পারিবারিক সহিংসতা
মুকুলের সাজা প্রাপ্য, তন্বীর পাশে আছি
একে অপরকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলেন তাঁরা।দুজনের ভালোবাসার পূর্ণতা দিতেই ঘর আলো করে আসে এক মায়াবতী কন্যা। মেয়েকে নিয়ে কত স্বপ্ন তাদের। একটু একটু করে চোখের সামনে বড় হতে থাকে জীবনের সবচেয়ে বড় ঐশ্বর্য। কিন্তু চাইলেই কি মানুষ পারে তার স্বপ্নের পূর্ণতা দিতে? বাস্তবতার এই কঠোরতার সাথে মানুষ তার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই মুখোমুখি হয়। তাই মা-বাবার সব ভালোবাসাকে তুচ্ছ করে মায়াবতী কন্যা পাড়ি জমায় না ফেরার দেশে। সন্তান হারানোর এই তীব্র কষ্ট মেনে নিতে না পেরে মা লাফিয়ে পড়েন পাঁচতলা বিল্ডিং থেকে। মরতে মরতেও বেঁচে যান মা। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে চারপাশের মানুষের ভালোবাসাতেই হয়তো অলৌকিকভাবে বেঁচে ফেরেন দুঃখিনী মা। তারপর?
স্বাভাবিকভাবেই সবার মনে যে ধারণাটা আসে তা হলো সন্তান হারানো মৃত্যুপথযাত্রী স্ত্রীকে ফিরে পেয়ে স্বামী নিশ্চয়ই পরম মমতায় আবারও নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখবেন। ধারণাটা অমূলক নয়। স্বামী প্রাণীটি ঠিকই স্বপ্ন দেখেছেন তবে তত দিনে স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা ফিকে হয়ে গেছে। তিনি স্বপ্ন দেখছেন একেবারেই নতুন করে, নতুন মানুষকে নিয়ে। এ পর্যন্ত পড়ে অনেকেই নিশ্চয়ই ভাবছেন এ আর নতুন কি? আমাদের চারপাশেই এ ধরনের ঘটনা কতই তো ঘটছে। অন্যায় জানলেও মেয়েদের প্রতি এমন নিষ্ঠুরতার সাথে অভ্যস্ত হয়ে গেছে সমাজ। কিন্তু যে দম্পতির কথা বলছি তারা খুব সাধারণ কেউ নন। তারা দুজনেই স্বনামধন্য সাংবাদিক- নাজনীন আক্তার তন্বী ও রকিবুল ইসলাম মুকুল। এ কারণেই বললাম তাঁরা সাধারণের চেয়ে কিছুটা হলেও আলাদা কারণ সমাজের অন্ধকার দিকগুলোতে আলো ফেলা কিংবা কোনটা ন্যায়, কোনটা অনৈতিক সে বিষয়ে খুব ভালো ধারণা নিয়েই তাঁরা কাজ করেন। কিন্তু তন্বীর সাথে মুকুল যে অমানবিক আচরণগুলো করেছে তা লেখাপড়া না জানা নৈতিকতা শব্দের মানে না জানা কোনো মানুষও করতে পারে না।
সহকর্মী হিসেবে মুকুলের আচরণ নিজেকে খুব ছোট করে দিয়েছে আমাদের। যদি ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা বলি, তন্বী আপা আর মুকুল ভাইয়ের কলিগ ছিলাম। তাই তন্বী আপার মেয়ে চন্দ্রমুখী (মুকুল ভাইকে এই সম্পর্কের ভিতরে টানতে খুব ঘৃণা হচ্ছে, তাই শুধু তন্বী আপার মেয়ে বললাম) যখন মারা গেল, বইমেলাতে কিংবা এসাইনমেন্টে যখনই ওদের সাথে দেখা হতো খুব কষ্ট হতো। তন্বী আপার সুস্থ হয়ে ফিরে আসতে অনেক সময় লেগেছে, সে সময় বইমেলাতে চন্দ্রমুখীকে নিয়ে লেখা মুকুল ভাইয়ের বই বেরিয়েছে। কিন্তু তখনো জানা ছিল না চেনাজানা এই মানুষ নিজের মধ্যে কি বিশাল বৈপরীত্য নিয়ে ভালো মানুষের মুখোশ পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ডাক্তারের পরামর্শে তন্বী আবার সন্তান নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও পরবর্তী সময়ে মুকুলের সেই অনাগত সন্তানের প্রতি যে আচরণ সে দেখিয়েছে তা কোনো বর্বর মানুষ ছাড়া করতে পারে না।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে মুকুল নিজে স্ট্যাটাস দিয়েছে, এই সন্তান তার কাঙ্ক্ষিত সন্তান নয়। আর তন্বী তার কাগজের বউ। এমনকি সন্তানসম্ভবা তন্বীর গায়ে হাত তুলতেও পিছপা হয়নি এই ভদ্রলোক! কারণ? তন্বী যখন বাঁচা-মরার লড়াই করছে, মুকুল তখন ব্যস্ত নতুন সম্পর্ক গড়ে তুলতে। এমনকি বেহায়ার মতো ফেসবুকে অন্য নারীর সাথে ঘনিষ্ট ছবি দিতেও এতটুকু দ্বিধা হয়নি তার। এখানেই শেষ নয়, তন্বীর পূর্বাচলের প্লট বিক্রি করে সেই টাকাও হাতিয়ে নিতে এতটুকু কুণ্ঠাবোধ করেনি সমাজের এই বিশিষ্ট সাংবাদিক!
