ফাগুন হত্যা
অন্য ফাগুনদের নিরাপদে রাখতে চাই
আমার অল্পবিস্তর যা লেখালেখি আছে, তা কখনও কোনোদিন লজিকের বাইরে যায়নি। আমার সন্তান, আমার অস্তিত্বকে হারিয়েছি। আমার বাচ্চাটাকে খুন করা হয়েছে। অথচ আমি হত্যাকারীদের ক্রসফায়ার চাইতে পারতাম। কিন্তু তার পরেও আমি লজিকের বাইরে যাইনি। আমি চেয়েছি বিচারের প্রতিষ্ঠা। আমি বরাবর বলেছি বিচারিক বিষয়টি দৃষ্টান্ত। আর ক্রসফায়ার ফানুসের মতো হঠাৎ জ্বলে ওঠে এবং হারিয়ে যায়। কিন্তু বিচারটা মানুষের মনে থেকে যায়। আমি যখন ছোট, তখন রীমা হত্যা মামলায় মনিরের ফাঁসি হয়েছিল, এখনও মনে আছে। আর সেই রীমা ছিলেন সাংবাদিকের মেয়ে।
জানি অনেকে বলবেন, সে সময়ের সাথে এ সময়ের মিল নেই। মিল নেই বলেই আমার লড়াইটা আরও জোরালো। ওই সময়কে আমি এই সময়ের কাছে আনতে চাই। আমি আমার অন্য ফাগুনদের নিরাপদ করতে চাই। সে জন্যই ফাগুন হত্যার বিচার হওয়া প্রয়োজন।
বিচারিক কাজে, তদন্তের কাজে আমি পদে পদে বাধার মুখোমুখি হয়েছি। দুই বছরের বেশি হয়ে গেল, কিন্তু জানা যায়নি ফাগুন হত্যার পেছনে কারা। চেষ্টা হয়েছে এই হত্যাকে স্রেফ একটা ছিনতাইয়ের ঘটনা বলে চালিয়ে দিতে।
যে অভিযুক্ত স্বীকারোক্তি দিয়েছে, তাকে ফাগুন হত্যা মামলায় রিমান্ডে পায়নি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তাকে অন্য বিচারকের কাছ থেকে অন্য আরেকটি চুরি মামলায় রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। আর সেই জিজ্ঞাসাবাদেই সে ফাগুন হত্যার কথা স্বীকার করেছে। বলেছে, পাঁচ জনের একটি দল ফাগুনকে টার্গেট করেছিল। ফাগুন রেজা, একজন তরুণ প্রতিভাবান ও প্রতিশ্রুতিশীল সাংবাদিক। একটা গণমাধ্যমে ইংরেজি বিভাগের সাব এডিটর ছিল সে। ২০১৯ সালের ২১ মে বিকেলে নিখোঁজ হয় ফাগুন। তার লাশ পাওয়া যায় রাতে জামালপুর থেকে কিছুটা দূরে নান্দিনায় রেললাইনের ধারে।
ফাগুন রেজা হত্যাকাণ্ড যথেষ্ট আলোচিত ছিল। আর গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে আলোচনায় না থাকারও কথা নয়। দেশের প্রতিটা গণমাধ্যমে এই হত্যাকাণ্ডের খবর প্রকাশিত হয়েছে সে সময়। বিদেশি গণমাধ্যমও খবর করেছে ফাগুনকে নিয়ে। এখনও সে হত্যাকাণ্ড বিস্মৃত হয়নি অনেক গণমাধ্যমই। তাই ফাগুন হত্যাকাণ্ড বিষয়ে যেকোনো খবর প্রকাশিত হয় আজও গণমাধ্যমগুলোতে। সম্প্রতি এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে পিবিআইয়ের প্রেস ব্রিফিংয়ের খবর গুরুত্বের সাথেই প্রকাশ করেছে দেশের মূলধারার গণমাধ্যম।
