ভারতে ডিভোর্স- নারীর স্বর্গ, পুরুষের নরক
“বিয়েটা টিকিয়ে রাখতে গত সাড়ে তিনটা বছর যা সাধ্যে কুলায় করার চেষ্টা করেছি। এই সময়টায়, বহুবার এমন হয়েছে যে, যখন সে আমাকে বাজে কথা বলে বা আমার সাথে কুৎসিত আচরণ করে করে ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছে। আমার পরিবারের মানুষজনকেও বাজে কথা বলত সে (যদিও তারা আমাদের সঙ্গে থাকত না), আমার সবকিছু নিয়েই বাজে কথা বলত সে। তার নিয়ন্ত্রণ-প্রবণতা এতটা তীব্র ছিল যে মাঝে মাঝে আমার নিজেকে তার ক্রীতদাস মনে হতো। কেবল কথায় নয়, এমনকি সে আমাকে শারীরিকভাবেও নির্যাতন করত। সে খুবই সামান্য বিষয় নিয়ে আমার সঙ্গে ঝগড়া করত। যেমন ধরুন, কেন আমি শপিং মলে তার হাত ধরিনি! আমাকেই সবকিছুর জবাব দিতে হতো, ব্যাখ্যা করতে হতো, সবকিছু সামলে নেওয়ার চেষ্টা করতে হতো। তারপর সে দুঃখ প্রকাশ করত, ফিরত এবং আশা করত যে আমি সবকিছু এমনভাবে ভুলে যাব যেন কিচ্ছুটি ঘটেনি। এবার যখন সে ঘরের সবকিছু ভেঙে ঝগড়াঝাঁটি করে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়, তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিই যে, এমনটা আর চলতে পারে না। আমি ডিভোর্সের কথা চিন্তা করি। আমার মনে হলো, কোর্টে গিয়ে একটা কাগজে সই করে দিলেই আমি এই ক্রীতদাসের জীবন থেকে হয়তো মুক্তি পাব। যখনই আমি ডিভোর্সের কার্যক্রম শুরু করি, তখনই আমি বুঝতে পারি আসল নরক কী, আর যেটার জ্বালা আমি টের পেতে লাগলাম ডিভোর্স ফাইল করার সঙ্গে সঙ্গেই...
আমার স্ত্রী আমার বিরুদ্ধে আইপিসি ৪৯৮ (এ) ধারায় অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ সবার সামনে থেকে আমাকে ভ্যানে এমনভাবে টেনেহিঁচড়ে তুলল যেন আমি কোনো পলাতক আসামি। এ ঘটনা দেখে আমার মা হার্ট অ্যাটাক করেন। শুধু ডিভোর্সের কথা চিন্তা করায় পৃথিবীতে বসেই আমি যেন তখন নরক দেখেছিলাম।”
এটা কোন সিনেমার গল্প নয়। নির্যাতনের শিকার হওয়া আমার এক বন্ধুর জীবনের সত্যি ঘটনা। আমি কখনোই সেই দিনগুলো ভুলতে পারব না। তাঁর সঙ্গে যতবারই দেখা হয়েছে ততবারই সে তার কষ্টের কথা এভাবেই কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বলত।
এমন ঘটনার উদাহরণ ভূরি ভূরি, কিন্তু এ নিয়ে আলোচনা হয় কদাচিৎ। সম্প্রতি এমনই একটি আইন থেকে এক অসহায় স্বামী ন্যায়বিচার পেয়েছেন, বিবাহবিচ্ছেদের কথা জানাতেই যাকে কিনা তাঁর স্ত্রী নারী নির্যাতন মামলায় ফাঁসিয়ে দেন। স্বামীর দায়ের করা বৈবাহিক মামলার আগেই তাঁর স্ত্রী নিজেই সব ধরনের প্রমাণ প্রস্তুত করে ফেলেন, যাতে স্বামীকে উল্টো মামলা দিয়ে ফাঁসানো যায়। যদি তাঁর স্বামী তাঁকে ডিভোর্সের কাগজ না পাঠাতেন, তাহলে কখনোই হয়তো তিনি এমন মামলার কথা চিন্তা করতেন না। এই পরিস্থিতিতে স্ত্রী আইনের অপব্যবহার করে তাঁর নির্দোষ স্বামী এবং স্বামীর পরিবারকে ফৌজদারি মামলায় ফাঁসিয়ে দেন। এই মামলা দিয়ে চাপের মাধ্যমে তিনি তাঁর স্বামীর সঙ্গে নিষ্পত্তির চেষ্টা করেন।
অভিযোগকারী আইপিসি ৪৯৮ (এ) ধারায় নিষ্ঠুরভাবে তাঁর ওপর মামলা ঠুকে দেন। একজন স্বাধীন ভারতের নাগরিকের নিজের যেমন অধিকার রয়েছে, সে কাকে বিয়ে করবে, আবার যার কারণে সে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাকে ডিভোর্স দেওয়ারও অধিকার তার রয়েছে। বিবাহবিচ্ছেদের মতো এমন স্পর্শকাতর একটি বিষয়কে কোনোভাবেই আইনের জটিলতায় ফাঁসানো ঠিক না। বিবাহবিচ্ছেদের মামলা এমন কোনো জটিল বিষয় না, কারণ এ ধরনের কাজ করে সে কোনো অপরাধ করেনি। তাই ফৌজদারি মামলা দিয়ে স্বামীকে ফাঁসানোর কাজ থেকে সবাইকে নিরুৎসাহিত করার প্রচেষ্টা করা উচিত বলে আমি মনে করি।
এই মামলার রায় যদি স্ত্রীর পক্ষে যেত, তাহলে প্রতিটি মিথ্যা বলা স্ত্রী সামান্য বিষয়েই তাঁর স্বামীকে চাইলেই ফাঁসিয়ে দিতে পারবে। অভিযোগকারী স্ত্রীটি রীতিমতো একটি ক্রিমিনাল কেসে তার বিবাহিত ননদদের ফাঁসিয়েছেন এই অভিযোগে যে তারা নাকি তাঁর বৈবাহিক জীবনে ‘হস্তক্ষেপ’ করেছেন, যা তাঁর জীবনকে ধ্বংস করে দিয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা এই মামলার তদন্ত করে তেমন কোনো প্রমাণ খুঁজে পাননি। বিচারকও বুঝতে পেরেছিলেন যে, এখানে আইনের অপব্যবহার করা হয়েছে। তাই তিনি অভিযুক্ত ব্যক্তিকে এই মামলা থেকে মুক্ত করে দেন। এই ঘটনা থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, যদি কোনো স্বামী বিবাহবিচ্ছেদের কথা চিন্তা করেন, তাহলে তিনি শুধু তাঁর স্ত্রীই কেবল নন, আইনের পুরো পদ্ধতি এবং বিচার বিভাগের কারণে তাঁর জীবন নরকে পরিণত হতে পারে। এর মানে একজন নারী চাইলেই একজন নিরপরাধ পুরুষকে মামলার জোরে ফাঁসিয়ে দিতে পারেন।
২০১৩ সালে আমি একজন পুরুষের আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধান করি। বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা ছিলেন মনোজ কুমার। পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। তাঁর স্ত্রী তাঁকে ঘর থেকে বের করে দেন। তিনি পুলিশের কাছে বহুবার যান, কিন্তু পুলিশ তাঁকে দেখলেই হাসত। তাঁরা মনোজের স্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনো রকমের ব্যবস্থা নেয়নি। এরপর ডিভোর্সের জন্য মনোজ কোর্টে আপিল করেন। এ কথা শুনে মনোজের স্ত্রী মনোজের মা-ভাইয়ের বাসার সামনেই ঝামেলা শুরু করে দেন এবং পুলিশকে খবর দেন। মনোজকে তাঁর স্ত্রী যৌতুকের মামলায় ফাঁসিয়ে দেন। সেই রাতেই মনোজ গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন। মরার আগে শেষবারের মতো তিনি তাঁর টি-শার্টের ওপর লিখে যান-'' Sorry Son''।
