সড়ক দুর্ঘটনা
মহাসড়কে মৃত্যুফাঁদ ও আমাদের আনকমন কমনসেন্স
গত কয়েক বছরে সড়ক দুর্ঘটনার পরিমাণ যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে তাতে আতঙ্কগ্রস্ত হওয়ার জন্য কোনো পরিসংখ্যানের প্রয়োজন হয় না। তারপরও বলি, এ বছর ঈদের সময় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৫০ জন। (ইত্তেফাক, ২২ জুলাই ২০১৫)
অকালে ঝরে যাচ্ছে কতশত প্রাণ, পঙ্গুত্ব বরণ করছে অগণিত সাধারণ মানুষ। এর কি কোনো প্রতিকার নেই? বাঙালি হিসেবে আমরা বড় কোনো দুর্ঘটনার পর সরকারকে দু-চারটা গালি দিয়েই আমাদের মহান দায়িত্ব পালন শেষ করে থাকি। খুব বেশি হলে মানববন্ধন করে বাড়ি ফিরেই দিব্যি ভুলে যাই সবকিছু। ঘটে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। ঘটনার পৌনঃপুনিকতাও আমাদের মনে এতটুকু দাগ কাটতে পারে না, এটা সত্যিই অবিশ্বাস্য। ঈদের ছুটিতে নাড়ির টানে ঘরে ফেরা মানুষের জন্য আমরা এখনো নিরাপদ করতে পারিনি আমাদের যাত্রাপথ। জন্ম-মৃত্যু-দুর্ঘটনা সবই সৃষ্টিকর্তার হাতে, এরকম অজুহাত দিয়ে দায়িত্ব এড়ানোর বহু নজির আমাদের দেশে আছে। যারা এসব অজুহাত দেয় এবং যারা অজুহাত বিশ্বাস করে তাদের দায়মুক্তি দেয় উভয়েরই রয়েছে কমনসেন্সের অভাব কিংবা বলা যায় একধরনের আনকমন কমনসেন্স।
হাইওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং না বুঝলেও সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী আমাদের অবকাঠামোগত ও ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটিগুলো খুব সহজেই অনুধাবন করা যায়, এ জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার পড়ে না।
অবকাঠামোগত ত্রুটির কথা বলি, আমাদের বেশির ভাগ মহাসড়কগুলো যেন অ্যামাজোনের ‘অ্যানাকোন্ডা’। নির্দেশনাবিহীন স্পিড ব্রেকারগুলো মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। ক্রমাগত ‘শটকাট’ পদ্ধতির প্রয়োগ মহাসড়কগুলোকে করেছে আরো ঝুঁকিপূর্ণ। কর্তাব্যক্তিরা সড়ক পরিদর্শনে বের হলে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে চব্বিশ দিনের কাজ শেষ হয়ে যায়। টেলিভিশনে মুখ দেখানো আর বেরসিক বরখাস্ত ছাড়া কাজের কাজ যে কিছুই হয় না তা হলফ করে বলা যায়। তড়িঘড়ি করে ফেলা ইট-সুরকিগুলোর সাথে পিচ ঢালাইয়ের রাস্তার কখনো দোস্তি হয় না, হতে পারে না। যাত্রাপথ পরিণত হয় মৃত্যুযাত্রায়। প্রশ্ন জাগে, কতগুলো মৃত্যুর পর একটি সড়ক দুই লেন থেকে চার লেনে সম্প্রসারিত হয় কিংবা একটি রোড ডিভাইডার তৈরি হয়?
