প্রিয় ফারজানা ম্যাডাম, এবার তবে যান...
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসটি আমার খুবই প্রিয়। এ কথা আগেও বলেছি, এমন সবুজে ঢাকা নিবিড় ক্যাম্পাস যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য বড় সম্পদ। উদার প্রকৃতি, ঘন সবুজ, শান্ত জলাধার শিক্ষার্থীদের উদার হতে শেখায়। হাজার মাইল দূর থেকে শীতের পাখিরা এই ক্যাম্পাসে এসে আস্তানা গাড়ে। আমি মাঝেমধ্যেই জাহাঙ্গীরনগর বেড়াতে যাই। তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে আমি চিনি প্রতিবাদী ও বিপ্লবী বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে। পান থেকে চুন খসলেই এখানকার ছাত্র-শিক্ষকরা মাঠে নেমে আসেন। এটা ভালো। অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে; দুজনই সমান অপরাধী। কোনো অন্যায়কেই প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়। সবকিছু ধরলে বাংলাদেশে সবকিছু অচল হয়ে যাবে। তবে জাহাঙ্গীরনগরে অনেক সময় পারসেপশনের ভিত্তিতেও আন্দোলন হয়। পরিসংখ্যান জানি না, তবে সাম্প্রতিক বেশ কয়েকজন ভিসিকে আন্দোলনের মুখে বিদায় নিতে হয়েছে। ন্যায্যতার প্রশ্নে যেকোনো আন্দোলনের পাশেই আছি, তবে পান থেকে চুন খসলেই আন্দোলনে নেমে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ, মানে জ্ঞানার্জন, গবেষণা বিঘ্নিত হয়।
বাংলাদেশে যেকোনো জায়গায় নিজ যোগ্যতায় নারীর ক্ষমতায়ন আমাকে অনুপ্রাণিত করে। অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের জাহাঙ্গীরনগরের ভিসি হওয়াটাও আমাকে দারুণ আনন্দ দিয়েছে। আর দায়িত্ব নিয়েই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের চেষ্টা করেন। নামে আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হলেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসন ব্যবস্থা অপ্রতুল। শিক্ষার্থীদের অনেকেই বাইরে থাকেন। যাঁরা হলে থাকেন, তাঁদের মধ্যে নতুনদের থাকতে হয় গণরুমে মানবেতরভাবে। এসব সমস্যা সমাধানে ফারজানা ইসলামের চেষ্টায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এক হাজার ৪৪৫ কোটি টাকার বরাদ্দ দেয় সরকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পক্ষের এটা উদযাপন করার কথা ছিল। কিন্তু অর্থই সব অনর্থের মূল। প্রথম খবর আসে, নতুন হল বানাতে গাছ কাটা হচ্ছে। অথচ গাছ না কেটে বা কম গাছ কেটেও নতুন হল বানানো সম্ভব ছিল। আন্দোলনের মুখে সেটা থামলেও এরপর ফাটে চাঁদাবাজির বোমা। ভিসি উন্নয়নকাজের অর্থ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতাদের এক কোটি ৬০ লাখ টাকা ঈদ সেলামি দিয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে। ভিসি এটা অস্বীকার করলেও জাহাঙ্গীরনগরের গাছ, লতাপাতাও এ অভিযোগের কথা জানে। কে কত টাকা পেয়েছে, সেটাও সবার মুখস্থ। ভিসির ঈদ সেলামির টাকা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আবু সুফিয়ান চঞ্চলকে ক্যাম্পাসে সেই থেকে আর প্রকাশ্য দেখা যায়নি। সভাপতি জুয়েল রানা এখন ছাত্রলীগ সামলাচ্ছেন। ভিসি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগকে টাকা দিয়েছেন শুনে খেপে যান কেন্দ্রীয় নেতারা। ছাত্রলীগের তখনকার সভাপতি শোভন ও সাধারণ সম্পাদক রাব্বানী অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের কাছে 'ফেয়ার শেয়ার' দাবি করেন। এই ফেয়ার শেয়ার হলো ৪ থেকে ৬ শতাংশ, টাকার অঙ্কে ৮৫ কোটি টাকা। এ অভিযোগ যায় প্রধানমন্ত্রীর কান পর্যন্ত। চাঁদাবাজির অভিযোগে পদচ্যুত হন ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে। একপর্যায়ে আন্দোলনের মূল দাবি হয় ভিসির পদত্যাগ। আন্দোলনে প্রায় আড়াই মাস ধরে বিশ্ববিদ্যালয় অচল।
উপাচার্য ছাত্রলীগ নেতাদের এক কোটি ৬০ লাখ টাকা সেলামি দিয়েছেন কি না, জানি না। তবুও যেহেতু অভিযোগ উঠেছে, সংগত ছিল একটা নিরপেক্ষ তদন্তের, দাবিও ছিল; কিন্তু সেটা হয়নি। হলে ভালো হতো। পারসেপশন হলো, ছাত্রলীগ নেতাদের ভিসি চাঁদা দিয়েছেন। পারসেপশন কখনো কখনো সত্যের চেয়েও ভয়ংকর। ফারজানা ইসলাম নিজেও একটি তদন্তের উদ্যোগ নিতে পারতেন। এমন গুরুতর অভিযোগের সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত আসলে তার পদে থাকা উচিত ছিল না।
তবে সেই অভিযোগের চেয়েও গুরুতর ঘটনা ঘটেছে গত মঙ্গলবার। ছাত্রলীগ হামলা চালায় আন্দোলনকারী ছাত্র-শিক্ষকদের ওপর। তাতে সাত শিক্ষকসহ ৩৫ জন আহত হয়েছেন। হামলা কতটা ভয়াবহ ছিল, তা নিয়ে আলাদা করে বলার দরকার নেই। সবাই টেলিভিশনে দেখেছেন। ছাত্রলীগের হামলার ঘটনা নিন্দনীয় হলেও বাংলাদেশের বাস্তবতায় প্রায় সাধারণ ঘটনা। এ তো নিছক হামলা। আর যিনি তাদের এক কোটি ৬০ লাখ টাকা সেলামি দেয়, তার বিপদে এগিয়ে আসা তো ছাত্রলীগের কর্তব্য, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। তবে হামলার পর উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম যা বলেছেন, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। তিনি ছাত্রলীগকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন, তাদের হামলাকে গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে তুলনা করেছেন। হামলার দিনটিকে তিনি অভিহিত করেছেন আনন্দের দিন হিসেবে। আন্দোলন যদি অন্যায্যও হয়, ভিসির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ যদি মিথ্যাও হয়; তবুও এ হামলা নিন্দনীয়। একজন ভিসি কিছুতেই কোনো ছাত্র সংগঠনকে ছাত্র-শিক্ষকদের ওপর হামলার নির্দেশ দিতে পারেন না। ভিসির উচিত ছিল, হামলাকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া। উল্টো তিনি বলছেন গণঅভ্যুত্থান। লজ্জায় মুখ লুকানোর জায়গাও থাকে না। ছাত্রলীগকে চাঁদা দিয়েছেন কি না, তা প্রমাণিত নয়। কিন্তু নিজের সহকর্মী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার দিনটিকে যার কাছে আনন্দের মনে হয়, তার আর উপাচার্য পদে থাকার নৈতিক কোনো অধিকার নেই।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।