্চনাও অপরাধের একটি কারণ হিসেবে কাজ করে। দারিদ্র্য মহান না করে খারাপ করে তোলে।
প্রজাতিগতভাবে মানুষের মধ্যে সহিংসতার প্রবণতা আছে। টিকে থাকার জন্য, সম্পদ ও খাদ্যের জন্য, প্রভাব বিস্তারের জন্য, যৌন সঙ্গীর/সঙ্গিনীর ওপর কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য, নিজের ঔরসজাত সন্তানের টিকে থাকাটা নিশ্চিত করার জন্য অন্যান্য প্রাণীর মতো মানুষও সহিংসতা করে। অতীতে ধ্বংসপ্রবণতার ইতিহাস থাকলে, রাগী মানুষ ও সহিংসতার শিকার মানুষের মধ্যে, ক্রমাগত সহিংসতা দেখেছে এমন মানুষের মধ্যে, যাদের আত্মীয়-বন্ধুরা সহিংসতা সমর্থন করে তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বেশি দেখা যায়। সহিংসতা সহায়ক চিন্তা যাদের মধ্যে আছে, তাদের মধ্যে সহিংসতা বেশি দেখা যায়। যারা বিশ্বাস করে যে ‘সহিংসতা সুবিধা পাওয়ার ভালো উপায়’ বা ‘আগ্রাসী আচরণ পৌরুষত্বের লক্ষণ’, ‘আক্রমণই সর্বোচ্চ প্রতিরক্ষা’, ‘মহিলাদের না মারলে তারা নিয়ন্ত্রণে থাকে না’—তাদের মধ্যে সহিংসতা ঘটার আশঙ্কা বেশি থাকে।
বৈবাহিক দ্বন্দ্ব, পারস্পরিক সম্পর্কের তিক্ততা, সামাজিক দক্ষতার অভাব এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতার অভাব থাকলে, সহিংসতার শিকার হলে বা সহিংসতা দেখলে ব্যক্তির মধ্যে সহিংসতার প্রবণতা তৈরি হতে পারে। প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য মানুষ সহিংসতার আশ্রয় নিতে পারে। সমমর্যাদার মানুষের মধ্যে ঈর্ষার কারণে এবং নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যও সহিংসতা ঘটতে পারে।
রাজনৈতিক মতপার্থক্য ও সামাজিক সংগঠনের অভাব (যেমন—মাতবর বা সালিশদার বা মুরব্বিদের শাসন নেই), দারিদ্র্য বিমোচনের উদ্যোগের অভাব থাকলে, সুশাসনের অভাব থাকলে, অফলপ্রসূ বিচারব্যবস্থা ও অফলপ্রসূ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থাকলে, মাদক ব্যবসায়ী চক্র শক্তিশালী হলে, জাতিগত, ধর্মীয় ও বর্ণবাদী নিপীড়ন থাকলে, অস্ত্র সহজলভ্য হলে, রাষ্ট্র নিজেই হত্যা ও নির্যাতনের পথ বেছে নিলে সমাজে সন্ত্রাসের প্রসার ঘটতে পারে।
মানুষের অপরাধমূলক আচরণের পেছনে আরো একটি বিষয় কাজ করে। তা হলো ব্যক্তির মানসিক অসুস্থতার বিষয়টি। অনেকে সহজেই অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়তে পারে। Diagnostic and Statistical Manual of Mental Disorders (DSM-IV) অনুযায়ী জ্ঞানগত গোলযোগ (Delirium Ges Dementia) স্কিজোফ্রেনিয়া (Schezophrenia), ব্যক্তিত্বের রোগ (Antisocial personality, Paranoid personality) এবং মেজাজের গোলযোগ ইত্যাদি মানসিক অসুস্থতায় আক্রান্ত ব্যক্তি নানা রকম অসামাজিক ও অপরাধমূলক আচরণ করতে পারেন।
প্রতিরোধে করণীয়
সহিংসতা একটি মাত্র কারণে হয় না। এর সমাধানও বহুমাত্রিক। এ জন্য সরকারি-বেসরকারি ও আন্তর্জাতিকভাবে সমন্নিত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি, নারীর ক্ষমতায়ন, লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণের উদ্যোগ, সব ধরনের জাতিগত বৈষম্য, ধর্মীয় বৈষম্য ও বর্ণবৈষম্যের অবসান, শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, কার্যকর বিচারব্যবস্থা ও দক্ষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গড়ে তোলা, জেলে অপরাধী মনোভাব সংশোধনের জন্য পেশাদারি কর্মসূচি, সাজাভোগ শেষে অপরাধীদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া, সহিংস মানুষকে শনাক্ত করা ও চিকিৎসা দেওয়া, তাদের হাত থেকে অন্যদের নিরাপদ করা, আইন ও বিচারব্যবস্থার সঙ্গে কমিউনিটি বা সমাজের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা, অস্ত্র দুর্লভ করা ও নিয়ন্ত্রণ করা এবং শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে সহিংসতা প্রতিরোধ করা যায়। স্কুল থেকে বাচ্চাদের ঝরে পড়া ঠেকাতে হবে।
গবেষণায় দেখা গেছে, ঝরে পড়া বাচ্চাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বেশি থাকে। সংলাপের ও সমঝোতার মাধ্যমে রাজনৈতিক হানাহানি কমানো বিশেষভাবে দরকার। নির্যাতিতদের দ্রুত শনাক্ত করা, পর্যাপ্ত শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা দেওয়া এবং আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, নির্যাতনকারী যাতে নির্যাতিতের কাছে যেতে না পারে, তা নিশ্চিত করার মাধ্যমে সহিংসতা প্রতিরোধ করা যায়। যেসব কিশোর ও তরুণের অপরাধ করার আশঙ্কা বেশি, তাদের অল্প বয়সেই শনাক্ত করে প্রতিরোধমূলক মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে হবে।
বিভিন্ন ধরনের সাইকোথেরাপি, যেমন—ফ্যামিলিথেরাপি, প্রিম্যারিটাল কাউন্সেলিং, ম্যারিটাল কাউন্সেলিং, ট্রমা ফোকাস্ড কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি, পারস্পরিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ওপর কিশোর-কিশোরীদের প্রশিক্ষণ, অ্যাঙ্গার ম্যানেজমেন্ট প্রশিক্ষণ, সমস্যা সমাধান প্রশিক্ষণ, সামাজিক দক্ষতা প্রশিক্ষণ, যোগাযোগ বা কমিউনিকেশন প্রশিক্ষণ, শিশু প্রতিপালনের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সহিংসতা কমানো যায়। মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিতে হবে। মানসিক রোগ দ্রুত শনাক্ত করে কার্যকর চিকিৎসা দিতে হবে।
লেখক : ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর অব ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট।