চট্টগ্রাম বন্দরে ৪৮ বছরের মধ্যে আমদানি-রপ্তানিতে রেকর্ড

চট্টগ্রাম বন্দর আমদানি-রপ্তানি খাতে সর্বোচ্চ পরিমাণ পণ্য জাহাজে ওঠানামার রেকর্ড করেছে, যা বিগত ৪৮ বছরের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি খাতে সর্বোচ্চ। আজ বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) দুপুরে বন্দর ভবনের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপের সময় এ তথ্য জানান বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান।
বন্দরের চেয়ারম্যান জানান, বন্দরের গতিশীলতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বন্দরে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে এর সম্প্রসারণ এখন সময়ের দাবি বলেও জানান তিনি।
বন্দর চেয়ারম্যান এস এম মনিরুজ্জামান বলেন, দেশের আমদানি-রপ্তানির সিংহ ভাগ পণ্য পরিবাহিত হয় চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে। কিন্তু গত জুলাই বিপ্লব পূর্ববর্তী সময়ে নানা অনিয়ম আর প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে বন্দর কার্যক্রম, যা দ্রুত সময়ে অতিক্রম করা এক প্রকার দুঃসাধ্য বলে মনে করছিলেন অনেকে। তারপরও গত এক বছরে সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বন্দর এখন স্বাভাবিক অবস্থায় উন্নীত হয়েছে বন্দর।
বন্দর চেয়ারম্যান আরও বলেন, ছাত্র আন্দোলনের সময় ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় বন্দরের কার্যক্রম চরমভাবে ব্যহত হয়েছিল। চট্টগ্রামে কন্টেনার আটকে পড়ে ৫৪ হাজার, ঢাকার আইসিডিতে দুই হাজার ৫০০। জাহাজের টার্ন এরাউন্ড টাইম দুই-তিন দিনের থেকে পাঁচ-ছয় দিনে পৌঁছায়। এ জটিলতা দূর করতে রেলওয়ের সহযোগিতায় ট্রেনের সংখ্যা দ্বিগুণ করে কাস্টমস কর্মকর্তাদের ২৪ ঘণ্টা কাজ করার ব্যবস্থা করা হয়।
বন্দর চেয়ারম্যান জানান, চট্টগ্রাম বন্দরের চারটি কন্টেনার টার্মিনালের মধ্যে নিউমুরিং কন্টেনার টার্মিনাল এনসিটি বন্দরের সবচেয়ে বড় টার্মিনাল। ৯৫০ মিটার দীর্ঘ এ টামিনালে গত বছর মোট কন্টেনারের ৪৪ শতাংশ ওঠানো-নামানো হয়েছে। গত বছর এ টার্মিনালে জাহাজ থেকে কন্টেনার উঠা-নামা করেছে প্রায় ১২ লাখ ৮১ হাজার। এতে একসঙ্গে চারটি সমুদ্রগামী কন্টেনার জাহাজ ও অভ্যন্তরীণ নৌপথে চলাচলরত একটি জাহাজ ভেড়ানো যায়। ১৭ বছর ধরে সাইফ পাওয়ারটেক একটি প্রতিষ্ঠান দিয়ে একচেটিয়া পণ্য উঠা-নামার কাজ করায় তাদের নিয়োগ ও কাজ নিয়ে তৈরি হয় নানা সমালোচনা। সাইফ পাওয়াটেকের বেতনভোগী কর্মীদের তীব্র বিরোধিতার মুখে গত ৭ জুলাই থেকে এনসিটি পরিচালনায় নৌবাহিনীর ড্রাইডক লিমিটেডকে (সিডিডিএল) হস্তান্তর করতে পারায় কাজের গতি এসেছে।
বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান বলেন, চট্টগ্রাম ড্রাই ডক লিমিটেড (সিডিডিএল)দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সিডিডিএল টার্মিনালটির কার্যক্রমে শৃঙ্খলা, সময়ানুবর্তিতা এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনায় কনটেনার হ্যান্ডলিংয়ে দৃশ্যমান অগ্রগতি অর্জন করেছে। গত ১৭ দিনের এক হিসাবে দৈনিক গড় হ্যান্ডলিং হয়েছে তিন হাজার ২৫০ টিইইউএস (২০ ফুট সমতুল্য ইউনিট), যা আগের ১৯ জুন হতে ৬ জুলাই গড় দুই হাজার ৮৪৫ টিইইউএসের তুলনায় ৪০৫ টিইইউএস বা ১২.১০ শতাংশ বেশি।
চট্টগ্রাম বন্দরের ইয়ার্ডে প্রায় ২০ বছরের বেশি সময় ধরে পড়ে ছিল ১০ হাজার টিইউএস কন্টেনার ও ৪৫০টি যানবাহন। যা বন্দরের ২৫ শতাংশ স্থান দখল করে ছিল। এসব পণ্য নিলাম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তিন হাজার ৫০০ কোটি টাকা বন্দরের নিট আয় হয়। বন্দর ইয়ার্ডে দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকা বিপজ্জনক রাসায়নিক পণ্য দুই মাস ১৫ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করা হয়। সেসব কন্টেনার ভর্তি রাসায়নিক বোমার মতো বিস্ফোরণ ঘটার সম্ভাবনা ছিল।
বে টার্মিনালের জন্য ৫০০ একর জায়গা অধিগ্রহণ, ডিপিপি অনুমোদন ছয় মাসের মধ্যে স্বীকৃতি আদায় ও বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ৬৫০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে উল্লেখ করে বন্দর চেয়ারম্যান জানান, ডিপি ওয়াল্ড, পিএসএ সিঙ্গাপুর, আবুধাবি পোর্টের মতো বড় বন্দরের অপারেটর চট্টগ্রাম বন্দরে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ প্রকাশ করছে। বন্দর এলাকায় পরিবহণ সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে ই-টিকেটিং প্রথা চালুর মাধ্যমে পরিবহণ ব্যয় ২৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। বন্দর এলাকায় যানজট কমে গতিশীলতা বৃদ্বি পেয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরকে দক্ষ, গতিশীল ও জনবান্ধব করতে বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা ও কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে উল্লেখ করে চেয়ারম্যান জানান, এর ফলে এ বন্দর এখন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম আধুনিক বন্দর হিসেবে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এ বন্দরের সরাসরি রুট চালুর সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে বিদেশি বিনিয়োগের স্বার্থে বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর উপর গুরুত্ব দিতে হবে।
চেয়ারম্যান বলেন, আধুনিকায়ন, সম্প্রসারণের উপর গুরুত্বারোপ করে দেশ রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল হলে খুব কম সময়ে চট্টগ্রাম বন্দর বিশ্বের উন্নত বন্দরের কাতারে উন্নীত হবে।
চেয়ারম্যান জানান, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর আয় করেছে পাঁচ হাজার ২২৭ কোটি টাকা। যা এর আগের বছরের তুলনায় আট দশমিক ২২ শতাংশ বেশি। আর নিট উদ্বৃত্ত ছিল দুই হাজার ৯১২ কোটি টাকা। সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়েছে এক হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। যা গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বলে জানায় বন্দর কর্তৃপক্ষ।