আন্তর্জাতিক
সৌদি আরবে সন্ত্রাসী তৎপরতা
গোটা বিশ্বে সৌদি আরব একটি তাৎপর্যপূর্ণ অবস্থানে অধিষ্ঠিত। এর প্রধান কারণ দেশটি মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রাণকেন্দ্র। মুসলমানদের কাছে সবচেয়ে পবিত্র এবং মর্যাদাপূর্ণ দুটি নগরী—মক্কা ও মদিনা সৌদি আরবে অবস্থিত। এ ছাড়া ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মভূমি-লালনভূমি সৌদি আরব। সৌদি শাসকরা নিজেদের ‘খাদেমুল হারামাইনেশ শরিফাইন’ বা পবিত্র নগরীদ্বয়ের খেদমতগার বলতে গৌরবান্বিত মনে করেন। গোটা মুসলিম বিশ্ব আধ্যাত্মিক এবং রাজনৈতিক দিক দিয়ে সৌদি আরবের দিক থেকে নির্দেশনার অপেক্ষায় থাকে। নিকট অতীতে সৌদি আরবে পৃথিবীর বৃহত্তম তেলভাণ্ডার আবিষ্কৃত হওয়ায় তার গুরুত্ব অনেক গুণ বেড়ে যায়। ভৌগোলিক অবস্থানগতভাবেও পূর্ব গোলার্ধের মধ্যবর্তী জায়গায় অবস্থান হওয়ার কারণে রণকৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত, সংক্ষুব্ধ এবং সংবেদনশীল মধ্যপ্রাচ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত হওয়ার কারণে এর সংশ্লিষ্টতা ব্যাপক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে সৌদি রাজবংশ ক্রমাগতভাবে নিজেদের অবস্থান ও মর্যাদা বৃদ্ধি করে চলেছে।
সৌদি আরবের রাজনৈতিক পদমর্যাদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এর শত্রুর সংখ্যাও বেড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি যুদ্ধ ও সংকটে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সৌদি আরবকে ভূমিকা রাখতে হয়েছে। মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক অভিভাবক হিসেবে অব্যাহতভাবে তাদের ইসরায়েল তথা ইহুদিবাদের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে। ইসরায়েল মনে করে, সৌদি আরব তাদের একটি বড় শত্রু। অন্যদিকে, ফিলিস্তিনি জনগণসহ গোটা মুসলিম বিশ্ব তাদের থেকে কট্টর ইসরায়েলবিরোধী ভূমিকা আশা করে। সৌদি রাজতন্ত্র তাদের অস্তিত্বের জন্য পাশ্চাত্যের সঙ্গে একরকম আপসকামী ভূমিকা পালন করে আসছে। এভাবে উভয় পক্ষের আস্থা ও অনাস্থার মাঝামাঝি শাঁখের করাতে পরিণত হয়েছে সৌদি আরব।
১৯৭৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে সৌদি বাদশাহ ফয়সালের নেতৃত্বে যখন তেল নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, তখন পাশ্চাত্য সৌদি কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। সংকট যখন চরমে পৌঁছে, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সৌদি তেলক্ষেত্র দখল করে নেওয়ার প্রস্তুতি নেয়। চাপের মুখে তেল নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। কিছুদিনের মধ্যেই বাদশাহ ফয়সাল নিহত হন। পর্যবেক্ষক মহল মনে করে, এ মৃত্যুর পেছনে পাশ্চাত্যের ভূমিকা রয়েছে। সেই থেকে সৌদি আরবের পাশ্চাত্য-ঘেঁষা নীতি অব্যাহত রয়েছে।
১৯৯০ সালে ইরাকের সাদ্দাম হোসেন কুয়েত দখল করলে মার্কিন বাহিনীর নেতৃত্বে যৌথ বাহিনী কুয়েত পুনরুদ্ধারে অগ্রসর হয়। মার্কিন বাহিনী মূলত সৌদি আরব ভিত্তি করে এ অভিযান পরিচালনা করে। ইসলামের পবিত্র ভূমিতে বিজাতীয় বিধর্মী বাহিনীর অবস্থানে মুসলিম-বিশ্বে এবং খোদ সৌদি আরবে চাপা ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এ অবস্থার সুযোগ গ্রহণ করেন আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। ২০০১ সালে মার্কিন টুইন টাওয়ার ধ্বংসের অব্যবহিত পরে সৌদি-মার্কিন সম্পর্ক আরেকবার হোঁচট খায়। হামলায় অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ ব্যক্তি সৌদি নাগরিক হওয়ায় সৌদি রাজতন্ত্র বিব্রতকর অবস্থার সম্মুখীন হয়। সৌদি কর্তৃত্ব ৯/১১ হামলার জন্য অভিযুক্ত ওসামা বিন লাদেনের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়ে সম্পর্ক সহজ করে। এ ছাড়া পরবর্তীকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তা মিত্ররা আফগানিস্তান ও ইরাক দখল করে নিলে সৌদি আরব ব্যাপক সহায়তা প্রদান করে। সৌদি-মার্কিন সম্পর্কও ক্রমে যতই জোরদার হতে থাকে, ততই নিজ সাধারণ নাগরিক এবং মুসলিম জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সৌদি কর্তৃত্বের ব্যবধান বাড়তে থাকে।
মূলত সৌদি ধনকুবের ওসামা বিন লাদেনই হচ্ছেন সৌদি আরবে সন্ত্রাসের মূল হোতা। তিনি মুসলিম বিশ্বের দুর্দশা-দুর্ভোগের জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে সৌদি নেতৃত্বকে দায়ী করেন। সৌদি রাজতন্ত্র ওসামা বিন লাদেন প্রতিষ্ঠিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আল-কায়েদার লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠে। অবশ্য ২০০১ সালের আগে সৌদি সীমানায় কোনো হামলার প্রমাণ পাওয়া যায় না। ২০০০ সালের ১৭ নভেম্বর রাজধানী রিয়াদের কেন্দ্রস্থলে এক ব্রিটিশ দম্পতির ওপরে বোমা হামলা চালানো হয়। ওই বছরের ২২ নভেম্বর রিয়াদে আরেকটি হামলার ঘটনা ঘটে। ১৫ ডিসেম্বর আরেকটি হামলায় একজন ব্রিটিশ নাগরিক আহত হন। ২০০১ সালের ১০ জানুয়ারি রিয়াদের এক সুপারমার্কেটে বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। একই বছরের ১৫ মার্চ রিয়াদে আরেকটি বোমা বিস্ফোরণের প্রয়াস লক্ষ করা যায়। ৩ মে আল খোবারে পারসেল বোমায় একজন মার্কিন চিকিৎসক আহত হন। ওই বছরের ৬ অক্টোবর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আফগানিস্তান দখলের প্রাক্কালে ৬ অক্টোবর আত্মঘাতী বোমা হামলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন নাগরিক নিহত হন। আহত হন বিভিন্ন দেশি আরো কয়েকজন। ১৫ নভেম্বর রিয়াদে অবস্থানরত এক জার্মান পরিবার বোতল বোমার দ্বারা আক্রান্ত হয়। ২০০৩ সালের আগস্টে রিয়াদে আবার সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটে। সন্দেহ করা হয়, বিদেশি নাগরিকরা এ ঘটনা ঘটায়। ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এম১৬-কে এ জন্য দায়ী করা হয়। এসব ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ইসরায়েলি সংশ্লিষ্টতারও প্রমাণ মেলে। এর পর ২০০২ সালে একজন সুদানি নাগরিক মার্কিন যুদ্ধবিমানকে গুলি করে ভূপাতিত করার চেষ্টা করে। এ বছরের ৫ জুন একজন অস্ট্রেলীয় নাগরিক নিহত হন। ২০ জুন একজন ব্রিটিশ নাগরিক নিহত হন। ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একজন বন্দুকধারী একজন অস্ট্রেলীয় নাগরিককে হত্যা করে। একজন সৌদি নাগরিক নিহত হন ১৮ মার্চ। ওই বছরের ১ মে সৌদি আরবের নৌবাহিনীর পোশাকধারী একজন মার্কিন ঘাঁটিতে প্রবেশ করে এক মার্কিন নাগরিককে হত্যা করে। ৬ মে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকধারীদের গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এ বছরের ১ মে একটি বড় ধরনের সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটে। রিয়াদের বিদেশি বসবাসকারী কম্পাউন্ডে তিনটি গাড়িবোমা বিস্ফোরণে ২৬ জন নিহত হন। এ ঘটনায় নয় সন্ত্রাসীও নিহত হয়। ৮ নভেম্বর ঘটে আরো একটি সন্ত্রাসী ঘটনা। এতে সৌদি আরবে কর্মরত ১৭ শ্রমজীবী মানুষ নিহত হন। আরো আহত হন ১০০। তারা সকলেই ছিলেন মুসলমান। এ ঘটনার পর সৌদি নাগরিকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ২০০৩ সালের ঘটনাবলি প্রমাণ করে, সৌদি নিরাপত্তা অভ্যন্তরে আল-কায়েদার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এমন মন্তব্য করে ডেইলি টেলিগ্রাফ। ২০০৪ সাল ধরে অনেক ছোটখাটো ঘটনা ঘটে। সৌদি নিরাপত্তা বাহিনীও কার্যকর ব্যবস্থা নেয়। ২০০৫ সালে সৌদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ব্যাপক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। অবশ্য এ বছরও ছোটখাটো ঘটনা ঘটে। ২০০৪ সালের পর থেকে এর আগে গৃহীত কর্মতৎপরতার সুফল লক্ষ করা যায়। ২০০৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি দুটো বিস্ফোরক বহনকারী গাড়ি আবকুইক তেলক্ষেত্রে প্রবেশের চেষ্টা করে। সৌদি আরবের বৃহত্তম তেলক্ষেত্রে প্রবেশকালে সন্ত্রাসীরা নিহত হয়। আক্রমণটি সফল হলে তেল উৎপাদন ক্ষেত্রের বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা ছিল। ২০০৭ সালেও কিছু ঘটনা ঘটে। ২৬ ফেব্রুয়ারি নয় ফরাসি নাগরিককে হত্যার চেষ্টা করা হয়। এ বছর সন্ত্রাসী সন্দেহে ব্যাপক