তন্বীর ওপর নির্যাতন করেছেন প্রকাশ্যেই অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে অন্যের স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা বাসায় থেকেছেন, তন্বীর টাকা আত্মসাত করে আবার তাকে কিছু করা যাবে না বলেও আস্ফালন করেছেন মুকুল। শুধু কি তাই? নিজের সন্তানের কোনো খোজঁখবর নেওয়ারও প্রয়োজন মনে করেননি তিনি! দিনের পর দিন শারীরিক-মানসিক নির্যাতন সহ্য করে অবশেষে আইনের সহায়তা চাইলেন তন্বী। শুক্রবার রাতে পুলিশ গ্রেপ্তার করে মুকুলকে। এই ঘটনা শোনার পর অনেকের মতোই আমারও মনে হয়েছিল তন্বী তো কোনো সাধারণ মেয়ে নন, তবে কেন এত দিন ধরে এই মুখোশধারী নামকাওয়াস্তে স্বামীর ঘর করছিলেন? কেন আরো আগেই তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেননি? আমার এই প্রশ্নের জবাব সংবাদমাধ্যমেই জানিয়েছেন দৈনিক জনকণ্ঠের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক নাজনীন আক্তার তন্বী- ‘সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে এত দিন অপেক্ষা করেছি।’
তন্বীর এই কথাতে আমি ধাক্কা খেয়েছি। তন্বীর মতো স্বাবলম্বী, অনেক বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন, মানুষের বিপদে পাশে অনেক ভরসা নিয়ে দাঁড়ায় যে মেয়েটি, তার বিপদের দিনে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন মুকুল, তিনি তন্বীর সন্তানের কোনো দায়-দায়িত্ব নেননি, সামাজিকভাবেতাঁকে হেয় করেছেন, অসুস্থ মানুষটিকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করেছেন, মানসিকভাবে যখন তার পাশে থাকার কথা, তখন অন্য নারীর সাথে সম্পর্ক গড়ে, তাকে অপমানিত করেছেন, তন্বীর মতো মেয়ে কি না দিনের পর দিন অপেক্ষা করেছে তার স্বামী হয়তো একদিন তার ভুল বুঝবে? তা ঠিক। তন্বীর ভাবনাকে আমরা ভুল ভাবতে পারি না। কারণ, নীতি-নৈতিকতার নিক্তিতে প্রতিদিন যাদের দিনযাপন সেই পর্যায় থেকে একজন মানুষ এতটা নিচে নামতে পারে তা ভাবার জন্য মানসিকতা তৈরি হওয়ারও তো সময়ের প্রয়োজন।
কিন্তু আমার ভয় এখন অন্যখানে। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে তন্বী মামলা করেছেন মুকুলের বিরুদ্ধে। তাকে যেন রিমান্ডে না নেওয়া হয়, তার তোড়জোড়ও করা হয়েছিল। এমন অনেকেই আছেন যারা মুকুল দোষী জেনেও তার পাশে দাঁড়াবে। তাকে সাহায্য করতে যতটা নিচে নামা যায় তাঁরা সেটা নামবেন। হয়তো তন্বীর বিরুদ্ধেও নানান কুৎসা রটাতেও এঁরা পিছপা হবেন না। আমার এসব আশঙ্কার কথা শুনে হয়তো আমাকে হতাশাবাদী মানুষ বলবেন। কিন্তু আমি আবেগতাড়িত হয়ে এসব কথা বলছি না। আমার এই আশঙ্কার পেছনে কিছু কারণ আছে।
