বহিরাগতদের ‘উৎপাতে অতিষ্ঠ’ রাবি শিক্ষার্থীরা
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) বহিরাগতদের উৎপাতে এখন সাধারণ শিক্ষার্থীরা অতিষ্ঠ বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। একই সঙ্গে খেলার মাঠ নিয়ে শিক্ষার্থীদের মারধর, হুমকি-ধমকি, ক্যাম্পাসে চুরি-ছিনতাই, ছাত্রী উত্ত্যক্ত, মাদক ব্যবসা, বেপরোয়া গতিতে ক্যাম্পাসে মোটরসাইকেল চালানোরও অভিযোগ উঠেছে বহিরাগতদের বিরুদ্ধে।
শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের ছত্রছায়ায় বহিরাগতরা এসব কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নমনীয় অবস্থানের কারণে নিজ ক্যাম্পাসে স্থানীয় বখাটেদের কাছে শিক্ষার্থীরা জিম্মি হয়ে পড়েছেন।
একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন কাজলা, মেহেরচণ্ডী, বিনোদপুর, বুধপাড়া ও পাশের এলাকা থেকে বহিরাগতরা হরহামেশাই ঢুকছে ক্যাম্পাসে। ফলে ক্যাম্পাসের টুকিটাকি চত্বর, পরিবহন মার্কেট, মিডিয়া চত্বর, পুরাতন ফোকলোর চত্বর ও আমতলাসহ প্রতিটি খেলার মাঠ থাকে অবস্থান নিচ্ছে বহিরাগতরা। ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের সবচেয়ে বড় ‘উৎপাত’ বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালানো। এতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, দ্রুতগতিতে মোটরসাইকেল হাঁকিয়ে ছাত্রী উত্ত্যক্ত করা বখাটেদের রুটিনমাফিক কাজে পরিণত হয়েছে। আর এসবের প্রতিবাদ করলে বখাটেদের হাতে মারধরের শিকার হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী, ছাত্রলীগ ও গোয়েন্দা সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ক্যাম্পাসের প্যারিস রোড, ইবলিস চত্বর, জুবেরি মাঠ, চারুকলাসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় ছিনতাইয়ের শিকার হন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ঘুরতে আসা লোকজন এমন ঘটনার শিকার হন বেশি। গত ৩০ এপ্রিল রাবিতে বেড়াতে এসে ছিনতাইয়ের কবলে পড়েন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী। এ ছাড়া গত এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ১৫টি চুরি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। এসবের মূলে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের ছত্রছায়ায় স্থানীয় বখাটেরা জড়িত। কিছু ক্ষমতাসীন নেতার নাম ব্যবহার করে কাজলা, মেহেরচণ্ডী, বিনোদপুর, বুধপাড়া এলাকার বখাটেরা ক্যাম্পাসে ঢুকে এসব ছিনতাই করছে অহরহ। এ নিয়ে বেশ কয়েকবার গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলেও টনক নড়েনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৩ হাজার শিক্ষক-শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা নিয়ে ভাবার যেন কেউ নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের ছাত্র আবদুল্লাহ মো. সায়েম বলেন, ‘আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হয়েও বহিরাগতদের উৎপাতে ক্যাম্পাসে নিরাপদভাবে চলতে পারি না। খেলার মাঠে খেলতে গেলে তাদের সঙ্গে আমাদের প্রায় দ্বন্দ্ব হয়। কিছু বলতে গেলে দেখে নেওয়ার হুমকি দেয়। আর এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে অনেকবার বলার পরেও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক ছাত্র বাপ্পী বলেন, ‘কাম্পাসে বহিরাগতদের অনিয়ন্ত্রিত চলাফেরায় প্রায়ই আমাদের বিভিন্ন সমস্যার ফেলে। ক্যাম্পাসে যে চুরি-ছিনতাইগুলো হয়, তার অধিকাংশের সঙ্গে বহিরাগতরা জড়িত। এ ছাড়া দিনের বেলা এবং সন্ধ্যায় তারা ক্যাম্পাসে দ্রুতগতিতে মোটরসাইকেল চালায়। আমরা বিভিন্ন জায়গায় গ্রুপ স্টাডি করি। তাদের এ অনিয়ন্ত্রিত মোটরসাইকেল চালানোর ফলে প্রায়ই আমাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করে। এতে করে ক্যাম্পাসে আমাদের স্বাভাবিক চলাফেরায় বিঘ্ন ঘটে।’
ওই ছাত্র আরো বলেন, ‘আমাদের হলগুলোর সামনে প্রায়ই দল বেঁধে বহিরাগতদের ঘুরতে দেখা যায়। বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত তারা হলগুলোর সামনে গিয়ে জোরে মোটরসাইকেল চালায় এবং ঘন ঘন হর্ন দিতে থাকে। এ ছাড়া সন্ধ্যার পর ক্যাম্পাসে চলতে গেলে তারা দূর থেকে আজেবাজে মন্তব্য করে। প্রতিবাদ করতে গেলে উল্টো লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়।’
রাবি শাখা কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি আবদুল মজিদ অন্তর বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগতরা ছিনতাই, যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ সংগঠিত করছে। শিক্ষার্থীরা সন্ধ্যার পর ক্যাম্পাসে ঘোরাফেরা করতে পারছে না। সবার মধ্যে একটা আতঙ্ক বিরাজ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগতদের প্রবেশের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য আমরা প্রক্টরকে জানিয়েছি। তিনি (প্রক্টর) বলেছেন, এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোনো ধরনের উদ্যোগ নিয়েছেন বলে আমাদের চোখে পড়ছে না।’
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক মলয় কুমার ভৌমিক বলেন, ‘বহিরাগতদের অবাধে প্রবেশের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে যে নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে, সেটি ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। এগুলো অবিলম্বে বন্ধ করা দরকার, তা না হলে বিশ্ববিদ্যালয় আর বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে না।’
মলয় কুমার ভৌমিক আরো বলেন, ‘প্রভাবশালী লোকের আশকারা পেয়ে তারা ক্যাম্পাসে অসামাজিক কর্মকাণ্ড করছে। শুধু বহিরাগতরা নয়, ক্যাম্পাসের কিছু শিক্ষার্থীও এসবের সঙ্গে জড়িত। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সচেতনতার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সচেতনতা দরকার। এ ব্যাপারে যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সচেতন না হয়, তাহলে পুলিশ বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এটি বন্ধ করতে পারবে না।’
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. লুৎফর রহমান বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে বেশ কয়েকবার ক্যাম্পাসে অভিযান চালিয়েছি। শিগগির আবারও অভিযান চালানো হবে। এরপরও যদি তারা ক্যাম্পাসে অস্থিতিকর পরিস্থিতি তৈরি করার চেষ্টা করে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’