বিশ্ব সংগীত দিবস
সংগীত হলো ওষুধ, সংগীত হলো সুস্থতা
এলএ ফিলহারমোনিক অর্কেস্ট্রার বেহালাবাদক রবার্ট গুপ্তা কথা বলেছেন সংগীতের জাদুকরী ক্ষমতা নিয়ে। সংগীত যে মানসিক প্রশান্তি লাভে কতটা ভূমিকা রাখতে পারে তা বোঝানোর জন্য তিনি বলেছেন মন ছুঁয়ে যাওয়া এক গল্প। যেখান থেকে দেখা যায় কীভাবে সংগীত কাজ করতে পারে মানসিক রোগের ওষুধ হিসেবে। তিনি কথা বলেছেন, তাঁর একটা লেসন নিয়ে, যেটা একসময় তিনি দিয়েছিলেন একজন দুর্দান্ত, সিজোফ্রেনিক মিউজিশিয়ানকে— আর যা তিনি শিখেছিলেন তা নিয়ে। টেকনোলজি এন্টারটেইনমেন্ট ডিজাইন (TED) আয়োজিত অনুষ্ঠানে দেওয়া এই বক্তৃতাটি বাংলায় ভাষান্তর করেছেন পার্থ প্রতীম দাস।
একদিন, লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমসের কলামলেখক স্টিভ লোপেজ হাঁটছিলেন শহরের কেন্দ্রস্থলের রাস্তা দিয়ে। হঠাৎ তিনি শুনতে পান চমৎকার একটা সংগীত। যেটা আসছিল একটা আফ্রিকান-আমেরিকানের কাছ থেকে। আকর্ষণীয়, রুক্ষ, গৃহহীন, সেই লোক একটা বেহালা বাজাচ্ছিলেন, যেটাতে ছিল মাত্র দুইটা তার।
আর আমি যে গল্পটা বলছি সেটা হয়তো আপনাদের অনেকেই জানেন। কারণ এটা নিয়ে স্টিভের কলাম হয়েছিল একটা বইয়ের ভিত্তি। যেটাকে আবার পরে চলচ্চিত্র রূপও দেওয়া হয়েছিল। যেখানে স্টিভ লোপেজের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন রবার্ট ডউনি জুনিয়র আর জ্যামি ফক্স নিয়েছিলেন নাথানিয়েল অ্যান্থনি আয়ার্স-এর ভূমিকা। নাথানিয়েল আয়ার্স হচ্ছেন জুইলিয়ার্ড প্রশিক্ষিত সেই ডবল ব্যেস যন্ত্রের বাদক। যাঁর সম্ভাবনাময় সংগীত জীবন টালমাটাল হয়েছিল প্যারানয়েড সিজোফ্রেনিয়া নামক করুণ অসুখটার কারণে। নাথানিয়েলকে জুইলিয়ার্ড থেকে বের করে দেওয়া হয়। মানসিকভাবে পুরোপুরি বিধ্বস্ত একটা অবস্থার মধ্য দিয়ে তাঁকে যেতে হয়েছে। আর তার ৩০ বছর পরে তিনি বসবাস করছেন, গৃহহীনভাবে। লস অ্যাঞ্জেলেসের শহরের কেন্দ্রস্থলের স্কিড রো সড়কে। আমি সবাইকে অনুপ্রাণিত করব স্টিভের বইটা পড়তে বা সিনেমাটা দেখতে শুধু এটা বোঝার জন্যই না যে, কী ধরনের চমৎকার একটা বন্ধন গড়ে উঠেছিল এই দুজন মানুষের মধ্যে, বরং এটা বোঝার জন্যও যে, কীভাবে সংগীত সেই বন্ধনটার আদল গড়েছে। আর শেষপর্যন্ত আর শেষ অবধি সেটাই সহায়ক হলো-নাথানিয়েলকে সড়ক থেকে তুলে আনার জন্য সহায়তার জন্য।
