বুয়েটে সন্ধ্যায় মোমবাতি প্রজ্বালন, ভর্তি পরীক্ষা বন্ধের দাবি
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদের হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতসহ ১০ দফা দাবি ঘোষণা করেছে আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীরা। খুনিদের আজীবনের জন্য বহিষ্কার, হল প্রভোস্টের পদত্যাগসহ অন্যান্য দাবি আদায়ে আগামী ১১ অক্টোবর পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে তারা। এই সময়ের মধ্যে বুয়েটের সব একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ রাখার জন্য কর্তৃপক্ষের প্রতিও আহ্বান জানিয়েছে শিক্ষার্থীরা।
আজ বুধবার সকাল ১১টার দিকে বুয়েট ক্যাম্পাসের শহীদ মিনারে এই ঘোষণা দেওয়া হয়। এ সময় এই নির্মম হত্যার প্রতিবাদে কর্মসূচিও দেওয়া হয়। আবরার ফাহাদের হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে সকাল থেকে শহীদ মিনারে অবস্থান নিয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ১০ দফা দাবি ঘোষণার পর মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে তারা।
কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজ বুধবার সন্ধ্যায় ক্যাম্পাসে মোমবাতি প্রজ্বালন কর্মসূচি ঘোষণা করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ঘোষণা পাঠ করেন বুয়েট শিক্ষার্থী আলী আম্মার। এ সময় দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরও আবরার হত্যার প্রতিবাদে এবং বুয়েটের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে নিজ নিজ ক্যাম্পাসে এই কর্মসূচি পালনের আহ্বান জানান আন্দোলনকারীরা।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবির মধ্যে বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবিটিও রয়েছে বলে পরে এনটিভি অনলাইনকে জানিয়েছেন আলী আম্মার। তিনি বলেন, ’১০ দফার ছয় নম্বরে এই দাবিটি রয়েছে। এ ব্যাপারে আগামী সাত দিন অর্থাৎ ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত কর্তৃপক্ষকে আলটিমেটাম দেওয়া হয়েছে। ১৪ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। আমরা এই সময়ের মধ্যে দাবি না মানলে ভর্তি পরীক্ষা বন্ধ রাখার জন্যও কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি।’
সাধারণ শিক্ষার্থীদের ১০ দফা দাবি হলো-
‘১. খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সিসিটিভি ফুটেজ ও জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে শনাক্তকারী খুনিদের প্রত্যেকের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
২. বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সিসিটিভি ফুটেজ থেকে শনাক্ত করা সবাইকে ১১ অক্টোবর, ২০১৯ বিকেল পাঁচটার মধ্যে আজীবন বহিষ্কার নিশ্চিত করতে হবে।
৩. মামলা চলাকালে সব খরচ এবং আবরারের পরিবারের সব ক্ষতিপূরণ বুয়েট প্রশাসনকে বহন করতে হবে। এ মর্মে অফিশিয়াল নোটিশ ১১ তারিখ পাঁচটার মধ্যে প্রদান করতে হবে।
৪. দায়েরকৃত মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের অধীনে স্বল্পতম সময়ে নিষ্পত্তি করতে বুয়েট প্রশাসনকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। বুয়েট প্রশাসনকে সক্রিয় থেকে সব প্রক্রিয়া নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং নিয়মিত ছাত্রদের আপডেট করতে হবে।
৫. অবিলম্বে চার্জশিটের কপিসহ অফিশিয়াল নোটিশ দিতে হবে।
