বিভেদ সৃষ্টি না করতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান মির্জা ফখরুলের

‘ছোট-খাটো বিষয়গুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে বিভেদ সৃষ্টি না করার’ আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। আজ বুধবার (৩০ জুলাই) বিকেলে সাভারের আশুলিয়ায় এক প্রতিবাদ সমাবেশে এ আহ্বান জানান তিনি। ঢাকা জেলা বিএনপি এ সমাবেশের আয়োজন করে।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আজকে অনেক রকম কথা হচ্ছে, রাজনৈতিকানুবাদ হচ্ছে, হবেই। গণতন্ত্রের সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু এমন কোনো কিছু করবেন না, যাতে আবার গণতন্ত্র ব্যহত হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আমাদের সেটাই আহ্বান থাকবে। আমাদের আহ্বান থাকবে—ছোট-খাটো বিষয়গুলো নিয়ে এমন অবস্থা তৈরি করবেন না, যে অবস্থায় আবার সেই ফ্যাসিস্ট হাসিনা কোনো সুযোগ পায় দেশে ফিরে আসার।’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘আমরা অনুরোধ করব সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে—আসুন আমরা অতি দ্রুত আমাদের যে সমস্যাগুলো আছে সেগুলোকে মিটিয়ে ফেলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যাই। একটা নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমরা একটা জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করি। জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে আজকে এই মহিলা (শহীদ পরিবারের এক সদস্য) যে অভিযোগ করেছেন, সে অভিযোগ আমাদেরকে শুনতে হতো না। আজকের আয়জকদের আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি এমন একটি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম আয়োজনের জন্য এবং এতে করে জাতির বিবেক জেগে উঠবে বলে আমি বিশ্বাস করি।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমি এটা বিশ্বাস করি, আমরা তারেক রহমানের নেতৃত্বে আজকে গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে অবশ্যই গণতন্ত্রে ফিরে যেতে সক্ষম হব এবং আজকে যারা বিচার পাচ্ছেন না তাদের বিচার নিশ্চিত করতে সক্ষম হব, তাদের জীবনের সুব্যবস্থা করতে সক্ষম হব।’
মির্জা ফখরুল আরও বলেন, ‘আমি আজকে হতবাক হয়ে গেছি, এই দৃশ্য দেখা যায় না। আমরা কোন দেশে আছি! সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে হিটলার গ্যাস চেম্বারে দিয়ে মানুষ হত্যা করেছিল। আজকে দেখলাম আমাদের দেশে হাসিনা ছাত্রদেরকে পুড়িয়ে মেরেছে। এখানে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের স্বজনদের বক্তব্যের পরে বক্তব্য রাখার খুব একটা মানসিক অবস্থা থাকে না, আজকে সেটা নেই। আমি নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছা করে, আমরা কেমন একটা জাতি, যে জাতি আমরা আমাদের ছেলেদেরকে পুড়িয়ে মারি। কেমন একটা জাতি, আমাদের রাষ্ট্রের যারা কর্মচারী-কর্মকর্তা তারা সন্তানদেরকে হত্যা করে এবং পরে পুড়িয়ে হত্যা করে। এখানে একজন মা বক্তব্য রাখছিলেন, যার ছেলে বেঁচেছিল সেই অবস্থায় তাকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে।’
জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদ পরিবার একজনের অভিযোগ তুলে ধরে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘এখানে একজন বললেন, তার কেউ খোঁজ নিচ্ছে না। আমি ঢাকার ডিসিকে এখান থেকে বসেই ফোন করেছিলাম তারা সরকার কমিট করেছিলেন, যারা আহত এবং শহীদ বিশেষ করে যারা শহীদ হয়েছে, তাদের পরিবারগুলোকে ১০ লাখ টাকা করে তারা প্রাথমিকভাবে অনুদান দেবেন আর যারা আহত হয়েছে তাদের চিকিৎসা সমস্ত ব্যয়ভার বহন করবে। আমি মাত্র দুজনকে এখানে পেয়েছি যারা সেই টাকাটা পেয়েছেন বন্ড হিসেবে। বাকিদের আমি জানি না। একটা ছোট বাচ্চা ছেলে আট বছর বয়স। তার মাথার খুলিটা উড়ে গিয়েছিল। সেটাকে আর্টিফিশিয়াল প্লাস্টিক দিয়ে জোড়া লাগানো হয়।’