এমন কোনো কেসস্টাডি নেই, যেখানে নারী নির্যাতনের মামলায় নিরপরাধ পুরুষরা দণ্ডিত হননি। এর কারণ, তাঁরা শুধু বিবাহবিচ্ছেদের জন্য কোর্টে আপিল করেছেন। যার ফলাফল অন্যপক্ষের মিথ্যা মামলা। এমন অনেক পুরুষের সঙ্গে কথা বলেছি, যাঁরা এই মিথ্যা মামলায় অচিরেই ফেঁসে গেছেন। যখনই কোনো পুরুষ ডিভোর্সের জন্য আবেদন করেন, ঠিক তখনই তাঁর বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন মামলা ঠুকে দেওয়া হয়। আর ভারতে এ ধরনের মামলাগুলোর কারণে পুরুষদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে যায়। সন্তান থেকে দূরে সরে যাওয়া, চাকরি চলে যায়া, মামলা থেকে বাঁচতে টাকা খরচ- আর মানসিক অশান্তি তো রয়েছেই।
আজকাল অনেক সংবাদমাধ্যমেই দেখা যায়, ভারতের নারীরা পুরুষদের আগে বিবাহবিচ্ছেদের জন্য আপিল করেন। নারীদের সব ধরনের অধিকার আছে। নিজের ইচ্ছামতো চাইলেই তিনি বিবাহবিচ্ছেদের জন্য আবেদন করতে পারেন। অথচ পুরুষরা এমন কিছু করলে তাঁকে নারী নির্যাতনের মামলায় ফাঁসানো হয়। সত্যি করে বলুন তো, পুরুষরাও যে নির্যাতনের শিকার হতে পারেন এটা আমরা কয়জন মানি!
বিবাহবিচ্ছেদ নারী পুরুষ কারো জন্যই সুখকর নয়। আমি এখানে কাউকে কষ্ট দেওয়ার জন্য কিছু বলিনি। কিন্তু আমি বলতে চাই, ভারতের আইনে সবার জন্যই রক্ষণাবেক্ষণ, ভরণপোষণ, ফৌজদারি মামলা এবং বৈবাহিক বিধান সমান হওয়া উচিত। নারীরা যেখানে বিবাহবিচ্ছেদের পর নিজেদের ভরণপোষণের ভার পুরুষদের কাছ থেকে জোর করে আদায় করে নেন, ভবিষ্যতের জন্য তাঁর কাছ থেকে টাকা আদায় করেন- এতে একজন পুরুষের জীবন নরকে পরিণত হয়।
যখন কোনো পুরুষ নিজের ইচ্ছায় আগেই বিবাহবিচ্ছেদের জন্য কোর্টে আপিল করবেন, তাঁর জন্য কি আলাদা কোনো ব্যবস্থা করা যায় না? এমন অনেক পুরুষ আছেন, যাঁদের জীবনের অনেকটা সময় বৃথা যায় শুধু বৈবাহিক অশান্তির কারণে। আমি আশা করি, আইনের লোকেরা এর কোনো সমাধান খুঁজে বের করবেন। যদি তাঁরা এমনটা না পারেন, তাহলে এটা আইন করে দিক যেন, পুরুষদের ডিভোর্স দেওয়া মানে দণ্ডনীয় অপরাধ।
দীপিকা নারায়ণ ভরদ্বাজ ভারতের একজন প্রতিষ্ঠিত তথ্যচিত্র নির্মাতা এবং বিশিষ্ট কলাম লেখক। নারীকেন্দ্রিক আইন অপব্যবহারের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য ভারতে তিনি খুবই প্রসিদ্ধ। বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে ভারতের নারী-পুরুষের মধ্যে আইনের অপব্যবহারের শিকার কে বেশি হন, এ বিষয়ে আলোচনার পাশাপাশি তুলে ধরেছেন কিছু কেসস্টাডিও। ফোকাস নিউজের অনলাইন সংস্করণে গত ২৪ জুলাই, শুক্রবার লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে। অনুুবাদ করেছেন জান্নাতুল এ্যানি ।