ঈদ মোবারক
আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানি তাগিদ
সব দিন সমান যায় না। করোনাকালের মতো এতটা বৈরী পরিস্থিতি আমাদের সময়ে ইতোপূর্বে আর দেখিনি। এবারকার ঈদ উৎসব এক ভিন্নতর পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে এসেছে। জীবন চালিয়ে নেওয়ার পথে আনন্দ উৎসব মানুষের অনিবার্য অনুষঙ্গ। দেশজ আপন সংস্কৃতি কিংবা লোকাচার, ধর্মীয় রিচুয়াল কিংবা সামাজিক আচার প্রকৃতির আপন নিয়মেই এসব স্বজাত্যবোধকে জিইয়ে রেখে উত্তরসূরির কাছে মানুষ নিজেদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখে। অথচ এবার বৈশ্বিক মহামারিতে ধুঁকতে থাকা পৃথিবী তার রোজকার নিয়মনীতি পাল্টে দিয়েছে। আমাদের প্রাণের বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। কত মানুষ বেকার হয়েছে। কত মানুষ অকর্মণ্য হয়ে অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে গেছে, তার লিখিত বিবরণ নেই। এই চরম নিরানন্দের বেলায় কোথায়, কার, কীসের আনন্দ। অধ্যাত্মবাদের অচিন ও অসীম ইথারে কি আজ বাজবে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ঈদ উৎসবের সংগীত—
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানি তাগিদ।।
কে ভেবেছিল বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হবে না, কে ভেবেছিল ঈদ হবে নানা সীমাবদ্ধতার বেড়াজালে আটকে থেকে সীমিত আকারে। শিশুর গায়ে নতুন জামা উঠবে না। কে ভেবেছিল আনন্দ ভাগাভাগি করতে প্রিয়জনের সান্নিধ্যে মানুষজন যেমন খুশি ছুটে যেতে পারবে না।
আজ কারও উনুনে হয়তো আগুনও জ্বলবে না। দুমুঠো জীবনদায়ী অন্নের জন্য শূন্যে তাকিয়ে থাকবে হাজারও অপলক চোখ। এমন বাস্তবতায় ঈদ তার খুশি বিলাবে কীভাবে।
কাজী নজরুল ইসলামের ‘কৃষকের ঈদ’ যেন এবারের সত্যিকারে বাস্তবতা।
জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ
মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?
একটি বিন্দু দুধ নাহি পেয়ে যে খোকা মরিল তার
উঠেছে ঈদের চাঁদ হয়ে কি সে শিশু-পাঁজরের হাড়?
আসমান-জোড়া কালো কাফনের আবরণ যেন টুটে
এক ফালি চাঁদ ফুটে আছে, মৃত শিশুর অধর-পুটে।
কৃষকের ঈদ! ঈদগাহে চলে জানাজা পড়িতে তার,
যত তকবির শোনে, বুকে তার তত ওঠে হাহাকার!
তবু বাঙালি যাপিত জীবনে রমজানের এক মাস সিয়াম সাধনা শেষে আজ পবিত্র ঈদ। ঈদ মোবারক। হাজার দুঃখের মাঝেও সবার জীবন মঙ্গলময় হোক।
মেডিকেল হিস্ট্রি থেকে জানা যাচ্ছে, পৃথিবীতে করোনার আগেও ভয়ঙ্কর মহামারি এসেছে বারবার। সেখান থেকে জয়ী হয়ে পৃথিবীর মানুষ গৌরবে তার সংগ্রামমুখর জীবনের শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখতে পেরেছে বলেই এখনো তার অস্তিত্ব টিকে আছে। এবারও বিশ্বব্যাপী মানুষ অদৃশ্য এক শক্তির বিরুদ্ধে ভয়াল যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। অচল মানুষ ঘরে বসে প্রহর গুণছে কবে আবার তাদের প্রাণোচ্ছল স্বাধীনতা ফিরে পাবে।
প্রায় ১০ হাজার বছর আগে মানুষ কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে থিতু হওয়ার পর থেকেই মহামারির মোকাবিলা করে আসছে। ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, কুষ্ঠ, ইনফ্লুয়েঞ্জা, গুটিবসন্ত প্রভৃতি সংক্রামক রোগ নানা সময়ে মহামারির আকার নিয়েছে। মানবসভ্যতা যত উন্নত হয়েছে, মহামারির প্রাবল্য তত বেড়েছে। জনসংখ্যার আধিক্য, অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়ন নিয়ে আমরা যেমন রোগ সংক্রমণের মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে আছি। জাতি হিসেবে আমাদের সমন্বিত অসচেতনতা ও অসতর্কতাও এই ঝুঁকিকে বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণে।