আমি মি. আয়ার্সের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম ২০০৮ সালে, দুই বছর আগে। ওয়াল্ট ডিজনি কনসার্ট হলে। সেইমাত্রই তিনি বিটোফেনের প্রথম ও চতুর্থ সিম্ফোনির অনুষ্ঠান শুনেছিলেন। আর তারপর মঞ্চের পেছনে এসে নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি খুবই আমুদে আর বন্ধুত্বপূর্ণভাবে কথা বলছিলেন ইয়ো-ইয়ো মা ও হিলারি ক্লিনটনান্ড নিয়ে যে, আর কীভাবে ডজার্স কখনো বিশ্বপর্যায় জিততে পারবে না। আর বিটোফেনের চতুর্থ সিম্ফোনির শেষ মুভমেন্টে ছলচাতুরিপূর্ণ প্রথম বেহালা প্যাসেজের কাজটাই সবকিছুর কারণ। আমরা সংগীত নিয়েই কথা বলছিলাম। তার কয়েকদিন পরে আমি স্টিভের কাছ থেকে একটা ইমেইল পেলাম যে, নাথানিয়েল আমার কাছ থেকে বেহালার একটা পাঠ নিতে আগ্রহী।
এখন আমার এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, নাথানিয়েল কোনোরকম চিকিৎসা নিতে আপত্তি জানান। কারণ যখন তিনি চিকিৎসার মধ্যে দিয়ে গেছেন তখন সেগুলো ছিল শক থেরাপি, থোরাজিন আর হাতকড়া। এই ভয়টা পুরো জীবনে সব সময়ই তাঁর সঙ্গে থেকেছে। কিন্তু তাঁর পরিণতিতে, তিনি এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছেন তাঁর এই সিজোফ্রেনিক পর্বগুলোতে যেগুলোর সবচেয়ে বাজে ধরনটা হতে পারে যে, তিনি উন্মাদনায় ফেটে পড়েন ও তারপর দিনকতক গায়েব থাকেন। ঘুরে বেড়ান স্কিড রো-র রাস্তায় রাস্তায়। তিনি তাঁর নিজেরই ভীতিগুলোর কাছে প্রকাশিত হয়ে পড়েন। তার নিজ মস্তিষ্ক সৃষ্ট নিদারুণ যন্ত্রণাই তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
আর নাথানিয়েল এ রকম উত্তেজিত একটা পর্যায়েই ছিলেন, আমরা আমাদের প্রথম পাঠ শুরু করেছিলাম, ওয়ার্ল্ড ডিজনি কনসার্ট হলে। তাঁর চোখে ছিল একধরনের উন্মাদ দৃষ্টির ঝলক। তিনি হারিয়ে গিয়েছিলেন। আর তিনি কথা বলছিলেন কিছু অদৃশ্য শয়তান আর ধোঁয়া নিয়ে। আর কীভাবে কোনো একজন তাঁকে ঘুমের মধ্যে বিষ দিচ্ছিল।
আমি ভয় পেয়েছিলাম। নিজের জন্য না, বরং আমি ভয়ে ছিলাম যে, আমি তাকে হারিয়ে ফেলব। তিনি তাঁর সেই ধরনের পরিস্থিতিতে তলিয়ে যাচ্ছেন। আমি ভয় পাচ্ছিলাম, তাঁর সঙ্গে বেহালাটার যে সম্পর্ক, তা নষ্ট করে ফেলব যদি আমি কথা বলা শুরু করি স্কেল, অ্যারপেজিও আর অন্যান্য সব উত্তেজক ধরনের বেহালা শিক্ষণবিজ্ঞানের নীতিমূলক ব্যাপার নিয়ে। (হাসি) কাজেই, আমি বাজাতে শুরু করলাম। আমি বাজিয়েছিলাম বিটোফেনের বেহালা কনসার্টের প্রথম মুভমেন্ট।
