শ্রমিকের কান্না
অ্যালোপ্যাথির দাওয়াই, একটি রানা প্লাজা ও পুলিশের চার্জশিট
আমার ছোটবেলার বন্ধু তাপস। খুব বেশি পড়াশোনা করতে পারেনি বলে জীবিকার তাগিদে গ্রাম থেকে এসে সাভারের একটি পোশাক কারখানায় চাকরি নিয়েছিল। সদ্য বিয়ে করে স্বামী-স্ত্রী মিলে একই কারখানায় কাজ নিয়েছিল সংসারটিকে একটু গুছিয়ে নেওয়ার জন্য। রানা প্লাজা ধসে পড়ার পর তাপসের শেষ ফোন কলটি ছিল ওর বড় ভাইয়ের কাছে, বাঁচার প্রচণ্ড আকুতি নিয়ে। আমরা সবাই অসহায়ের মতো চিৎকার শুনেছি, কী-ই বা করার ছিল? কজনের জন্য করা যায়, কতটুকু করা যায়? তাপসের স্ত্রীকে ভাগ্যবতীই বলতে হবে, দুর্ঘটনার পরের দিনই তার লাশটা পাওয়া গিয়েছিল। তাপস ছিল সবচেয়ে হতভাগ্যদের মধ্যে একজন। ওর বড় ভাইকে ডিএনএ টেস্ট দিয়ে ওর লাশ শনাক্ত করতে হয়েছিল, তাও প্রায় দুর্ঘটনার দুই সপ্তাহ পর।
প্রতিবছর ২৪ এপ্রিল আমরা সবাই আরো একবার নড়েচড়ে বসি। চার্জশিট থেকে কেন সরকারি কর্মকর্তাদের বাদ দেওয়া হলো সে প্রসঙ্গ নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় তুলি। কিংবা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার তত্ত্বাবধানে তৈরি তহবিলের সুষম বণ্টন নিয়ে প্রশ্ন তুলি। দু-একদিন পরে সবকিছু আবার স্বাভাবিক (!) হয়ে যায় আমাদের কাছে। আহত শ্রমিকদের যন্ত্রণার আর্তনাদ চাপা পড়ে যায় সদ্য রিলিজ হওয়া কোনো ইংরেজি গানের সুউচ্চ শব্দ-ঝংকারে। পঙ্গু শ্রমিকদের বেঁচে থাকার নিরন্তর প্রচেষ্টার খবর ছাপিয়ে আমাদের চোখে ভাসে পার্শ্ববর্তী ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপ্রধানের সফরের পর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির স্বপ্ন। হয়তো আরো একটি রানা প্লাজা দুর্ঘটনা ঘটবে। কিংবা তীব্র একটি ভূমিকম্পের পর আবারও আমরা আটকে পড়া তৈরি পোশাক শ্রমিকদের আর্তনাদ শুনে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকব অগণিত রানা প্লাজার সামনে।
আমার দাদা, যে কোনো রোগের চিকিৎসার ব্যাপারে হোমিওপ্যাথির চেয়ে অ্যালোপ্যাথির চিকিৎসার ওপর বেশি ভরসা রাখতেন এর দৃশ্যমান এবং দ্রুত রোগ উপশমক্ষমতার জন্য। কিন্তু তিনি সঙ্গে সঙ্গে এটাও স্বীকার করতেন যে, সম্পূর্ণরূপে রোগ নির্মূল করতে হলে রোগের কারণ ও লক্ষণ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় সঠিক ডোজ নির্ধারণ করাটাই সবচেয়ে উত্তম, যেটা হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাপদ্ধতিতে লক্ষণীয়। প্রশ্ন জাগে, রানা প্লাজার ঘটনায় চার্জশিট কিংবা ক্ষতিপূরণের দাওয়াই দিয়ে শুধুমাত্র সাময়িক উত্তেজনাকে প্রশমিত করছি না তো? আমরা কি একটি দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা থেকে ক্রমান্বয়ে দূরে সরে যাচ্ছি না? মধ্যমাত্রার ভূমিকম্পেও সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে থাকা পোশাক শ্রমিকদের জন্য কী করছি আমরা, কী করছে সরকার?