৬. বুয়েটে সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। রাজনৈতিক সংগঠনের ব্যানারে দীর্ঘদিন ধরে বুয়েট হলে হলে ত্রাসের রাজনীতি কায়েম করে রাখা হয়েছে। জুনিয়র মোস্ট ব্যাচকে সব সময় ভয়ভীতি প্রদর্শনপূর্বক জোর করে রাজনৈতিক মিটিং–মিছিলে যুক্ত করা হয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে যেকোনো সময় যেকোনো হল থেকে সাধারণ ছাত্রদের জোর প্রদর্শনপূর্বক হল থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে হলে হলে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। রাজনৈতিক সংগঠনের এমন কর্মকাণ্ডে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ। তাই আগামী ৭ দিনের মধ্যে (১৫ অক্টোবর) বুয়েটে সব রাজনৈতিক সংগঠন এবং এর কার্যক্রম স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে।
৭. বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কেন ৩০ ঘণ্টা অতিবাহিত হওয়ার পরও ঘটনাস্থলে উপস্থিত হননি এবং ৩৮ ঘণ্টা পরে উপস্থিত হয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিরূপ আচরণ করেন এবং কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে স্থান ত্যাগ করেন। তাঁকে সশরীরে ক্যাম্পাসে এসে আজ বেলা দুইটার মধ্যে জবাবদিহি করতে হবে।
৮. আবাসিক হলগুলোতে র্যাগের নামে ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর সব ধরনের শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন বন্ধে করতে হবে এবং এ ধরনের সন্ত্রাসে জড়িত সবার ছাত্রত্ব প্রশাসনকে বাতিল করতে হবে। একই সঙ্গে আহসানউল্লা হল এবং সোহরাওয়ার্দী হলের পূর্বের ঘটনাগুলোতে জড়িত সবার ছাত্রত্ব বাতিল ১১ অক্টোবর, ২০১৯ তারিখ বিকেল পাঁচটার মধ্যে নিশ্চিত করতে হবে।
৯. পূর্বের ঘটনা এ ধরনের ঘটনা প্রকাশ এবং পরবর্তী সময়ে ঘটা যেকোনো ঘটনা প্রকাশের জন্য একটা কমন প্ল্যাটফর্ম, কোনো সাইট বা ফর্ম থাকতে হবে এবং নিয়মিত প্রকাশিত ঘটনা রিভিউ করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচারের ব্যবস্থা নিতে হবে। এই প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বুয়েটের বিআইআইএস অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করতে হবে এবং ১১ অক্টোবর, ২০১৯ তারিখ বিকেল পাঁচটার মধ্যে দৃশ্যমান অগ্রগতি প্রদর্শন করতে হবে। পরবর্তী ১ তারিখের মধ্যে কার্যক্রম পূর্ণরূপে শুরু করতে হবে। নিরাপত্তার স্বার্থে সব হলের প্রত্যেক ফ্লোরে উইংয়ের দুপাশে সিসিটিভি ক্যামেরার ব্যবস্থা করতে হবে।
১০. রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে আবাসিক হল থেকে ছাত্র উৎখাতের ব্যাপারে অজ্ঞ থাকা এবং ছাত্রদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হওয়ায় শেরেবাংলা হলের প্রভোস্টকে ১১ অক্টোবর, ২০১৯ তারিখ বিকেল পাঁচটার মধ্যে প্রত্যাহার করতে হবে।’
গত রোববার রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে আবরার ফাহাদকে তাঁর কক্ষ থেকে ডেকে নিয়ে মারধর করেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। গভীর রাতে হলের সিঁড়িতে তাঁর লাশ পাওয়া যায়। ঘটনার পরদিন সোমবার চকবাজার থানায় হত্যা মামলা করেন আবরার ফাহাদের বাবা। মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলায়।
এদিকে আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় এ পর্যন্ত মোট ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগকে দেওয়া হয়েছে।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল, সহ-সভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদ, সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার, ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, সাহিত্য সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনির, উপ-সমাজকল্যাণ সম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকাল, উপদপ্তর সম্পাদক মুজতবা রাফিদ, দুই সদস্য মুনতাসির আল জেমি ও এহতেসামুল রাব্বি তানিম এবং শামসুল আরেফিন রাফাত, মনিরুজ্জামান মনির ও মো. আকাশ হোসেন।