প্রতিক্রিয়া
সুমি, সম্ভাবনার অপমৃত্যু ও আত্মকেন্দ্রিক সমাজ
তাঁকে ‘পেনসিল’ নামেই ডাকতাম। ছিপছিপে গড়নের ছিলেন বলে দুষ্টুমি করে এমন ডাক। তাতে অবশ্য তিনি মোটেও রাগ করতেন না। বরং দেখা হলেই একান-ওকান বিস্তৃত হাসিতে মুগ্ধতা ছড়িয়ে জানতে চাইতেন, কেমন আছি।
বয়সে ছোট হলেও তাঁর সাথে মিশতাম বন্ধুর মতো। যাঁরা তাঁকে চেনেন তাঁরাই বলতে পারবেন, কী প্রাণোচ্ছ্বলই না ছিলেন মেয়েটি। সৃষ্টিশীলতা, স্বতঃস্ফূর্ততা আর উদ্যম যেন একাকার হয়ে গিয়েছিল তাঁর মাঝে। অফুরান সম্ভাবনার প্রদীপ হয়ে যে আলো ছড়াচ্ছিলেন নিজ ক্ষেত্রে, সেই সুমির জীবন কখন যে কালো মেঘে ডেকে গেল ঘুণাক্ষরেও টের পেল না কেউ?
হ্যাঁ শাম্মি আক্তার সুমির কথাই বলছি। তাঁর মৃত্যু সংবাদ আমার কাছে ছিল বজ্রাঘাতের মতো। অনলাইন সংবাদমাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে দ্রুত সময়েই জানা হয়ে গিয়েছিল প্রতিভাময়ী মেয়েটির আত্মহননের সংবাদ। বারবার পড়ছিলাম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। তবু বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল কোথাও যেন বড্ড ভুল হয়ে যাচ্ছে। এমন সৃজনশীল যে সত্ত্বা সে নিজেকে ধ্বংস করে কীভাবে। কিন্তু বাস্তবতাকে একসময় মেনে নিতে হয়।
তারপরই মনে প্রশ্ন জাগে- এই মৃত্যুর দায়ভার কার? সুমির নিজের? নাকি যে বা যারা তাকে এমন পথে ঠেলে দিয়েছে তাদের? এই সময়ের কিংবা সমাজেরও কি কোনো দায়বদ্ধতা নেই?
রঙিন একটা স্বপ্ন নিয়েই তো বরিশালের আগৈলঝাড়ার মেয়েটি ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষে সৃজনশীলতার মাঝেই জড়িয়ে থাকতে চেয়েছিলেন। মনিপুরি স্কুল ও কলেজে চারুকলার শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হওয়ার পাশাপাশি কস্টিউম ডিজাইনসহ নানা সৃষ্টিশীল কাজে জড়িত ছিলেন তিনি।
সুমির সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল চারুকলায়, ২০০৮ সালে। এরপর ছবির হাঁটে ও চারুকলায় তাঁর সাথে বিভিন্ন সময়ে আড্ডার স্মৃতি আছে। ব্যস্ততার কারণে দীর্ঘদিন আর যোগাযোগ হয়ে উঠেনি। সম্ভবত ২০১৩ সালে তাঁর সাথে আমার শেষবার মুঠোফোনে কথা হয়েছিল। তাঁর কাজের ক্ষেত্র সংশ্লিষ্ট একটা বিষয়ে। তখন কি আর ভেবেছিলাম- এটাই শেষবার!