একটি দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো কারখানার কর্মপরিবেশকে সবদিক দিয়ে ঝুঁকিমুক্ত রাখা। এ ক্ষেত্রে কর্মপরিবেশের বাহ্যিক কিংবা ফিজিক্যাল ঝুঁকির সঙ্গে সঙ্গে এর সমাজমনস্তাত্ত্বিক ঝুঁকিগুলো হ্রাস করার ক্ষেত্রে শক্ত পদক্ষেপ নেওয়াটা এখন সময়ের দাবি। বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোর কর্মপরিবেশ নিয়ে ভয়ংকর একটি তথ্য উঠে এসেছে ২০০৬ সালে পরিচালিত একটি সমীক্ষায়, পরবর্তীতেকালে যা ‘জেন্ডার ডাইমেনশন অব অকুপেশনাল হেলথ হ্যাজার্ডস : এক্সপেরিয়েনস অব ওমেন গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ইন ঢাকা সিটি’ নামে বই আকারে প্রকাশিত হয়। এ সমীক্ষায় দেখা যায় যে, পেশাগত স্বাস্থ্যঝুঁকির জন্য ৯৮ শতাংশ নারী পোশাককর্মীই প্রজননস্বাস্থ্য সম্পর্কিত স্বল্প অথবা বড় কোনো না কোনো সমস্যায় ভুগছেন। ৯৫ শতাংশ নারী পোশাককর্মীই কোনো না কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হন। এ ছাড়া রিমোটিক ফিভার, হেপাটাইটিস, সিফিলিস, স্মল পক্স, সাইনোসাইটিস, যক্ষ্মা, অ্যাজমা, অনিদ্রা, গ্যাস্ট্রিক-আলসার, লিউকোরিয়া, হাইপার টেনশন, ডায়াবেটিস, ইউরেনাল ডিজঅর্ডার ও হার্নিয়ার মতো রোগে ভোগে অধিকাংশ পোশাককর্মী। এগুলোর কারণ হিসেবে একটানা বসে থাকা, ঘেমে যাওয়া, কাপড়ের ধুলা, বাতাসে ভাসমান তুলা, দূষিত পানি, আর্দ্র মেঝে, আপরিচ্ছন্ন যৌথ টয়লেট, আলোর স্বল্পতা, ময়লা, অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস, অপুষ্টি, অনিরাপদ যৌনাভ্যাস, অতিরিক্ত কাজের চাপ, কম নড়াচড়া, একটানা দাঁড়িয়ে থাকা ইত্যাদি পেশাগত স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা উঠে এসেছে। মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা তো আছেই। অবস্থা কি একটুও পাল্টেছে? মালিকপক্ষ বলছে সরকারি বিধিমালা মানা হয়েছে, কর্মস্থল নিরাপদ; বিদেশি ক্রেতারা বলছে তাদের শর্ত মানা হয়েছে, শ্রমিকরা ঝুঁকিমুক্ত; সরকার বলছে তারা সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। কিন্তু আসলেই কি তাই? লক্ষ করে দেখবেন, কারখানাগুলোর প্রধান অফিসগুলো থাকে রাজধানীর সবচেয়ে অভিজাত এলাকার ভূমিকম্পসহনীয় আধুনিক সুউচ্চ ভবনে। আর কারখানাগুলো গড়ে ওঠে ঢাকার অদূরে, অবহেলিত জনপদে, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায়, ইমারত বিধিমালার তোয়াক্কা না করে গড়ে ওঠা ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে এবং যেখানে শ্রম খুব সস্তা। কারখানা আর প্রশাসনিক দপ্তর একই ভবনে স্থাপন করুন, তাহলেই না বোঝা যাবে যে মালিক-শ্রমিক-প্রশাসক, সবাই ঝুঁকিমুক্ত। আমরা ক্রমাগত মালিক-শ্রমিক শ্রেণী বিভাজনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে উঁচু স্তর থেকে একেবারে নিচু স্তর পর্যন্ত আমরা এমন প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি চালু করে রেখেছি, যেখানে অধীনস্ত কারো প্রতি ভালো ব্যবহার করাটাই অন্যায় আর ঊর্ধ্বতনদের প্রতি প্রভুসুলভ আচরণ করাটাই ন্যায়। একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি, কানাডায় আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট (বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য পদমর্যাদার) একদিন করিডরে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে। পরিচ্ছন্নতাকর্মী এসে খুব সাবলীল ভঙ্গিতে প্রেসিডেন্টকে, ‘এক্সকিউজ মি, উড ইউ প্লিজ লেট মি ক্লিন হিয়ার?’ বলে প্রকারান্তরে তাঁকে একটু সরে যেতে বললেন। প্রেসিডেন্ট শিওর, গো অ্যাহেড প্লিজ’ বলে মুচকি হাসি দিয়ে সরে গেলেন। অর্থাৎ ঊর্ধ্বতন-অধীনস্ত সম্পর্কটা ঠিক প্রভু-চাকরসুলভ নয়। যে যার কাজ নির্বিঘ্নে এবং সম্মানের সঙ্গে করে।