তার ওপর এবার ঈদের আগে দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের বিপুল জনগোষ্ঠী আম্পানের মতো ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ায় বিপর্যয় সীমা ছাড়িয়েছে। কৃষিভিত্তিক জীবিকা বিনষ্ট হয়ে পথে বসেছে লাখো মানুষ। একদিকে ক্রমবর্ধমান করোনাভাইরাসের উপদ্রব, আবার ঝড়ের তাণ্ডব। দুর্ভাগ্যের একা না আসার এমন ধনুর্ভঙ্গ পণের নামই বুঝি মানবজীবন।
তবু আমাদের একটা সুন্দরবন ছিল। দুর্যোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের গতি ৭০ কিলোমিটার কমিয়েছে সুন্দরবন। এর জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতাও তিন থেকে চার ফুট কমিয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শ্বাসমূলীয় বনটি। আমরা মানুষ অন্তঃপ্রাণ এমন প্রকৃতিকে যত্ন করলেই হয়তো প্রকৃতি শত প্রতিকূলতা পেছনে ঠেলে আমাদের দিকে মুখ ফেরাবে।
এসব প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে নিজেদের সামলাতে হবে। অনাগত ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত করতে আমাদের সবাইকে যূথবদ্ধ হয়ে সব অশুভ শক্তির সঙ্গে পাল্লা দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে আমরা যেন নিজেদের ভুলে নিজেরাই অতল নিমজ্জনে না হারিয়ে যাই। আমরা যেন রাষ্ট্রীয় বিধিবিধান মেনে চলি। আজকে ঈদের দিনের কোলাকুলি, গলাগলি, মেহমানদারি সামনের সুন্দর সময়ের জন্য তুলে রাখি। ঈদ হোক শুধু আনন্দের, আতিশয্য না হোক। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুরক্ষা দিতে এর অন্য কোনো বিকল্প নাই।
খেয়াল রাখতে হবে আমরা মহান একাত্তরের বীরের জাতি, এখনো একটা যুদ্ধাবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। প্রতিদিনই সংক্রমণ বাড়ছে, দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। নিয়ম মানাটাই এখন আমাদের সর্বসাধারণের আসল যুদ্ধ।
আমাদের এই যূথচারী মহাযুদ্ধে অনুপ্রেরণা কারা? এই সময় যে মানুষেরা জীবনবাজি রেখে নিঃশঙ্ক চিত্তে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। পুলিশ, চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ, সমাজহিতৈষী ব্যক্তিবর্গ কিংবা মৃতের দাফনে সহায়তা করা একজন স্বেচ্ছাসেবী—এরা সবাই এ সময় আমাদের আইকন। তারাই মানবতাবাদের আলোকবর্তিকা। তাদের জন্য অতল শ্রদ্ধা ও অফুরান ভালোবাসা।
এখন আর হিংসা নয়, ঘৃণা নয়, কেবল ভালোবাসার কাল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাস্থ্যবিধি শারীরিক বা সামাজিক দূরত্ব আমরা মেনে চলব; পাশাপাশি আত্মিক দূরত্ব ঘুচিয়ে দিয়ে আমাদের সবার বন্ধনটাও অবিচ্ছেদ্য রাখব। মহান ঈশ্বর নিশ্চিতই আমাদের পথ দেখাবেন।
কবিগুরু রবিঠাকুরের ‘প্রশ্ন’ আমাদের অন্তরেও ঔদার্যের বীণা হয়ে বাজুক।
ভগবান, তুমি যুগে যুগে দূত, পাঠায়েছ বারে বারে
দয়াহীন সংসারে,
তারা বলে গেল : ক্ষমা করো সবে, বলে গেল ‘ভালোবাসো—
অন্তর হতে বিদ্বেষবিষ নাশো’।
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন