প্রতিক্রিয়া
রাজনের জন্য প্রোটিয়া
স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই চমৎকার এক সুবিশাল বাগান— উদ্ভিদ গবেষণাকেন্দ্র। সংরক্ষিত আছে পৃথিবীর নানান দেশের উদ্ভিদ। একদিন ঘুরতে গিয়ে দেখলাম ‘প্রোটিয়া’ ফুল। আগে দেখিনি কখনো। জানতাম, ফুলটি সাউথ আফ্রিকার জাতীয় ফুল। সে দেশের ক্রিকেট বোর্ডের লোগোতে আছে এই ফুল। সাউথ আফ্রিকার ক্রিকেট টিমকে তাই প্রোটিয়াও বলা হয়।
প্রোটিয়ারা ক্রিকেটে অনেক দাপুটে। তাদের কাছে আমরা শুধু হেরেছি। আমাদের সময় বদলেছে। আমরা জিততে শিখেছি এখন। অতীতের হারগুলোর জবাব দিতে শুরু করেছি আমরা। কী পাকিস্তান, কী ভারত, আর কী প্রোটিয়া! প্রোটিয়াদের সাথে বুক সটান করে আমরা জিতেছি মিরপুরে। সৌম্য সরকার, বাংলাদেশের হৃদয়। সে হৃদয়ে জয়ের চিহ্ন এঁকে দিয়ে, মহানায়ক ভাসিয়েছে অসংখ্য জনতাকে। দুখী রাষ্ট্রকে নিয়ে দুখী মানুষের প্রতিটি আনন্দও এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য।
কিন্তু সে আনন্দেও আমরা হেরে যাই বারংবার। আমারা সহসাই টের পাই, বাংলাদেশ মানে শুধু ক্রিকেট নয়— বুক সটান করে উল্লাস নয়। বাংলাদেশে এখনো হানা দেয় হায়েনারা, নানান রূপে। সাম্প্রদায়িকতা, শোষণ, নিপীড়ন, নির্যাতন, ধর্ষণ আমাদের অহংকারের পথে কণ্টক। কীভাবে এড়াই তা! জয়ের উল্লাসে যখন ভাসছে দেশ তখন একটি শিশুকে হত্যা করেছে নরপশুরা। একটি শিশু আর কী-ই বা দোষ করতে পারে। অভিযোগ আনা হয়েছে চুরির। কিই বা চুরি করতে পারে ১৩ বছরের রাজন? খাদ্য চুরি, খেলনা চুরি, টাকা চুরি, গহনা চুরি? যাই ‘চুরি’ করুক না কেন এগুলো শিশুর জন্য কোনো অপরাধ নয়। আর যদি এরচেয়েও ভয়ংকর অপরাধ করে থাকে তাহলে তার মৃত্যু নৃশংসভাবে, নরপাষণ্ডদের হাতে হতে পারে না। আমরা নানা মাধ্যমেই এখন জানি, চুরি নয় রাজনের মৃত্যুর পেছনে রয়েছে অন্যরকম এক বীভৎস সত্য।
হাজার হাতে পায়ে ধরেও ছাড়া পায়নি রাজন। সে নিহত। নির্মমতার কাছে হার মেনে স্বর্গে উড়ে গেছে তার প্রাণ। এই শিশুটি কোনো বিত্তবান পরিবারের নয়। হয়তো কোনো খেটে খাওয়া হাভাতে, হাঘরে মানুষের সন্তান। সে অপ্রত্যাগত। কী হবে এখন? —কিছুই না! এখানে কিছু হয় না। যার বিত্ত নাই তার সত্তা নাই এ দেশে। এখানে অর্থই রাষ্ট্র, অর্থই জনতা। তবুও চাই, পশুগুলোকে মানুষ বন্দী করুক। ফিরিয়ে দিক প্রতিটি চাবুকের ক্ষত। মানুষ ঋজু হয়ে দাঁড়াক রাজনের জন্য—একটি নিরপরাধ শিশুর ওপর নৃশংসতার বিরুদ্ধে। এই বর্বরতার বিরুদ্ধে ঘৃণা জানানোর ভাষা নেই। রাজন, আমাদের ক্ষমা করিস ভাই। আমরা শুধু এটাই চাইতে জানি। আমাদের বাক্যে, শব্দে এখানে কিছুই বদলায় না। এখনো হয়নি আলো। তোর জন্য রেখেছি আমার প্রোটিয়া ফুল। দেখা হলে কখনো, হাসতে হাসতে তুলে দিব তোর ছোট্ট মায়াবী হাতে।
লেখক : গবেষক, স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়, সুইডেন।