পাকিস্তানে আগাম নির্বাচন কি আসন্ন?
পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের সাম্প্রতিক নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের জাতীয় রাজনীতি ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। গত ২৩ জুলাই পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রাদেশিক পরিষদের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচনের ভোট অনুষ্ঠিত হয়। এদিন ইমরান খান সমর্থিত মুসলিম লীগ-কায়েদ পার্টির প্রার্থী পারভেজ ইলাহী বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মুসলিম লীগ-নওয়াজের প্রার্থী হামজা শেহবাজের নিকট পরাজিত হন। শুরুতে পারভেজ ইলাহী ১৮৬ ভোট পেলেও পাঞ্জাব প্রাদেশিক পরিষদের ডেপুটি স্পিকার দোস্ত মোহাম্মদ মাজারী নির্বাচনি আইন ভঙ্গের অজুহাতে তাঁর ১০টি ভোট বাতিল করে দেন। ফলে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী হামজা শেহবাজ ১৭৯ ভোট নিয়েই এ যাত্রায় তাঁর গদি রক্ষা করতে সক্ষম হন। কিন্তু ইমরান সমর্থকগণ এ ফলাফল মেনে নেয়নি। তারা এটিকে পরাজয় না বলে শাসকদলের চৌর্যবৃত্তির ফল বলে দাবি করেছে।
সেদিন রাতেই ইমরান সমর্থকগণ সারা পাকিস্তানব্যাপী বিক্ষোভ করেন এবং ইমরান খান এক টুইট-বার্তায় বিষয়টি কোর্টে চ্যালেঞ্জ করবেন বলে জানিয়েছেন। এদিকে, গত সোমবার পাঞ্জাবে এক বাই-ইলেকশনে ইমরানের প্রার্থী জয়লাভ করেন। এ বিজয়কে ইমরান সমর্থগণ তেহরিক-ই ইনসাফ দলের প্রতি জনগণের ব্যাপক সমর্থনেরই বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করছেন। ফলে ইমরান খানের আগাম নির্বাচনের দাবি জোরালো হয়ে উঠেছে।
গত এপ্রিলে পার্লামেন্টে ইমরান খান বিরোধী দলের আনিত অনাস্থা ভোটে পরাজিত হয়ে ক্ষমতাচ্যুত হন। তাঁর বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে বিরোধী দলের পক্ষে শাহবাজ শরীফ অনাস্থা প্রস্তাব আনলে ইমরান খানের পরামর্শে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পার্লামেন্ট ভেঙে দেন। কিন্তু বিরোধী দল এ বিষয়টি কোর্টে চ্যালেঞ্জ করলে কোর্ট তা অবৈধ ঘোষণা করে এবং অনাস্থা ভোট অনুষ্ঠিত হয়। ফলে ইমরান খান পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৬৮-১৭৪ ভোটে পরাজিত হয়ে ক্ষমতাচ্যুত হন। পরে সাবেক তিন বারের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের ভাই বিরোধীদলীয় নেতা শাহবাজ শরীফ ক্ষমতাসীন হন।
ইমরান খান তাঁর এ ক্ষমতাচ্যুতিকে মার্কিনি ষড়যন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ বলে দাবি করেন। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক মেরুকরণের প্রেক্ষাপটে তিনি মাকিন অনুরোধ উপেক্ষা করে রুশ-চায়না বলয়ের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় মার্কিন ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন বলে তিনি দাবি করেন। কিন্তু মার্কিন কর্তৃপক্ষ ইমরানের এ অভিযোগের ‘সত্যতা নেই’ বলে মন্তব্য করেছে এবং ইমরান খানও তাঁর দাবির পক্ষে কোনও প্রমাণ হাজির করেননি। উল্লেখ্য, আঞ্চলিক রাজনীতিতে ভারতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় চীনের সাথে পাকিস্তান এক ঐতিহাসিক বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ।
