এ তো নয় পুতুল পুতুল খেলা!
লোকে বলে জন্ম, মৃত্যু আর বিয়ে-এ তিনটা বিষয় নাকি নিয়তি নির্ধারিত। জন্ম ও মৃত্যু মাঝে এ কথার সত্যতা খুঁজে পেলেও কেন যেন বিয়ে নিয়ে এ কথাটি মানতে মন একদমই সায় দেয় না। সেই সৃষ্টির শুরু থেকে আজ অবধি কেউই অমরত্ব লাভ করতে পারেনি। জন্মে যে জীবনের শুরু মৃত্যুর মাধ্যমেই তার সমাপ্তি ঘটেছে। জন্ম আর মৃত্যু তাই চিরন্তন সত্য। চাইলেই একে থামিয়ে দেওয়া যায় না।
কিন্তু তাই বলে বিয়ে? এটা তো সম্পূর্ণ পরিবার বা ব্যক্তির ইচ্ছা বা অনিচ্ছার মূল্যমানে বিচার করা হয়ে থাকে। এখানে দেখাদেখির ব্যাপার থাকে। পছন্দ অপছন্দের বিষয় থাকে। আরো এমন কত কী বিষয়! কথায় আছে হাজার রকম কথার বিনিময় না হলে নাকি পারিবারিকভাবে বিয়ে পোক্ত হয় না। তাহলে তা পূর্ব নির্ধারিত হয় কেমন করে? আমার মাথায় তা আসে না।
একটা সময় ছিল যখন অল্প বয়সেই মেয়েদের বিয়ে হতো। কারণ বয়স একটু বেশি হলে সে মেয়ের বিয়ে নিয়ে বেশ ঝামেলাই হতো। তাই পাঁচ/সাত বছর বয়সেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হতো। অল্প বয়সেই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে বাবা “কন্যাদায়গ্রস্ত” পিতার তকমা হতে নিজেকে মুক্ত করতে সচেষ্ট হতেন।
বর্তমানে অবশ্য আইন করে বাল্যবিবাহকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর জন্য জেলে জরিমানার বিধানও চালু হয়েছে । তবুও তা থেমে নেই। আইনে বলা হয়েছে, বিয়ের সময় মেযের বয়স কমপক্ষে ১৮ বছর এবং ছেলের বয়স ২১ বছর হতে হবে। যদিও বর্তমান আইনে বিশেষ বিধান করে বিশেষ কারণে ১৮ বছর বয়সের নিচেও বিয়ে দেওয়ার বিধান সংযোজন করা হয়েছে; যদিও সেটা নিয়ে বির্তক আছে। তবে এ বিশেষ সুযোগ কাজে লাগিয়ে কোনো বিয়ে আজ অবধি সম্পন্ন হয়েছে- এমন খবর অবশ্য পত্রিকায় দেখিনি।
এটা ঠিক, সামাজিক সচেতনতা আগের চেয়ে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। মেয়েদের শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি চালু হওয়ার পর মেয়েরাও শিক্ষিত হওয়ার চেষ্টা করছে। মেয়েরা শিক্ষিত হচ্ছে- এটাও সত্য। ফলে অল্প বয়সে ছেলে বা মেয়ের বিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে এখন অবশ্য একটা ঢাক ঢাক গুড় গুড় ভাব দেখা যায়। বুক ফুলিয়ে বাল্যবিবাহের কথা বলতে কেউ হয়তো সাহস করে না ঠিকই কিন্তু আবার কথিত ভালো ছেলে(!) পেলে মেয়ের বিয়ে দিতেও পিছপা হয় না। কারণ এমন ভালো ছেলে (!) তো আর সহজে হাতছাড়া করা যায় না! তাতে মেয়ের কী ক্ষতি হলো সেটাও ভেবে দেখার প্রয়োজন তারা বোধ করে না। ছোট্ট মেয়েটির প্রতি পরিবারের এ কেমন নির্মমতা?
ছোটবেলায় আমার দিদি এবং প্রতিবেশী মেয়েদের দেখছি পুতুলের বিয়ে দিতে অনেকটা ঘটা করেই। সেখানেও বিয়ে পরবর্তী মিথ্যে মিথ্যে খাওয়ার আয়োজন থাকত। অল্প স্বল্প কান্নাকাটিও হতো মনে হয়। এখন অবশ্য সে পুতুল খেলার জায়গায় স্থান করে নিয়েছে নানা রকম গেমস, কার্টুন আর হরেক রকম খেলার সামগ্রী। তাই ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এখন আর পুতুলের বিয়ে নিয়ে ভাবে না। নানা রকম পড়াশোনার চাপ আর প্রযুক্তির কল্যাণে তাদের স্বাভাবিক খেলাধুলার সময়ই হারিয়ে যাচ্ছে। পুতুল পুতুল খেলার সময় কোথায়!
ছোটবেলার এ পুতুল পুতুল খেলা ও বিয়ে যুগের হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেও আমাদের কিছু মা-বাবার মাথায় ঠিকই কিন্তু তা রয়ে গেছে। তারা বাস্তবেই সে পুতুলের বিয়ে নামক খেলা চালু রাখতে চায়। এরা অজ্ঞতার ভান করে। কিন্তু আসলে তারা ধুরন্দর প্রকৃতির মানুষ । অল্প বয়সে বিয়ে দিলে একটা মেয়ের শারীরিক এবং মানষিক যে ক্ষতিসাধন হয় সেটা তারা বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকে। আইনের কথা তুললেও তারা পাত্তা দিতে চায় না। এরা আসলেই সমাজবিরোধী মানুষ।
পত্রিকায় বাল্যবিবাহের এমন নানা খবর আমরা দেখতে পায়। সেই সঙ্গে এটাও দেখতে পাই ছোট মেয়েরাই কীভাবে পরিবারের মতামতকে উপেক্ষা করে নিজেদের বিয়েকে নিজেরাই ঠেকিয়ে দিচ্ছে অস্বাভাবিক দৃঢ়তায়! তারা স্কুলে যাচ্ছে। পড়াশুনা করে বড় হয়ে তারা বিয়ে নিযে ভাবতে চায়। তার আগে নয়।এমন খবর দেখলে তাই দারুণ ভালো লাগে। তখন মনে হয় সত্যি সত্যিই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।
২০-২৫ বছর আগে সাধারণত গরিব পরিবারের মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে হতো। আর্থিক ও সামাজিক নানা কারণে পিছিয়ে পড়া এ মানুষগুলো এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হতো। কিন্তু গত ২৮ জুলাই, ২০১৭ প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত একটা সংবাদ দেখে খুবই অবাক হয়েছি। সংবাদটি হচ্ছে, কুষ্টিয়া শহরের বাসিন্দা ও কুষ্টিয়া পৌরসভার এক জনপ্রতিনিধি তার ১২ বছর বয়সী মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে ১০ ছাগল ও ৩ গরু জবাই করে এক হাজার ৫০০ লোকের জন্য খাবার দাবারের বিশাল আয়োজন করেন। পাত্র ব্যবসায়ী। ব্যবসা কিসের জানেন? বালুর ব্যবসা। এ ব্যবসা তো রাতারাতি টাকা কামানোর সহজ উপায়। টাকা এদের আছে ঠিকই কিন্তু বিবেকটা একদম অন্ধ। হায়রে! বিবেক অন্ধ জনপ্রতিনিধি! হায়রে ব্যবসায়ী!
তবে, স্থানীয় প্রশাসনের বিবেক কিন্তু বন্ধ থাকেনি। তারা এ খবর পেয়ে বিয়ের আসরে উপস্থিত হয়। প্রশাসনের হস্তক্ষেপে মুচলেকা দিয়ে মেয়ের পরিবার সে বিয়ে বন্ধ করতে বাধ্য হয়। আমার মনে হয় মুচলেকা দিয়ে শুধু বিয়েটা বন্ধ নয়, জেল-জরিমানাটাও করা উচিত ছিল।
বাল্যবিবাহ নামক বিয়েকেন্দ্রিক এ পুতুল পুতুল খেলা তাই বন্ধে দেশের প্রচলিত আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। নির্দিষ্ট বয়সের আগে ছেলেমেয়ের বিয়ে হলে তাদের অনাগত সন্তানের যে শারীরিক ও মানষিক ক্ষতি হতে পারে সেগুলো সবার সামনে তুলে ধরতে হবে। বাল্যবিবাহর কুফল নিয়ে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাল্যবিবাহ নিরোধ কমিটি করতে হবে। তাহলে হয়তো বাল্যবিবাহ নামক এ অভিশাপ থেকে আমরা ধীরে ধীরে মুক্ত হতে পারব।
লেখক : চিকিৎসক ও শিক্ষক, সহযোগী অধ্যাপক, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, এনাম মেডিকেল কলেজ।