প্রতিক্রিয়া
অস্থিতিশীল বিদ্যাপীঠ, বিপাকে শিক্ষার্থীরা
হলের বিছানায় শুয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে জীবনের হিসাব কষছে সবুজ। হঠাৎ ফোন বেজে উঠলে তাকিয়ে দেখে, তার স্কুল-কলেজ জীবনের প্রিয় বন্ধু রবির ফোন। ফোনের রিসিভ বাটন চাপতেই ওপার থেকে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে রবি বলছে, ‘দোস্ত, আজ থেকে অনার্স শেষ। জীবনের নতুন যুদ্ধের জন্য আমি তৈরি, এখন শুধু স্বপ্নপূরণের পালা। তোর কী খবর? ফাইনাল কবে হবে?’ উত্তরে হতাশ কণ্ঠে একটি দীর্ঘশ্বাসসহ সবুজ উত্তর দেয়, ‘জানি না রে দোস্ত! বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অস্থিতিশীল অবস্থায় আজ আমার স্বপ্নগুলো চার দেয়ালে বন্দী হয়ে পড়েছে। জানি না, কবে আমার যত্নে গড়া স্বপ্নগুলো পাখনা মেলে উড়তে পারবে?’ এই হতাশা শুধু একজন সবুজের নয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া হাজারো শিক্ষার্থীর। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান আন্দোলন, অস্থিরতা, অস্থিতিশীলতায় একদিকে যেমন জিম্মি হয়ে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষাব্যবস্থা, তেমনিভাবে জিম্মি হয়ে পড়েছে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ।
ভিন্ন ভিন্ন ইস্যুকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন দাবি নিয়ে আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে অশান্ত হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি) এবং কুষ্টিয়ায় অবস্থিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি)।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) গত বৃহস্পতিবার পরীক্ষা পেছানোর দাবিতে ছাত্র আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষকদের অবরুদ্ধ করে রাখা, একাডেমিক ভবন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ক্যাম্পাসে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরাপত্তা বিধানের স্বার্থে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষা কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। এ-সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি বিভিন্ন আবাসিক হলের নোটিশ বোর্ডে টাঙিয়ে শিক্ষার্থীদের বিকেল ৫টার মধ্যে হলত্যাগের নির্দেশ দেয় কর্তৃপক্ষ। হল বন্ধ হওয়ায় সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। সাধারণত হল বন্ধ হলে দুই মাসের আগে খোলা হয় না। তাই শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেশনজটের আতঙ্ক কাজ করে।
এদিকে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড মো. আমিনুল হক ভূঁইয়ার পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। আন্দোলনকারী সরকার সমর্থক ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষকবৃন্দ’ নামক ফোরামের শিক্ষকরা উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে তালা ঝুলিয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী পদে চাকরির দাবিতে ছাত্রলীগের সাবেক নেতাকর্মীদের আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অসহায় ও জিম্মি হয়ে পড়েছে। আন্দোলনকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন, ভিসি অফিস ও অন্যান্য ভবনে তালা ঝুলিয়ে অবরোধ করে রাখেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন চলাচলও বন্ধ করে দেন। গত বুধবার বিকেলে উপাচার্যের বাসভবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে চাকরিপ্রত্যাশী ছাত্রলীগের সাবেক নেতাকর্মীদের একাংশের বৈঠক হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা বিভিন্ন কার্যালয়ে লাগানো তালা খুলে দেন এবং বাসগুলো চলাচলের ওপরও অবরোধ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। কিন্তু বৃহস্পতিবার চাকরিপ্রত্যাশীদের আরেক অংশ পরিবহন সার্ভিসের বাসগুলোর চাবি কেড়ে নেওয়ায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থী বহনকারী কোনো বাসই ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারেনি। এতে কোনো বিভাগেই পূর্বনির্ধারিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। আন্দোলনকারীরা যতক্ষণ পর্যন্ত প্রশাসনের কাছ থেকে কোনো সুস্পষ্ট বার্তা না পায়, ততক্ষণ বাসের চাবি ও ক্যাম্পাসকে স্বাভাবিকভাবে চলতে দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন।
এভাবেই কখনো শিক্ষক, কখনো কর্মকর্তা-কর্মচারী, কখনো শিক্ষার্থী, কখনো বা রাজনৈতিক ছাত্রনেতাদের আন্দোলনের চাপের মুখে অস্থির অবস্থা বিরাজ করছে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। গত কয়েক মাসে আন্দোলনের কারণে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী মুহাম্মাদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
জাতি গঠনের হাতিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমন অস্থিতিশীলতা চলতে থাকলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন এ দেশের শিক্ষার্থীরা। কেননা, একদিকে চাকরির বাজারে চাকরির অপ্রতুলতা, অন্যদিকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় এমন বৈরী পরিবেশ শিক্ষার্থীদের ঠেলে দিচ্ছে অনিশ্চয়তার দিকে। তাই সময় এসেছে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সব সমস্যার সমাধান করে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে নিয়ে আসা।
লেখক : শিক্ষার্থী, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।