আমি আইনে বিশ্বাস রেখেছি। ক্রসফায়ারের দাবি জানাইনি। চাইনি নিজে বা অন্য কেউ আইনের বাইরে গিয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের দায় নিক। আমি জানি, আইন ও তদন্ত যদি সঠিক রাস্তায় চলে, তাহলে হয়তো আদালতেই খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে। ক্রসফায়ারের নামে ক্ষণিকের আত্মতৃপ্তি নয়, বিচারিক দণ্ডের দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে সে শাস্তি। অন্য ফাগুনেরা নিরাপদ হবে খানিকটা হলেও।
ফাগুন চলে যাওয়ার পর গত দুই বছর রাতে ঘুমাইনি। প্রতিদিন ভোরের আজান শুনেছি আমি। প্রতিদিন আমার বালিশ ভিজেছে চোখের পানিতে। ঘুমের ওষুধ কাজ করেনি। মাঝেমধ্যে মনে হয়েছে, এখনও হয়, ছুটে বেড়িয়ে যাই। সব ভেঙেচুরে এক করে ফেলি। আমি নিজেকে ধরে রেখেছি। প্রতিদিন নিজের সাথে আমার যুদ্ধ করতে হচ্ছে, তার পরেও লজিকের বাইরে যাইনি আমি। ধৈর্য ধরে আছি। কেন আছি, এমন প্রশ্নের উত্তর হলো অন্য ফাগুনদের বেঁচে থাকা নিশ্চিত করার আশায়।
জানি, এখনও অনেকে বলবেন, এই সময়ে এমন লজিক আমার ভুল। সাগর-রুনির কথা বলবেন। তনুর কথা বলবেন। আরও অনেক উদাহরণ তুলে ধরবেন। একজন সাংবাদিক হিসেবে, আজীবন সাংবাদিকতার শিক্ষার্থী হিসেবে এসব উদাহরণ আমার জানা। অনেক ভিকটিমের নামও মুখস্থ। আমি জানি আমাদের দেশের অবস্থা। আমি জানি কীভাবে কী হয়। আমি জানি কারা কতটা ক্ষমতাধর। কার দৌড় কতটুকু। এসব জেনেও আমি আশা করে আছি। চেষ্টা করে যাচ্ছি একটা দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠার জন্য।
আমি এও জানি, গত পাঁচ বছরে সারা দেশের রেললাইনের পাশে বেশ কিছু লাশ পাওয়া গেছে। যেমন পাওয়া গিয়েছিল ফাগুনের, ফাগুন রেজার। ফাগুন রেজার মতো এসবের বেশির ভাগ ঘটনাই ছিল খুনের। কিন্তু দায়ের হয়েছে অপমৃত্যুর মামলা। ট্রেন দুর্ঘটনা বলে ফাইল ক্লোজ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। কেউ আর লেগে থাকেনি, ঘাটায়নি। ফলে রেলপথ হয়ে উঠেছে অপরাধীদের নিরাপদ রুট। কেউ যদি ট্রেনে যাতায়াত করেন এবং তাকে যদি হত্যার জন্য টার্গেট করা হয়, তাহলে যেকোনো পেশাদার গ্রুপকে দিয়ে সহজেই তা করানো যায়। যেহেতু সবাই জানে ঘটনাটা শেষে গিয়ে দাঁড়াবে অপমৃত্যুতে। অথবা খুব বেশি কিছু হলে কাগজ বা কোনো মাধ্যমে প্রকাশ হবে সম্ভাব্য ছিনতাইয়ের ঘটনা হিসেবে। আর রেলওয়ে থানায় সেটা থাকবে অপমৃত্যুর খাতাতেই। একসময় সেই খাতায় জমবে ধুলো আর ফাইল ক্লোজড।
দীর্ঘদিন পর আমি এমন স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি। আমার কিছু বন্ধুবান্ধব আছেন, যাঁদের কেউ কেউ পুলিশের উঁচু পদে। তাঁরাও আমাকে সাহায্য করেছেন, না হলে এত দূর আসতে পারতাম না। বিপরীতে কেউ কেউ বলেছেন, কী করবেন, যা হওয়ার হয়েছে। ছেলে ট্রেনে আসতে গেল কেন। সেই ভিকটিম ব্লেইমিং। কী আশ্চর্য, স্বাধীন দেশে ঈদের সামনে এই ভিড়ে একটা ছেলে ট্রেনে আসবে। সেই ট্রেনে তাকে হত্যা করা হবে এবং ফেলে দেওয়া হবে, এটা কি ভাবা সম্ভব? বলা হবে অন্ধকার রাস্তায় গেল কেন, ছোট কাপড় পরল কেন।
ফাগুন হত্যাকাণ্ড কেবল ট্র্যাকে এসেছে। আরও অনেক দূর যেতে হবে। ফাগুনের সাথে থাকা ল্যাপটপ উদ্ধার হয়নি। এর আগেও ঢাকার বাসা থেকে ফাগুনের আরেকটি ল্যাপটপ চুরি হয়েছে। সেই চুরিও রহস্যাবৃত। এবারের ল্যাপটপও খুনিরা বিক্রি করেনি। যা অভিযুক্ত তার স্বীকারোক্তিতে বলেছে। তাদের লিডার নাকি বলেছে, ওই ল্যাপটপের কাজ রয়েছে। তাই বিক্রি করা যাবে না। পরে বিক্রি করলে টাকার ভাগ দেওয়া হবে। শেষ পর্যন্ত সেই ল্যাপটপ বিক্রির টাকার ভাগ পায়নি সেই স্বীকারোক্তি দেওয়া অভিযুক্ত। সুতরাং ফাগুনকে যে অনেক আগে থেকেই ট্র্যাক করা হচ্ছিল, তা পরিষ্কার বোঝা যায়। এটা শুধু একটা বিষয়। এমন আরও অন্তত গোটা দশেক বিষয় রয়েছে যা থেকে ধারণা করা যায় এই হত্যাকাণ্ড পরিকল্পিত। তদন্ত চলাকালীন যা না বলাই ভালো।
পদে পদে বাধার কথা বলছি, আসছি আমাদের নিজেদের নৈতিকতার কথাতেও। ফাগুনকে নিয়ে আমার লেখাগুলো বেশ কিছু গণমাধ্যম প্রকাশ করেছে। কোনো কোনো গণমাধ্যম থেকে বলা হয়েছে, প্রকাশিত লেখা নয়, নতুন লেখা দেওয়ার জন্য। অন্তত একটা গণমাধ্যমের উদাহরণ দিতে পারি। একদিন ফোন পেলাম সেই গণমাধ্যম থেকে। বলল, আপনার লেখাগুলো পড়ছে মানুষ। আর আপনার সব লেখাই পড়ে। ফাগুনকে নিয়ে আপনার একটা লেখা চাই আমরা। বললাম দেব। কিন্তু তাদের আবদার হলো, ফাগুন হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি খুব আবেগ দিয়ে লিখতে হবে এবং অন্য কিছু না বলে শুধু ফাগুন হত্যাকাণ্ডের বিচার চাওয়ার বিষয়টি থাকবে সে লেখায়।
তাদের বলেছিলাম, সে ধরনের আবেদন করলে তো আমি ক্রসফায়ারই চাইতে পারতাম; আইনের মাধ্যমে শাস্তি চাচ্ছি কেন। আমি জানি, আমার ফাগুন ফিরে আসবে না। আমার লড়াই সব ফাগুনদের জন্য। অন্য ফাগুনরা যেন বেঁচে থাকে। বাবা-মায়ের বুকজুড়ে থাকে। ফলে আমি সব কথা লিখি, সবার কথা লিখি। বুকে পাথর বেঁধে, অশ্রু ভেজা ঝাপসা চোখে লজিক দিয়ে লিখি। এখনও আমি লজিকে বিশ্বাস করি, আইনে বিশ্বাস করি, ন্যায়বিচারের আশা করি। হতে পারে এ আশা পূরণ হবে না কিংবা হবে। না হলেও ক্ষতি কি খুব বেশি বাড়বে? অন্তত আমার চেষ্টাটা তো থেকে যাবে। হয়তো আরেক জন এতে সাহস পাবে, রুখে দাঁড়াবে এমন নির্মমতার বিরুদ্ধে। একদিন নিশ্চয়ই এমন চেষ্টা সফল হবে। আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত দেশ ফিরে পাব।
লেখক : সাংবাদিক, কলাম লেখক ও নিহত সাংবাদিক ফাগুন রেজার বাবা