প্রথম উদাহরণটা আমি আগেই দিয়েছি। মুকুলের যেন রিমান্ড না হয় তার চেষ্টা হয়েছিল, যদিও এটা হওয়াটা কাম্য ছিল না। আরেকটি প্রমাণ হলো ফেসবুক। মুকুল অ্যারেস্ট হওয়ার পর ফেসবুকে সংবাদটি অনেকেই শেয়ার করেছেন। তাতে কমেন্টগুলো খেয়াল করলেই দেখা যায়, অনেকেই বলছেন দুই পক্ষেরই কথা শোনা উচিত। সেই নীতিবানদের প্রতি বলছি, আপনারা যখন দিনের পর দিন মুকুলের পোস্টে অন্য নারীর সাথে তার ঘনিষ্ঠ ছবি দেখেছেন, তখন দুই পক্ষের কথা শুনতে চাননি কেন? কেন আপনারা দাবি করলেন না তন্বী কেন চুপ করে আছে? তন্বীর কেন অন্য কারো সাথে এমন ঘনিষ্ঠ ছবি নেই? আমি নিশ্চিত, এই আপনারাই গোপনে গোপনে ছবিগুলো দেখেছেন, ফিসফিসিয়ে সমমনাদের সাথে বিষয়গুলো নিয়ে রসালো গল্প করেছেন। আমি জানি, এই কথাগুলো শুনে অনেকেই আমাকে গালি দেবেন, বলবেন নারীবাদী কথা বলছি। না, আমি মোটেও নারীবাদী নই। আমি নিজেকে মানুষ হিসেবে ভাবতে শিখেছি। এই আপনারাই কিছুদিন পরে- তন্বী বেশি বাড়াবাড়ি করেছে, মামলা তুলে ফেলে দুজনে মিলেমিশে সংসার যেন করতে পারে- সেটার জন্য সালিশ করবেন। তন্বীকে বোঝাবেন, তুমি তো মেয়ে। তোমাকেই ধৈর্য ধরতে হবে। সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে ওকে মাফ করে দাও। তোমার টাকা নিয়েছে সে তো তোমার স্বামীই, তোমার ওপর তার অধিকার আছে।
আরেকটা মজার বিষয় আমি খেয়াল করেছি, সংবাদটি অনেক অনলাইনেই এসেছে, পত্রিকাতেও এসেছে কিন্তু মুকুলের ছবি ছাপায়নি। কেন? লজ্জা লাগে? তার মানে যাঁরা ছবি ছাপাননি. তারা গোপনে গোপনে মনে ঠিকই সমর্থন করেন মুকুলকে। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, যদি মুকুলের ভূমিকায় থাকতেন তন্বী, তাহলে নিশ্চয়ই ফলাও করে ছবি আসতো তার, নিউজটা ‘সসি’ করতে হবে না!
দিনশেষে আসলে মেয়েরা মেয়েই। তন্বী যত বড়ই সাংবাদিক হোক না কেন, দেশের আর ১০ জন সাধারণ মেয়ের মতোই সে। তন্বীর ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল এ দেশের মেয়েরা কেমন আছে। কত তন্বী গোপনে সব অত্যাচার সহ্য করে চোখের জল মুছে, প্রতিদিন বেঁচে থাকার লড়াই করছে। মুকুলকে মনের গহীনে যারা সমর্থন করছেন, সে যে পেশার পুরুষ মানুষই হোন না কেন, তিনি কিন্তু ভাবছেন নারী তাদের কাছে ভোগ্যপণ্যই। অনেকেই মুকুলের মতো ভালো মানুষের মতো মুখোশধারী হয়ে বসে আছেন। এদের কোনো স্ত্রী নেই, এদের কোনো মায়াবতী চন্দ্রমুখী নেই( কীভাবে মুকুল ভুলে গেল তার মেয়ের কথা, ছোট্ট যে চন্দ্রমুখী তার ঘর আলো করে এসেছে তার মাঝে খুজেঁ নিল না চন্দ্রমুখীকে)!!!
তন্বীর পাশে আমরা আছি। আজ তন্বীর হেরে যাওয়া মানে আমাদের পরাজয়, একজন মায়ের পরাজয়, একজন মেয়ের পরাজয়। আশা করব মুকুল তার কৃতকর্মের জন্য যথাযোগ্য সাজা পাবে।
লেখক : সাংবাদিক