মির্জা ফখরুল ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা এমন একটা জাতি ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য আমাদের নেতা যারা আমাদের নেতৃত্ব করে, যাদেরকে দেশের মানুষ নেতা বলে মনে করে। তারা ক্ষমতায় চিরদিন টিকে থাকার জন্য এভাবে গুলি করে মানুষকে হত্যা করে যেটা হাসিনা করেছে। এখনও তীব্র স্বরে হাসিনার বিচার চাই, গোটা জাতি হাসিনার বিচার চায়। আপনারা জানেন, হাসিনা পালিয়ে গেছে ভারতে। ভারত তাকে আশ্রয় দিয়েছে। আপনারা দেখেছেন, সে সেখান থেকে অডিও ভার্সনে কথায় আবার বাংলাদেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করবার জন্য বিভিন্ন রকম উত্তেজনা ছড়ানোর চেষ্টা করছে এবং চেষ্টা করে গোপালগঞ্জ ইতোমধ্যে তারা সেই অবস্থা তৈরি করেছে।’
মির্জা ফখরুল আরও বলেন, ‘একটা জাতিকে তার নিজের দেশকে রক্ষা করার জন্য প্রত্যেককে সজাগ হয়ে থাকতে হবে। দীর্ঘ ১৫ বছর হাসিনা ফ্যাসিস্ট সরকার এই দেশের মানুষের ওপর স্টিম রোলার চালিয়েছে। বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা হয়েছে, অনেকে কারাগারে গেছেন, আপনাদের সাভার থেকে অনেকের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে আমাদের সেই কেরানীগঞ্জ কারাগারের মধ্যে।’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘গণতন্ত্রের জন্য আমাদের আন্দোলন, আমাদের ভোটের অধিকারের জন্য। এই আন্দোলন তো আমাদের করার কথা ছিল না। একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হওয়ার কথা ছিল ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পরে। দুর্ভাগ্য আমাদের, আজকে জোর করে ক্ষমতায় বসে, ক্ষমতার সরকারি সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করে তারা এভাবে হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় টিকেছিল। আল্লাহর কাছে অশেষ শুকরিয়া আদায় করছি, আল্লাহতায়ালার অশেষ মেহেরবানিতে আমাদের ছাত্রদের আত্মদানে, আমাদের জনগণের আত্মদানের মধ্য দিয়ে আমরা সেই ভয়াবহ দানবের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছি। কিন্তু এখনও আমরা গণতন্ত্রে ফিরে যেতে পারিনি।’
সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে কিন্তু এনজিওবাদ আজকে দেশ চালাচ্ছে। এখান থেকে কীভাবে মুক্তি নেবেন সেই পথনির্দেশনা দেবেন আমাদের নেতা এটাই প্রত্যাশা করি।’
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য আমান উল্লাহ আমান বলেন, ‘যেভাবে এই আশুলিয়াতে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে ফ্যাসিস্টরা, সেই ফ্যাসিস্টদের প্রধান শেখ হাসিনার বিচার এদেশের মাটিতে হতেই হবে। জিয়াউর রহমান, তথা জিয়া পরিবার সবসময়ে দেশের দুর্দিনে দেশের মানুষের পাশে ছিল, তারেক রহমান নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে এগিয়ে নেবেন, তিনি সবসময় জনগণের পাশে ছিলেন, ভবিষ্যতেও থাকবেন।’
ঢাকা জেলা বিএনপির সভাপতি খন্দকার আবু আশফাকের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক নিপুণ রায় চৌধুরীর সঞ্চালনায় সমাবেশে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খান, সহপরিবার কল্যাণ বিষয়ক দেওয়ান মো. সালাউদ্দিন বাবু, ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমিনুল হক বক্তব্য দেন।
শহীদ পরিবারের মধ্যে বাবুল হোসেনের স্ত্রী লাকি আখতার, আরাফাত মুন্সির বাবা স্বপন মুন্সি, বায়েজিদ মুস্তাফিজের স্ত্রী রিনা আখতার, শ্রাবন গাজীর বাবা আবদুল মান্নান গাজী, মামুন খন্দকার বিপ্লবের স্ত্রী খন্দকার সাথী, সাজ্জাদ হোসেন সজলের মা শাহিনা বেগম, আরাফুর রহমান রাসেলের ভাই সায়েদুর রহমান বাবু, জুলাই অভ্যুত্থানে পুলিশের গুলিতে পঙ্গু শান্ত তাদের কষ্টের কথা তুলে ধরেন।