কাছের বন্ধুদের ভাষায়, ‘সুমি ছিলেন পাখির মতো। নিজে যেমন ছিলেন হাসিখুশি, তেমনি অন্যের কষ্টও সহ্য করতে পারতেন না তিনি। তাঁর সামনে মন খারাপ করে কেউ থাকতে পারত না। সবার বিপদে-আপদে সবার আগে ঝাঁপিয়ে পড়তেন তিনি।’
মঞ্চ নাটক, টেলিভিশন নাটক, চলচ্চিত্রে কস্টিউম ডিজাইন করেছেন সুমি। তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রাচ্যনাট নাট্যদলের প্রযোজনা ‘কিনু কাহারের থেটার’। ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের রচনা ও মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘আমার বন্ধু রাশেদ’। অভিনেত্রী আফসানা মিমির পরিচালনায় ধারাবাহিক নাটক ‘পৌষ ফাগুনের পালা’ ও ‘ডলস হাউস’-এর মতো জনপ্রিয় নাটকে কস্টিউম ডিজাইন করে দর্শক মনে ছাপ ফেলতে পেরেছিলেন সুমি। অসংখ্য বিজ্ঞাপনে তাঁর নকশা করা পোশাকে তারকারা ঝলমলে হয়ে উঠেছেন টিভি পর্দায়।
এত এত কাজ, এত ব্যস্ততায় যিনি ডুবে থাকতেন সারাক্ষণ, কোন অবসরে তাঁর মনে এত কষ্ট ভিড় করার সুযোগ পেয়েছিল? কোন অভিমানে সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মত্ত একজন নিজেকে এভাবে ধ্বংস করে দিলেন। তাঁর তো নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, সমাজের জন্য অনেক কিছু করার ছিল। আমরা যারা তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলাম, তাঁর কাজ দেখে, নিষ্ঠা দেখে, সৃজনশীলতা দেখে অহর্নিশ মুগ্ধ হতাম। প্রশংসায় ভাসাতাম আর প্রার্থনা করতাম তিনি যেন খোঁজে পান তাঁর স্বপ্নের ঠিকানা। এমন বিধ্বংসী সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তাঁর কি একবার মনে পড়ল না এসব গুণমুগ্ধদের কথা।
সুমির মৃত্যুর পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুক পরিচিতজনদের হাহাকারে ভরে উঠেছিল। জলের গানের ভোকালিস্ট ও প্রাচ্যনাট নাট্যদলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য রাহুল আনন্দ লিখেছিলেন ‘বইন এইটা কী করলি!! মৃত্যুকে আলিঙ্গনে কি সুখ? আহারে পাগলি।’
নাট্যকর্মী চৌধুরী নাঈম বিন আতিক লিখেছেন, ‘কখনোই কাউকে এভাবে মর্গে পড়ে থাকতে দেখার কথা ভাবতে পারিনি।সুমি আপুকে তো নয়ই। কালকে যেখানটায় দাঁড়িয়ে সুমি আপুর মৃত্যু সংবাদ পেলাম, সেখানে দাঁড়িয়েই এক প্রাণোচ্ছল স্বাপ্নিক সুমি আপুর সাথে আড্ডা দিয়েছিলাম শেষ যেদিন দেখা হয়েছিল।’ তিনি লিখেছেন, ‘সবাই মিলে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে গিয়ে বুঝলাম কি বিশাল ভুল করেছি। এই সুমি আপুকে তো দেখতে চাইনি। এর চেয়ে গতদিনের বৃষ্টিভেজা প্রাণোচ্ছল স্বাপ্নিক সুমি আপুর ছবি অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। কত স্বপ্ন, কত পরিকল্পনা, কত প্রাণশক্তি মুহূর্তে ঝরে গেল। এ রকম যেন আর কখনো না হয়।’