ধরপাকড় ঘটে। গ্রেফতারকৃতদের পক্ষে মার্চ মাসে তাঁদের আইনজীবী দাবি করেন, অভিযুক্তরা কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নয়, বরং তারা একটি নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের পক্ষে সংস্কারবাদী। ২০০৯ সালে একটি বড় ধরনের ঘটনায় সৌদি নিরাপত্তাপ্রধান যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। আত্মঘাতী এই বোমা হামলায় যুবরাজ সামান্য আহত হন। ১৯৭৫ সালে বাদশাহ ফয়সাল নিহত হওয়ার পর কোনো রাজকীয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে এটাই ছিল প্রথম হামলা। ২০১১ সাল পর্যন্ত আর তেমন কোনো সন্ত্রাসী ঘটনা লক্ষ করা না গেলেও সন্দেহভাজনদের বিচার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। ২০১২ ও ২০১৪ সালে সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণ এবং বিস্ফোরকদ্রব্য উদ্ধারে সফল তৎপরতা লক্ষ করা যায়।
২০১৪ সালের মাঝামাঝি থেকে গোটা মুসলিম বিশ্বে সন্ত্রাসের একটি নতুন মাত্রা লক্ষ করা যায়। এ সময়ে সিরিয়া ও ইরাকভিত্তিক ইসলামিক স্টেট নামের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর ব্যাপক তৎপরতা লক্ষ করা যায়। নাইজেরিয়ার বোকো হারাম থেকে সোমালিয়ার আল-শাহাবসহ অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রের সব সন্ত্রাসী গ্রুপের একটি সমন্বিত তৎপরতা লক্ষ করা যায়। এই নতুন তৎপরতা সৌদি আরবেও অভিঘাত হানে। এ বছরের মার্চ মাসে একটি বড় ধরনের সন্ত্রাসী তৎপরতা নসাৎ করা হয়। ৬২ সন্ত্রাসী একটি যৌথ তৎপরতার মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তা এবং স্থাপনায় আঘাত হানার পরিকল্পনা করছিল আইএসকেন্দ্রিক সন্ত্রাসীরা।
২০১৪ সালের শেষের দিকে সৌদি নিরাপত্তার প্রতি একটি বড় ধরনের হুমকি সৃষ্টি হয় ইয়েমেন থেকে। এ সময়ে ইয়েমেনের নিয়মতান্ত্রিক সরকারের পতন হয়। সেখানে শিয়া প্রভাবিত হুতি গোত্র প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করে। নিয়মতান্ত্রিকভাবে বিরোধ-মীমাংসার আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক প্রয়াস ব্যর্থ হয়। শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। সৌদি আরবসহ কয়েকটি আরব রাষ্ট্র ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট আবেদ রাব্য মনসুর হাদির পক্ষে লড়াই করছে। অন্যদিকে হুতিদের অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে ইরান সহায়তা করছে বলে সৌদি কর্তৃপক্ষ বারবার অভিযোগ করছে। ইরান সব সময়ই এ অভিযোগ অস্বীকার করছে। দুই মাস ধরে সেখানে চলছে রীতমতো যুদ্ধ। এ মাসের (জুন ২০১৫) প্রথম সপ্তাহে হুতিরা সৌদি আরবের অভ্যন্তরে স্কাড ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। সৌদি রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা জানায়, সৌদি বাহিনী দুটি প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে স্কাড ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করে দেয়। উল্লেখ্য, ইয়েমেনের গত কয়েক সপ্তাহের লড়াইয়ে দুই হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। ১৩ জুন বার্তা সংস্থার খবরে বলা হয়, সৌদি বাহিনী আরেকটি ইয়েমেনি হামলা প্রতিহত করেছে। বলা যেতে পারে, সৌদি আরব ও ইরান এ অঞ্চলে প্রভাববলয়ের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছে। ইরান সরাসরি যুদ্ধ না করলেও সৌদি আরব আন্তর্জাতিক বিশ্বের সহায়তায় ‘প্রক্সি ওয়ার’ চালিয়ে যাচ্ছে।
যুদ্ধের পাশাপাশি শান্তির প্রচেষ্টাও অব্যাহত রয়েছে। ইয়েমেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ১৪ জুন শান্তি আলোচনা শুরু হয়েছে। সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে অনুষ্ঠিত এ আলোচনায় সব পক্ষ যোগ দিয়েছে। ইয়েমেনের লড়াই বন্ধ করার লক্ষ্যে এটিই প্রথম কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। উভয় পক্ষ শান্তির লক্ষ্যে কাজ করে যাবে—এ প্রত্যাশা সবার।
লেখক : অধ্যাপক ড. আবদুল লতিফ মাসুম, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।