রানা প্লাজার দুর্ঘটনার দিন শ্রমিকদের বাধ্য করা হয়েছিল কাজে যোগ দিতে। এ বাধ্য করানোতে একযোগে ভূমিকা পালন করেছে কারখানার গার্ড থেকে শুরু করে সুপারভাইজার, ম্যানেজার, ভবন মালিক, ইউএনওসহ অনেকেই যা পরবর্তীকালে পত্রপত্রিকা মারফত এবং সাম্প্রতিক পুলিশের চার্জশিট থেকে আমরা জানতে পেরেছি। অগ্রিম বেতনের লোভ না দেখালে কিংবা জোরপূর্বক কারখানায় না ঢোকালে হয়তো সেদিন বেঁচে যেত অনেকের প্রাণ। রানা প্লাজার এই চিত্র এখনো কি প্রায় প্রতিটি পোশাক কারখানায় লক্ষণীয় নয়? এখনো কি শ্রমিকদের বাধ্য করা হয় না ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করতে? কারখানার ডিসিপ্লিন আর নিরবচ্ছিন্ন উৎপাদনের দোহাই দিয়ে এখনো কি প্রতিনিয়ত হেনস্তা করা হয় না পোশাককর্মীদের? এখানে মানবজীবনের অন্তর্মূল্য কিংবা মানবাধিকারের কথা ভুলে গিয়ে মুনাফা আর উৎপাদনের বিবেচনা স্থান পায় সর্বাগ্রে। উৎপাদনব্যবস্থা পরিণত হয় সভ্যযুগের দাসপ্রথায়, শ্রেণীবৈষম্য নামক নব্য বর্ণবাদে। অথচ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নারী পোশাককর্মীদের নিয়োগ দেওয়ার কারণ হিসেবে খোদ মালিকপক্ষই নারীদের নিয়মানুবর্তিতা, নমনীয়তা, দক্ষতা, মনোযোগ, যত্নশীলতা, সৃজনশীলতা, ধৈর্যশীলতা ইত্যাদি গুণগুলোর কথা বলে থাকে। হায় ঈশ্বর! যাদের এত গুণ তারা কিনা বিনিময়ে পাচ্ছে লাঞ্ছনা, বঞ্চনা, হয়রানি, কম মজুরি আর কঠোর বিধিনিষেধ! এ কেমন বিচার?
এই বিষয়গুলোকে আইনের মাধ্যমে নিরসন করা সম্ভব নয়। প্রয়োজন মালিক-শ্রমিক-ক্রেতা-সরকারের সচেতনতা আর যৌথ প্রচেষ্টা, প্রয়োজন একটি সামাজিক আন্দোলনের। শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে প্রতিকার পাওয়ার জন্য স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করুন। স্বাস্থ্যঝুঁকি ভাতা কিংবা মেডিকেল ইন্স্যুরেন্স প্ল্যান চালু করুন। শ্রমিকদের সমস্যা চিহ্নিত করতে গণতান্ত্রিকভাবে বিদেশি এজেন্টমুক্ত সচেতন শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন করুন। ক্রেতাদের শর্ত নয় বরং জীবনের মূল্য, মানবিকতা, টেকসই উন্নয়নকে বিবেচনায় আনুন।
‘In Time’ নামক একটা সিনেমা দেখেছিলাম কিছুদিন আগে। এ সিনেমায় বিনিময়ের মাধ্যম মুদ্রা নয় বরং সময়। ধরুন, একদিনের বাজার করতে আপনাকে ৩০ মিনিট সময় দোকানির ডিভাইসে ট্রান্সফার করে দিতে হবে। যার কাছে যতটুকু সময় আছে, সে ততটুকু সময় বাঁচবে। সিনেমায় দেখানো হয় যে যারা গরিব, অর্থাৎ যাদের সময় কম তারা সব সময় দৌড়াতে থাকে সময় বাঁচানোর তাগিদে। কোথাও তারা হেঁটে যায় না সময় নষ্ট হওয়ার জন্য। অপরদিকে নগরীর অন্যপ্রান্তের ধনী লোকগুলোর জীবনের গতি খুব মন্থর। তারা কথা বলে সময় নিয়ে, আহার করে সময় নিয়ে, কারণ তাদের হাতে অফুরন্ত সময়। খেয়াল করে দেখবেন, আমাদের বস্ত্রবালিকারা প্রতিনিয়ত দ্রুত পায়ে হাঁটে, কিংবা দৌড়ায়। কেন দৌড়ায় জানেন? ওরা না দৌড়ালে আমাদের অর্থনীতির চাকাটা ক্রমেই মন্থর হয়ে যাবে, প্রিয় মাতৃভূমিটা অন্ধকারেই থেকে যাবে। ওরা দৌড়ায় আমাদের স্বপ্নটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।
বিপ্লব কুমার হালদার : সহকারী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।