সবচেয়ে বেশি হৃদয়স্পর্শী স্ট্যাটাস ছিল সুমির বাল্যবন্ধু সাদিয়া আফরিন টুম্পার। তিনি লিখেছেন, “আমার বাল্যবন্ধু শাম্মি আক্তার সুমি, যার সাথে ছিল আমার হৃদ্যতা, গতকাল বিকেলে সে মারা গেছে। সে নেই এটা আমি ভাবতেই পারছি না। মৃত্যু সংবাদটি পাওয়ার পর আমি রীতিমতো ধাক্কা খেলাম। তাকে শেষবারের মতো দেখতে ঝড়ের বেগে গেলাম তার বাসায়। আমি সত্যিই খুব দুঃখিত, তোকে বাঁচাতে পারলাম না। ভালো হইছে তুই এই নিষ্ঠুর পৃথিবী থেকে চলে গেছিস। তুই যেখানেই থাকিস ভালো থাকিস। কিন্তু তোকে অনেক মিস করব। তুই আমার অনুপ্রেরণা ছিলি এবং সবসময় থাকবি। শুধু কষ্ট হচ্ছে আর কোনোদিন তোর হাস্যোজ্জ্বল মুখটা দেখতে পাব না। শুধু কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে, আর কোনোদিন কল করে শুনতে পারব না ‘বন্ধু তোর খবর কী বল?’ কীভাবে মেনে নেই বল যে তুই আর আমাদের সাথে নেই।”
জানি না কষ্টে নাকি ঘৃণায়, অভিমানে নাকি অবহেলায়- এমন পথে পা বাড়াতে হয়েছে তাঁকে। তবে এটা জানি, জীবনে প্রতিটি মানুষকে একবার না একবার কঠিন সময়ের মুখোমুখি হতেই হয়। অনেক কষ্ট থাকে, অনেক বেদনা থাকে যার ভার বয়ে চলা একা একজনের জন্য তখন কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। মানসিকভাবে প্রচণ্ড চাপে পড়তে হয় কখনো-সখনো। দুই ভাবে এ রকম পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়। প্রথমতো কাছের মানুষের সাহচর্য। তবে সমস্যা গুরুতর হলে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া দরকার। তবে সংকটের সময় সবার আগে ভূমিকা রাখতে পারে কাছের বন্ধু। যাকে অনায়াসে খুলে বলা যায় অব্যক্ত কথাগুলো। প্রকৃত বন্ধুই পারে এই দুঃসময়ে সাহস জোগাতে। সুমির বেলায় কি এমন কেউ ছিল না? নাকি এমন করে কারো ওপরই আস্থা রাখতে পারেননি তিনি। যে শূন্যতার ভার একা বইতে না পেরে নীরব অভিমানে তিনি সবাইকে ছেড়ে গেছেন না ফেরার দূরত্বে?
সুমির এই চলে যাওয়াকে কি আমরা শুধুই একটি আত্মহত্যার ঘটনার ফ্রেমে বন্দী করে রাখব? এর দায় কি আমরা কিংবা সমাজ এড়াতে পারবে? তাঁর এই আত্মহনন আমাদের পুরো সমাজব্যবস্থার বোধের জায়গায় সজোরে কষাঘাত করে। সুমির ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় ঘুণে ধরা সমাজের ক্ষতগুলোকে। এই সময়ে এসেও আমাদের সমাজব্যবস্থা কতটা একপেশে আর স্বার্থকেন্দ্রিক তাই দেখা যায় সুমির চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। এখানে কেউ বিপদগ্রস্ত হলে, ভুল করলে কিংবা কোনো কারণে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হলে তাঁর পাশে দাঁড়ানো কিংবা সান্ত্বনা দেওয়া দূরে থাক বরং তাকে শুনতে হয় তির্যক মন্তব্য। প্রতিনিয়ত হতে হয় সমালোচনার তীরে ক্ষত-বিক্ষত। ফলে সমস্যাগ্রস্ত মানুষটি হয়ে পড়ে আরো অসহায়, হতাশাগ্রস্ত। সময়ের সাথে সাথে সে নিজেকে গুটিয়ে নিতে থাকে সমাজ থেকে, মানুষ থেকে। এক সময় কোলাহল মুখরতার মাঝেও সে হয়ে যায় একেবারে নিঃসঙ্গ। বেঁচে থাকার ন্যূনতম ইচ্ছেটাও এক সময় লোপ পায় তার। আর তখনই সে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার মতো ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্তের পথে পা বাড়ায়।