জন্মলগ্ন থেকেই পাকিস্তানের রাজনীতিতে গোষ্ঠিতন্ত্রের প্রভাব সে দেশে গণতন্ত্র বিকাশের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হওয়ার পর রাষ্ট্রটি ৯ বছর সংবিধানবিহীনভাবে পরিচালিত হয়। ১৯৫৬ সালে একটি সংবিধান প্রণীত হলেও এ সাংবিধানিক শাসন বলবৎ ছিল মাত্র দুই বছর। এরপর আসে আইয়ুব খানের দশ বছরের সামরিক শাসন। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আইয়ুব খানের পতন হলেও পরবর্তী সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের সময় এই রাষ্ট্রটি এর নিজ জনগণের বিরুদ্ধেই একটি অসম যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ফলে এর পূর্ব অংশ স্বাধীন হয়ে যায়। বর্তমানে এ রাষ্ট্রটির আন্তঃপ্রাদেশিক সম্পর্কও এমন নাজুক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এ রাষ্ট্রটির ভবিষ্যৎ নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছেন। বর্তমানে রাষ্ট্রটির আর্থ-সামাজিক সূচকগুলো নিম্নগামী। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমতে কমতে গত জুলাই ২০২২-এ ৯.৮২ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে; যেখানে বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতির দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গত জুন, ২০২২-এর শেষে ছিল ৪১.৮ বিলিয়ন ডলার। পাকিস্তানের মুদ্রাস্ফীতিও বেড়েছে ব্যাপক হারে।
পাকিস্তানের অর্থনীতির এই যে দেউলিয়াত্ব, তার মূল কারণে হচ্ছে এর গোষ্ঠিতন্ত্র কখনও এই দেশের গণতন্ত্রকে স্বাবলম্বী হতে দেয়নি। পাকিস্তানের ৭৫ বছরের ইতিহাসে কোনও সরকারই মেয়াদ পূর্ণ করতে পারে নি। তার সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো ইমরান খানের পতন। এখন প্রশ্ন উঠেছে যে শাহবাজ শরীফ কি বর্তমান পালামেন্টের অবশিষ্ট সময় অর্থাৎ আগামী ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবেন, না কি ইমরান খানের দাবি অনুযায়ী আগাম নির্বাচন দিতে বাধ্য হবেন? পাকিস্তানের আর্থ-সামাজিক সূচকগুলো যে গতিতে নিম্নগামী হচ্ছে, তাতে বর্তমান সরকার কত দিন টিকে থাকতে পারবে, তা-ই প্রশ্নসাপেক্ষ। কেননা পাকিস্তানের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা অস্বস্তিতে রয়েছেন এবং পাকিস্তানের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট বিদেশি সহায়তা ছাড়া উত্তোরণের কোনও উপায় নেই। সুতরাং বর্তমানে পাকিস্তানে একটি স্থিতিশীল সরকার খুবই প্রয়োজন। কিন্তু ইমরান খানকে যেভাবে বিদায় নিতে হয়েছে, তাতে তিনি বর্তমান সরকারকে সহযোগিতা করবেন, এমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর প্রভাব সর্বজনবিদিত। আগাম নির্বাচন হবে কি হবে না তা নির্ভর করছে পাকিস্তানের সামরিক গোষ্ঠী আসলে কী ভাবছে তার ওপর। ইমরান খানের প্রতি বর্তমান সামরিক প্রধানের সমর্থন ছিল। সেজন্য তিনি পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে টিকে থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষের দিকে এসে ইমরান খানের সাথে বর্তমান সামরিক প্রধানের দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয় এবং এজন্য ইমরান খান টপ সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে বিভক্তি ঘটাতে সক্ষম হন এবং তাঁর পরিকল্পনার প্রতি সামরিক গোষ্ঠীর প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল বলেই প্রতিভাত হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানের আদালতের শক্ত অবস্থান এবং মার্কিন প্রভাব এবং বর্তমান সামরিক প্রধানের দ্বন্দ্বের কারণে ইমরান খান তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারেননি। সেজন্য গুজব বেরিয়েছিল যে ইমরান খান তাঁর শেষ কেবিনেট মিটিংয়ে বর্তমান সামরিক প্রধানকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তবে ইমরান খানের ওপর বর্তমান টপ সামরিক জেনারেলদের সমর্থন রয়েছে বলেই মনে হয়। এজন্য ইমরান খান চাচ্ছেন সরকারকে দ্রুত একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন দিতে বাধ্য করতে, যাতে বর্তমান সামরিক গোষ্ঠীর সহায়তায় তিনি পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারেন। কেননা দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বর্তমান সরকারকে ক্রমেই অজনপ্রিয় করে তুলছে, যা ইমরান খানের জন্য প্লাস পয়েন্ট বলেই মনে হচ্ছে। ফলে ইমরান খান ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন। পাঞ্জাবের গত সোমবারের বাই-ইলেকশনের ফলাফল সে ইঙ্গিত দেয়। পাকিস্তানের প্রভাবশালী দুটি প্রদেশ পাঞ্জাব ও খাইবার পাখতুয়ানে ইমরানের জনপ্রিয়তা ক্রমেই ঊর্ধ্বগামী।
অপরদিকে, বর্তমান সরকার চাচ্ছে যে কোনও মূল্যে মেয়াদ পূর্ণ করতে। কেননা আগামী নভেম্বরে বর্তমান সামরিক প্রধান জেনারেল বাজওয়ার মেয়াদ পূর্ণ হতে যাচ্ছে। উল্লেখ্য, ইমরান খান জেনারেল কুমার জাভেদ বাজওয়ার মেয়াদপূর্তির পর তিন বছরের জন্য তাঁর মেয়াদ বৃদ্ধি করেছিলেন। সম্প্রতি পাকিস্তানের সাংবাদিকেরা যখন প্রেসিডেন্ট ড. আরিফ আলভিকে প্রশ্ন করেন যে বর্তমান আর্মি চিফকে তাঁর মেয়াদ পূর্তির পূর্বেই সরিয়ে নতুন আর্মি চিফ নিয়োগ দেওয়া হবে কি না? তিনি প্রত্যুত্তরে বলেছেন, ‘আইডিয়াটা মন্দ নয়’। প্রেসিডেন্ট সাংবাদিকদের আরও বলেন যে, যদি আইনের মধ্যে থেকে এটি করার সুযোগ থাকে, তবে তাঁর এতে আপত্তি নেই।’
সুতরাং বোঝা যাচ্ছে বর্তমান সরকারও আগাম নির্বাচন দিতে আগ্রহী নয় এবং এজন্য প্রয়োজনে বর্তমান আর্মি চিফকে সরিয়ে নিজস্ব পছন্দের নতুন আর্মি চিফ নিযুক্ত করতে আগ্রহী, যাতে সামরিক গোষ্ঠীর ইমরান সমর্থিত অংশকে নিউট্রাল করে ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারে। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর ওপর মার্কিন প্রভাবও অপরিসীম এবং সম্ভবত আর্মি চিফ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে মার্কিন সমর্থনও রয়েছে। যদি তা-ই হয়, সে ক্ষেত্রে ইমরান খানের আগাম নির্বাচনের দাবি সরকার প্রত্যাখ্যান করে স্বাচ্ছন্দ্যে অবশিষ্ট মেয়াদে টিকে থাকতে পারবে। তবে পাকিস্তানের সামরিক গোষ্ঠীর মধ্যে বর্তমানে কী ধরনের মেরুকরণ হচ্ছে তা পরিষ্কার নয়। রাজনীতি যা-ই হোক না কেন, এই মেরুকরণ যে আগাম নির্বাচন হবে কি হবে না তাতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে, তাতে সন্দেহ নেই।
লেখক : সভাপতি ও সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়