হিসেব কষে দেখুন, সংখ্যাটা ছোটখাটো কোনো যুদ্ধের চেয়ে নেহাত কম হবে না। আমাদের আনকমন কমনসেন্সের বদৌলতে মহাসড়ককে পরিণত করেছি মাল্টিপারপাস মহাসড়কে। মহাসড়কজুড়ে কেবল অব্যবস্থাপনা আর অব্যবস্থাপনা। রিকশা, অটোরিকশা, ব্যাটারি রিকশা, টেম্পো, সিএনজি, নসিমন, করিমন, ভটভটি, মোটরসাইকেল, সাইকেল, ঠেলাগাড়ি, ভ্যানগাড়ি, হুইলচেয়ার, ম্যাক্সি, হিউম্যান হলার, লেগুনা, লার্নিং কার, ফিটনেসবিহীন কার, ট্রাক্টর, বুলডোজার সবই আপনি মহাসড়কে পাবেন। মহাসড়ক তো নয়, যেন চাকানির্মিত যাবতীয় যানবাহনাদির একটি প্রদর্শনীস্থল! এখানেই শেষ নয়, মহাসড়কে ভ্যানের ওপর লেবুর শরবত, ডাবের পানি, আখের রস, তালশাঁস, আনারস থেকে শুরু করে নতুন-পুরোনো পোশাক, দাঁদের মলম, অষ্টধাতুর আংটি সবই বিক্রি হয়। এ ছাড়া গরুর হাট, সবজির হাট, কলার হাট, কাঁঠালের হাট মোটামুটি সব হাটই বসে খোদ মহাসড়কের ওপর। যাদের এগুলো দেখার কথা তাদের চোখ অন্যত্র। অবশ্য, মহাসড়কের ওপর গর্ত করে নির্মিত তোরণ কিংবা বিলবোর্ড-ফেস্টুনগুলো তো দেখেও না দেখার ভান করতে হয়।
এবারে আসি স্টিয়ারিং হুইল প্রসঙ্গে, এর পেছনে আসলে থাকেন কারা? মানুষের কমনসেন্স কত কম হতে পারে তা মহাসড়কে না উঠলে বোঝা যাবে না। সত্যিই আমাদের কমনসেন্স খুব আনকমন।
শুনেছি গরু-ছাগল চিনতে পারলেই ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া যায়। উপরি-উক্ত কথার সত্যাসত্য যাই হোক না কেন, গরু-ছাগল চিনতে হলে আপনাকে অবশ্যই মহাসড়কে যেতে হবে। এরা অকারণে স্পিড তুলতে পারলে আর সামনের গাড়িকে ওভারটেক করতে পারলেই এদের ড্রাইভারজীবনকে সার্থক মনে করে। অবশ্য মোবাইলে কথা বলতে বলতে এক হাতে স্টিয়ারিং ঘোরানোকেও এরা দক্ষ ড্রাইভারের একটি অপরিহার্য গুণ বলে মনে করে। অকারণে হর্ন বাজানোকে মনে করে অবশ্যপালনীয় কর্তব্য। যে প্রতিষ্ঠানটি এই ড্রাইভারদের হাতে স্টিয়ারিং ঘোরানোর লাইসেন্স দিয়ে দিয়েছে, সেখানে আমার প্রত্যক্ষ কিছু অভিজ্ঞতা রয়েছে। দালালদের দৌরাত্ম্য সেখানে এতটাই অসহনীয় যে দক্ষ লোক সেখানে ভোগান্তিতে পড়ে আর অদক্ষরা রীতিমতো বীরদর্পে পার পেয়ে যায়।
ড্রাইভিং লাইসেন্সের পরীক্ষা প্রক্রিয়া পর্যবসিত হয়েছে প্রহসনে। এখানেও খুঁজে পাবেন সেই একই আনকমন কমনসেন্স! একটি কৌতুক না বলে পারছি না। আইনজীবী জেরা করছেন এক ডাক্তারকে। ৱ
আইনজীবী : আপনি কখন ওনার শরীর পরীক্ষা করেছিলেন মনে আছে? ডাক্তার : জ্বি, আমি সকাল ৯টার সময় ময়নাতদন্তটি করি।
আইনজীবী : এবং সে সময়ে রহমান সাহেব মৃত ছিলেন, তাই না?
কমনসেন্স নিয়ে এ রকম বহু কৌতুক প্রচলিত। আরেকটি এ রকম-
-আপনার চশমাটি কীভাবে ভেঙেছে?
-এটা বুলডোজারের নিচে চাপা পড়েছিল।
-আপনি কি তখন চশমাটা পরে ছিলেন?
ড্রাইভিং লাইসেন্সের পরীক্ষায় এরকম বহু প্রশ্ন পাবেন যেখানে খোদ প্রশ্নকর্তাদের কমনসেন্স নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। ধরে নিলাম, সবার কমনসেন্স সমান নয়। কিন্তু অন্তত একটা পদে বসানোর আগে কারো ন্যূনতম কমনসেন্স তো থাকাই উচিত, তাই নয় কি? আমাদের ড্রাইভার সাহেবরা মিলিমিটারের হিসেবে গাড়ি চালায়। মাঝে মাঝে হয়তো দুটি গাড়ির দূরত্ব আরো কমে এসে হিসাবটা ন্যানোমিটারে দাঁড়ায়! তবে একটা কথা ঠিক, উন্নত বিশ্বের লোকজন আমাদের দেশে এসে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় না, তারা রেকলেস ড্রাইভিং দেখে অতিরিক্ত মানসিক চাপের কারণে হার্ট অ্যাটাক কিংবা স্ট্রোকে মারা যায়। ট্রান্সকানাডিয়ান হাইওয়ে আমি দেখেছি। সেখানে ঘণ্টায় ১১০-১২০ কিলোমিটার নৈমিত্তিক বিষয়, অথচ কত নিরাপদ। এই হাইওয়েগুলো তৈরি হয়েছে একটা মাস্টারপ্ল্যান অনুসরণ করে। সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে অন্তর্ভুক্ত করে এগিয়ে চলে এর সমন্বয়ী ব্যবস্থাপনা।
পাশ্চাত্যের একটি গল্প দিয়ে শেষ করি। একজন বাবা তাঁর দুই সন্তানকেই ক্রিস্টমাসের সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলেন। সন্তান দুটির মধ্যে একজন নৈরাশ্যবাদী অন্যজন আশাবাদী। নৈরাশ্যবাদী সন্তানটির পুরো ঘর তিনি শয়ে শয়ে খেলনা দিয়ে ভরে রাখলেন। আর আশাবাদী সন্তানটির ঘরের সব জায়গায় গোবর রেখে দিলেন। দুই সন্তানকে তাদের নিজ নিজ ঘরে ঢুকিয়ে দিলেন তাদের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য। বাবা প্রথমে নৈরাশ্যবাদী সন্তানটির ঘরে ঢুকে দেখলেন সে খুব হতাশ হয়ে কাঁদছে। তাকে কারণ জিজ্ঞেস করতে সে বলল, এতগুলো খেলনার জন্য ব্যাটারি লাগবে, ব্যাটারিগুলো শেষ হয়ে যাবে, খেলনাগুলো নষ্ট হয়ে যাবে, খেলনাগুলো ভেঙে যাবে...এ্যাঁ..এ্যাঁ..এ্যাঁ। বাবা তাঁর দ্বিতীয় সন্তানটির ঘরে গিয়ে দেখলেন সে খুব খুশি এবং কৌতূহলী মন নিয়ে ঘোরা ফেরা করছে। তাকে কারণ জিজ্ঞেস করতে বলল, বাবা, দেখো আমার ঘর জুড়ে শুধু গোবর। নিশ্চয়ই আশেপাশেই কোথাও ঘোড়াটাও রয়েছে। কী মজা! কী মজা!
আমরাও আশাবাদী। আমরা জানি, এখন দরকার সরকারের সদিচ্ছা, আইনের যথাযথ প্রয়োগ, আর সামাজিক সচেতনতা। ভুলে গেলে চলবে না আমরা এখন মধ্যম আয়ের দেশগুলোর মধ্যে একটি। তার প্রমাণ রাখতে হবে আমাদের সড়ক ব্যবস্থাপনাতেও। একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা অনুযায়ী যথাযথ বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে গড়ে তুলতে হবে একটি নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থাপনা। মহাসড়কে অটোরিকশাবিরোধী সাম্প্রতিক অভিযানকে আরো বেগবান করতে হবে। বিআরটিএসহ ট্রাফিক বিভাগকে যুগোপোযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। সর্বোপরি, আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে মানবসৃষ্ট এই বিপর্যয়কে মোকাবেলা করার জন্য।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়