শিক্ষা-দীক্ষায়, জ্ঞান-গরিমায় পৃথিবী কতই না এগিয়েছে, এগিয়েছে আমাদের আটপৌড়ে সমাজটাও। কিন্তু প্রকৃত অগ্রগতি বা শিক্ষা আমরা আদৌ কতটুকু অর্জন করতে পেরেছি তা মনে হয় ভেবে দেখা দরকার। কারণ আমরা কত কঠিন বিষয় অনায়াসে বুঝতে পারি, শুধু পারি না মানুষের মন বুঝতে। আমরা কোনো দিন ভেবেও দেখিনি একজন মানুষের মূল্য কতখানি। আমরা ভুলে যাই যে শরীরের মতো মানুষের মনেও অসুখ দানা বাঁধতে পারে। যে অসুখ সারাতে হলে মানসিক সমর্থন কতটা জরুরি। একজন ভালো মানুষ, একজন ভালো বন্ধু এই সংকটের সময় রীতিমতো চিকিৎসকের ভূমিকা পালন করতে পারে। মানসিক শক্তি দিয়ে, উৎসাহ দিয়ে, সাহস জুগিয়ে বিপর্যস্ত মানুষটিকে আবারও প্রাণ প্রাচুর্যময় করে তুলতে পারেন। কিন্তু বর্তমান সমাজ বাস্তবতায় সেই মানুষটি কোথায়। কার এত সময় আছে খোলা মন নিয়ে অন্যের পাশে দাঁড়ায়। এই সময়ে এসে আমরা সবাই বড়বেশি আত্মমগ্ন, ব্যস্ত। বড় রকম সাফল্য চাই সবাই। সেই সাফল্যকে মুঠোয় পুরতে আমরা দিনকে রাত করি আর রাতকে দিন। খোঁজ রাখি না আমাদের পাশের মানুষগুলোর, তারা কে কেমন আছে। ফলে সাফল্যের পেছনে ছুটে চলা মিছিল থেকে কাছের একজন কখন যে পেছনে পড়ে একসময় হারিয়ে যায় আমরা তা টেরও পাই না।
যে মেয়েটি স্বপ্নের রঙ-তুলিতে জীবন রাঙাবে বলে, সমাজটাকে রঙিন করে দেবে বলে ভর্তি হয়েছিলেন চারুকলায়। রঙের সাথে রঙ মিশিয়ে অর্থবহ করে তোলার শিক্ষা নিয়ে যে আমাদের কাঠখোট্টা সমাজকে মানবিক করে তুলতে চেয়েছিলেন তুলির পরশে, সেই সুমির কষ্টে লীন হওয়া আমাদের জন্য কোনো শুভ বার্তা নয়। সুমির মতো সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠে পড়া তারুণ্যই শুধু নয়, আমাদের সমাজে শিশু থেকে নানা বয়সী প্রাণ ঝরে যাচ্ছে নীরব অভিমানে। এই মর্মান্তিক মৃত্যু থামাতে হবে। এখনই রুখে দাঁড়াতে হবে, বদলাতে হবে এই নষ্ট সমাজব্যবস্থাকে। আত্মকেন্দ্রিক মনমানসিকতার পরিবর্তন করে একে অন্যের দিকে বাড়িয়ে দিতে হবে সহযোগিতা, সহমর্মিতার মানবিক হাত। তবেই কমবে এই অনাহূত মৃত্যুমিছিল। তা না হলে আমাদের অজান্তে এভাবেই অন্ধকারে মিলিয়ে যাবে কত শত প্রতিভা। এই নিষ্ঠুর, স্বার্থপর সমাজের একজন হিসেবে যার দায় আমরা কেউ এড়াতে পারব না। কবিগুরুর ভাষায় ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে। তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।’
অদিতি দাস : সাংবাদিক