আর বাজাতে বাজাতে আমি বুঝেছিলাম যে, একটা সুস্পষ্ট পরিবর্তন ঘটছে নাথানিয়েলের চোখগুলোতে। যেন কোনো অদৃশ্য ওষুধ তাঁর ওপর কাজ করছে। যেন একটা রাসায়নিক বিক্রিয়া, যেখানে আমার সংগীতটা কাজ করছে অনুঘটক হিসেবে। আর নাথানিয়েলের উন্মাদনা ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয়ে যেতে থাকল বোঝাপড়ায়, এক শান্ত কৌতূহলে এবং মহিমায়। আর আশ্চর্যজনকভাবে তিনি তাঁর বেহালাটা তুলে নিলেন আর বাজাতে শুরু করলেন। আমরা সংগীত নিয়ে কথা বলা শুরু করলাম। বাখ থেকে বেটোফেন, ব্রাহমস, ব্রুকনার, সব “ব”-গুলো, বারটোক থেকে সুদূরবিস্তৃত ইসা-পেক্কা সালোনেন পর্যন্ত।
আমি বুঝেছিলাম যে, সংগীত সম্পর্কে তার যে শুধু বিশ্বকোষ পরিমাণ জ্ঞানই আছে তাই নয়, বরং তিনি এই পরিমাণ সংগীতের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন ব্যক্তিগত জীবনেও। তিনি এটা নিয়ে এত আবেগ আর সমঝদারিত্ব নিয়ে কথা বলছিলেন যেমনটা আমরা বলি, আমাদের সহকর্মীদের সঙ্গে। লস অ্যাঞ্জেলেস ফিলহারমোনিকে আর এভাবে বাজাতে বাজাতে, সংগীত নিয়ে কথা বলতে বলতে ভ্রম-বাতুলতার লক্ষণাক্রান্ত মানসিক রোগী থেকে একটা মনোমুগ্ধকর, জুইলিয়ার্ড-প্রশিক্ষিত সংগীতজ্ঞে রূপান্তরিত হয়ে গেলেন মানুষটা।
সংগীত হলো ওষুধ। সংগীত আমাদের পরিবর্তিত করে। আর নাথানিয়েলের জন্য সংগীত হলো মানসিক সুস্থতা। কারণ সংগীত তাঁকে সুযোগ করে দেয় তাঁর চিন্তাভাবনা ও ভ্রমগুলোকে গ্রহণ করার আর সেগুলোকে নিজের কল্পনা ও নিজের সৃজনশীলতা দিয়ে বাস্তব একটা আদল দেওয়ার। আর এটা একটা পালিয়ে থাকার উপায় তাঁর নির্যাতিত অবস্থা থেকে। আর আমি বুঝেছিলাম যে, এটাই শিল্পের মূল নির্যাস। এটাই হয়তো সেই কারণ, যে কারণে আমরা সংগীত সৃষ্টি করি। এমন কিছু গ্রহণ করি যেটা আমাদের সবারই একেবারে মূলগত জায়গায় বিরাজ করছে। আমাদের আবেগ, আর আমাদের এই শৈল্পিক দৃষ্টি দিয়ে, আমাদের সৃজনশীলতা দিয়ে আমরা আমাদের ওই আবেগ-অনুভূতিগুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে সক্ষম হই। আর সেই প্রকাশের বাস্তবতা আমাদের সবার কাছে পৌঁছায়, আমাদেরকে তাড়িত করে, উৎসাহিত করে, একাত্ম করে।
আর নাথানিয়েলের জন্য, সংগীত তাঁকে ফেরায় একটা বন্ধুঘেরা পরিবেশে। সংগীতের মুক্ত হওয়ার ক্ষমতা তাঁকে ফিরিয়ে আনে একটা সংগীতানুরাগীদের পরিবারে যারা তাকে বোঝে, যারা তার প্রতিভার স্বীকৃতি দেয়, শ্রদ্ধা করে। আর আমি সব সময়ই নাথানিয়েলের সঙ্গে সংগীত-চর্চা করব, সে আমরা ওয়ার্ল্ড ডিজনি কনসার্ট হলেই থাকি বা স্কিড রো-তে। কারণ তিনি আমাকে মনে করিয়ে দেন যে, কেন আমি মিউজিশিয়ান হয়েছি।
ধন্যবাদ।